পাকিস্তানে ধর্মভিত্তিক ক্ষমতাশীল রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত বিএনপির কারণে ধর্মভীরু জনগণের ভোটে এককভাবে জামায়াতে ইসলামী কখনো ক্ষমতায় যেতে পারেনি। ভারতে প্রথম থেকেই সর্বভারতীয় দল হিসাবে কংগ্রেসের অতুলনীয় জনপ্রিয়তা, কংগ্রেসের বিকল্প হিসাবে ধর্মান্ধ, জনসংঘ, বা বিজেপি শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেনি। বরং প্রথম লোকসভাতে বিরোধী দল হিসাবে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি স্বীকৃতি পায়। কেননা গান্ধী হত্যাকান্ডের স্মৃতি তখনো মানুষ ভুলতে পারেনি বলে আরএসএস বা জনসংঘকে দীর্ঘদিন মানুষ গ্রহণ করতে পারেনি। প্রথম থেকেই পাকিস্তান স্বৈরতন্ত্রের পথে হেঁটেছে, পাঞ্জাবী ভূস্বামী ও ভারত প্রত্যাগত উর্দুভাষী শিল্পপতিদের সিন্ডিকেটের সপক্ষে ক্ষমতায় ছিল মুসলিম লীগ ও সামরিক–বেসামরিক আমলাতন্ত্রের সাম্প্রদায়িক শক্তির জোট। তখন থেকেই রাষ্ট্রীয়ভাবেই সাম্প্রদায়িকতা পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে। এবং রাষ্ট্র হয়ে পড়েছে অগনতান্ত্রিক ও থিওলজিক্যাল। আজকের পাকিস্তান তো বলতে গেলে সেনা শাসিত, সংখ্যালঘু শূন্য একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র। সেই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানি অগণতান্ত্রিক ও সাম্প্রদায়িক লিগেসী থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধের অপরিমেয় ত্যাগের পরেও আওয়ামী নেতৃত্বের আপোষ ও অদূরদর্শিতার কারণে বাংলাদেশ বেরুতে পারেনি। ’৭৫ এর পর থেকে সকল ধর্মের লোকের রক্তে অর্জিত বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে যে সাম্প্রদায়িক ধর্মাশ্রয়ী বিভক্ত সমাজ মানস গড়ে উঠেছে, রাষ্ট্রে সমাজে অন্ধ ধর্মাচারের যে বিস্তৃতি ঘটেছে তাতে আজকের বাংলাদেশের সমাজকে অর্থোডক্স চার্চ শাসিত মধ্যযুগের ইউরোপের সামাজিক অবস্থার সাথে তুলনা করা যায়। মুক্তবুদ্ধি চর্চায় ও বিজ্ঞান মনস্কতায় বিশ্বাসী যে কোন ব্যক্তিকে আজ এই একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের বাংলাদেশে ব্রুনো–গ্যালিলিও–কোর্পানিকাসের ভাগ্য বরণ করতে হচ্ছে।
১৯৪৭ সালে স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন উচ্চ শিক্ষিত, উদারমনা, ধর্ম বিশ্বাসে পুরোপুরি সংশয়বাদী কংগ্রেস নেতা পন্ডিত জওহর লাল নেহেরু। স্বাধীনতা লাভের পর পরই বিশাল এই বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশের ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখার জন্য তিনি দেশ পরিচালনায় জবাবদিহিমূলক সংসদীয় গণতন্ত্রের পথ বেছে নেন। সংখ্যালঘু জনগণের নিরাপত্তা, তাদের ধর্মীয় ও সংস্কৃতি বোধকে মর্যাদা দেবার বিষয়ে তিনি ছিলেন ভীষণ আন্তরিক। কারণ আপাদমস্তক অসামপ্রদায়িক নেহেরু দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন ধর্ম নিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছাড়া বিশাল ভারতকে ঐক্যবদ্ধ রাখা যাবে না। দীর্ঘ ১৭ বছর ভারতের প্রধানমন্ত্রী থেকে তিনি সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে দৃঢ় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন, ঠান্ডা যুদ্ধের বৈরী পরিবেশে তিনি ভারতকে তৃতীয় দুনিয়ার একমাত্র গণতান্ত্রিক দেশ হিসাবে গড়ে তুলেন। যেখানে ব্যালট ছাড়া ক্ষমতা পরিবর্তনের অন্য কোন উপায় ছিল না এবং এখনো নেই। এরি অনুষঙ্গ হিসাবে গড়ে উঠে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, পরিকল্পনা কমিশনের মত বিধিবদ্ধ ও কার্যকর সাংবিধানিক ব্যবস্থা। জবাবদিহিতা ও ভোটাধিকারের কারনে বিশাল ভারতে সংখ্যা লঘুদের নিরাপত্তা কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া ’৫০ পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের চাইতে অনেক উন্নত ছিল। তিন দেশের জনমিতির চিত্রই এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পরে কংগ্রেসের সর্বভারতীয় ক্যারিশমেটিক নেতৃত্ব শূন্যতার কারণে ভারতের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক চিত্র পাল্টাতে থাকে। কংগ্রেসের দুর্বলতার সুযোগে বিকল্প হিসেবে প্রান্তিক অবস্থান থেকে ক্ষমতার কেন্দ্রে উঠে আসে উগ্র হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি।
১৯৯০ সালে আদভানীর নেতৃত্বে মসজিদ মন্দির বিতর্ক তুলে, রথযাত্রার মাধ্যমে ধর্মান্ধ জনগোষ্ঠীকে উস্কে দিয়ে বাবরি মসজিদ ভেঙে ভারতব্যাপী সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করে বিজেপি বদলে দেয় ভারতের রাজনৈতিক শক্তির চিত্র ও বিন্যাস।
১৯৯০ সাল থেকে বিজেপি ঠেকাতে নরম হিন্দুত্ববাদের ভুল পথে হাঁটা কংগ্রেসের ২০০৪–১৪ পর্যন্ত পর পর দুই মেয়াদের রাজনৈতিক ব্যর্থতার ফলে ২০১৪ সালে চরম উগ্রপন্থী গোষ্ঠী মোদির নেতৃত্বে বিজেপি এককভাবে ক্ষমতায় আসে ক্ষমতায় এসেই আরএসএস এর নির্দেশে মোদি সরকার টার্গেট করে ভারতের বহুত্ববাদী রাজনৈতিক সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে। কংগ্রেস ও আধুনিক ভারতের নির্মাতা পন্ডিত নেহেরুকে যতভাবে হেয় ও খাটো করা যায় সাধ্যমত মোদি তা করে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠিত সাংবিধানিক সংস্থা সমূহ–স্বাধীন নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ সহ ফ্যাসিস্ট সাম্প্রদায়িক স্বেচ্ছাচারিতা চালানোর ক্ষেত্রে যত সাংবিধানিক বাধা আছে সেগুলোকে ভেতর থেকে নানাভাবে দুর্বল ও নিষ্ক্রিয় করে ধর্মান্ধ কর্তৃত্ববাদী শাসন কায়েমের গভীর ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে মোদির সরকার। প্রচার মাধ্যমকে প্রায় কব্জা করে নিয়েছে বৃহৎ লুটেরা পুঁজির মালিকদের অর্থানুকূল্যে। সংখ্যালঘু নিপীড়নের নতুন নতুন পথ ও পদ্ধতি বের করছে প্রতিদিন। শিক্ষার পাঠক্রম পাল্টে প্রকৃত ইতিহাসকে আর এস এস এর ইচ্ছানুযায়ী ঢেলে সাজানো হচ্ছে। এক বিদ্বিষ্ট ও বিভাজনের রাজনীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা আজ ভারতে গণতন্ত্রকে বিপদগ্রস্ত করে তুলেছে। ইতিহাস–ঐতিহ্যকে ভুলিয়ে দিয়ে ভারতকে ফিরিয়ে নিতে চাইছে মুসলিম শাসন পূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের যুক্তিবিহীন মনু–পরাশর–রঘুনন্দন শাসিত ধর্মাশ্রিত সমাজ ভাবনায়। ইতোমধ্যে ভারতে সমাজ মানস হয়ে পড়েছে সাম্প্রদায়িকতায় বিদ্বিষ্ট, বিভক্ত ও বিভাজিত। বলা বাহুল্য হবে না যে, আমাদের দেশের দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দল ও ধর্মব্যবসায়ীদের দৃষ্টিতে ভারতের শাসক গোষ্ঠীর এই পরিবর্তন তথা মোদির নেতৃত্বে ভারতের অধ:পতিত বর্তমান ও নেহেরু–ইন্দিরা নেতৃত্বের গৌরবোজ্জ্বল অসাম্প্রদায়িক অতীতের মধ্যে কোন পার্থক্য চোখে পড়ে না। যদিও ভারতের কোটি কোটি মুসলিম আজ জীবনের প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা দিয়ে এই উৎকট পার্থক্য বুঝতে পারছে।
সর্বভারতীয় দল হিসাবে অতীতের মত একক ভাবমূর্তি নিয়ে কংগ্রেসের দাঁড়াতে না পারা, বামরা ছাড়া ধর্ম নিরপেক্ষ শক্তিশালী অন্য আঞ্চলিক দলগুলির সংকীর্ণ সুবিধাবাদিতা ও অনৈক্য, সব মিলিয়ে বিজেপি বিরোধী কার্যকর, ধর্ম নিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, ঐক্যবদ্ধ বিকল্পের অভাব বিজেপি ও মোদিকে স্বেচ্ছাচারী করে তুলেছে। অসম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সহযোগিতার পরিবর্তে সম্প্রতি মুসলিমদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক স্বাতন্ত্র্যবোধ প্রবল হয়ে উঠেছে, এদের মধ্যে ধর্মীয় সংস্কৃতি ও রাজনীতির বিস্তার হচ্ছে, যোগাযোগ বাড়াচ্ছে আলকায়দা, আই এস সহ জঙ্গি ইসলামি আর্ন্তজাতিক নেটওয়ার্ক। এতে বিজেপির আরো সুবিধা হচ্ছে। মোদি হিন্দুদের পপুলিস্ট নেতায় পরিণত হচ্ছে। বিপদের কথা হল আজ ভারতীয় জনমানস থেকে এই বোধ হারিয়ে যাচ্ছে যে ভারত রাষ্ট্রটি ভেঙে যাওয়া পাকিস্তান বা বাংলাদেশের মত ক্ষুদ্র জাতি রাষ্ট্র নয়–এটা হল নানা ধর্মের উৎস ভূমি, খৃষ্টান ও ইসলামের মত বহিরাগত ধর্মাবলম্বী সহ কোটি কোটি অহিন্দু জনগনের মাতৃভূমি আসমুদ্র হিমাচল বিস্তৃত বহুভাষাভাষী ও সংস্কৃতির বত্রিশ লক্ষ বর্গ কিলোমিটারের, মেজাজে, অবয়বে, গাত্রবর্ণে বিভক্ত ১৪০ কোটি মানুষের একটি উপমহাদেশ। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মত ইউনিলেটারিজম এখানে অচল। জবাবদিহিমূলক প্রকৃত গতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছাড়া, ফেডারেলিজম ছাড়া, সেকুলার রাষ্ট্রাদর্শ ছাড়া মোদির স্বপ্নের কেন্দ্রীভূত সাম্প্রদায়িক কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থায় উত্তরে–দক্ষিণে, পূর্বে–পশ্চিমে এদেশ টুকরো টুকরো হয়ে পড়া–অনিবার্য। ঘৃণা, বিদ্বেষে পরিপূর্ণ মোদি–অমিতের অর্ধ শিক্ষিত রাজনৈতিক জুটির সংকীর্ণ ও সীমিত দৃষ্টি ও বোধে তা ধরা না পড়াই স্বাভাবিক। অন্যদিকে উপমহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ আজন্ম অগণতান্ত্রিক সেনা শাসিত, ইসলামিক রিপাবলিক অফ পাকিস্তানে সশস্ত্র তালেবানরা রাষ্ট্রশক্তিকে চ্যালেঞ্জ করছে যাদের উগ্র ধর্মান্ধ না বলে মানবেতর প্রাণী বলা শ্রেয়। ১৯৪৭ সালে শতকরা ২৩ জন হিন্দু শিখ বৌদ্ধ অধ্যুষিত এইদেশ প্রায় সংখ্যালঘু শূন্য হয়ে পড়েছে। এখন শিয়া ও আহমদিয়াদের উপর প্রতিনিয়ত মাঠে মসজিদে হামলা হচ্ছে। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের ঘোষিত গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার রাষ্ট্রাদর্শ থেকে মাত্র চার বছরের মাথায় সাংবিধানিক ভাবে সরে আসা বাংলাদেশে এখন রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম যা পৃথিবীর অধিকাংশ মুসলিম দেশে নেই। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও ধর্মান্ধ সামাজিক শক্তির চাপে আমাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতির সাম্প্রদায়িকীকরণ চলছে ও মুক্তিযুদ্ধের ক্ষমতাসীন দল একের পর এক তাদের দাবী মেনে নিচ্ছে ক্ষমতার সমীকরনে। কৌতুহলের ব্যাপার হল বর্তমানে উপমহাদেশের তিন দেশেই স্কুলের বিজ্ঞান পাঠক্রম থেকে বিজ্ঞানের মূল নির্যাস বিবর্তনবাদ বাদ দেওয়া হয়েছে। আমাদের দেশে ঐতিহ্যবাহী সাধারণ শিক্ষার ধারা দূর্বল হয়ে পড়ার ফলে এক সময়ের গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী অসাম্প্রদায়িক সামাজিক বাতাবরণ নষ্ট হয়ে গেছে। তিন দেশেই অসিষ্ণুতা ও নিজ ধর্মের কথিত শ্রেষ্ঠত্বের জোশে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মাবলম্বীদের একাংশে “অনুভূতির”প্রাবল্যে অন্য সব ধর্মাবলম্বীদের অনুভূতি হারিয়ে গেছে। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে ৩০ লক্ষ মানুষের ত্যাগে আর্জিত এই দেশ একটি থিওক্র্যাটিক রাষ্ট্র হয়ে গেছে প্রায়। এক অদ্ভূত আঁধার নেমে এসেছে আজ সিন্ধু–গঙ্গা–পদ্মার বুকে। হিংসায় উন্মত্ত এক ভয়ংকর গন্তব্যে পানে ছুটে চলেছে তিন দেশে বিভক্ত বিস্তীর্ণ এই উপ মহাদেশ।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক।











