বিশ্ব খরা ও মরুকরণ প্রতিরোধ দিবস আজ। বাংলাদেশে প্রথম ১৯৯৫ সালে বিশ্ব মরুকরণ প্রতিরোধ দিবস পালিত হয়। উত্তরাঞ্চলের রাজশাহীকে কেন্দ্রবিন্দু ধরে নগর থেকে ৪০ কিমি পশ্চিমে কাকনহাটে জাতীয়ভাবে প্রথমবারের মতো দিবসটি পালিত হয়।
১৯৭৫ সালে প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের পক্ষ থেকে খরা ও মরুকরণের প্রতি সোচ্চার হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয়। এই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৭ সালে নাইরোবিতে বিশ্ব মরুকরণ বিরোধী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৯২ সালে রিও ডি জেনিরোতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের পরিবেশ ও উন্নয়ন বিষয়ক সম্মলনের পরপরই মরুকরণ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কনভেনশন গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। রিও সম্মেলনের এজেন্ডা ২১ এর প্রস্তাবটি ১৯৯২ সালে জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদের ৪৭তম অধিবেশনে গৃহীত হয় এবং ইন্টারগর্ভমেন্টাল নেগোশিয়েটিং কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটি মরুকরণ সংক্রান্ত খসড়া কনভেনশন চূড়ান্ত করে। ১৯৯৪ সালের জুন মাসে কনভেনশনের দলিল চূড়ান্ত হয়। এই কনভেনশনে ৫০টি দেশ কর্তৃক অনুমোদিত হওয়ার পর ১৯৯৬ সনের ২৬ ডিসেম্বর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হয়। বাংলাদেশও এই কনভেনশন অনুমোদন করে। পরবর্তীতে খরা ও মরুকরণ সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে সচেতন করে তুলতে ১৭ জুন পালন করা হয় বিশ্ব খরা ও মরুকরণ প্রতিরোধ দিবস।
সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হচ্ছে বিশ্ব। প্রাকৃতিক দুর্যোগের নানা পরিবর্তনের মধ্যে জলবায়ুর কুপ্রভাবে বিশ্বে মরুকরণ একটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা। জাতিসংঘের এক গবেষণা বলছে, ২০ বছর পর মানবজাতির যাবতীয় চাহিদা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে। সে সময়ে বর্তমানের প্রায় ৫০% বেশি খাদ্যের প্রয়োজন হবে। জাতিসংঘ আশংকা করছে তখনকার চাহিদামতো প্রয়োজনীয় খাদ্য ও অন্যান্য উপাদানের ঘাটতি দেখা দিয়ে সেটা সংকট সৃষ্টি করতে পারে। সেই সংকট গতি নিয়ে চলে যেতে পারে সংঘর্ষের দিকে। আর এই সংকটের একমাত্র কারণ হবে মরুকরণ ও খরা।
ইতিমধ্যে বিশ্বের জলাভূমির ৭০ শতাংশ মরুকবলিত হয়ে পড়েছে, যার পরিমাণ পৃথিবীর মোট ভূমির চার ভাগের এক ভাগ। নিষ্কাশনে অব্যবস্থা ও লবণাক্ততার কারণে সেচের আওতাধীন আবাদি জমির বিশাল অংশ অবক্ষয়ের সম্মুখীন। মরুকরণ ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য বিশাল হুমকি। এজন্য মরুকরণ বিস্তার রোধ করা প্রয়োজন।
মরুকরণ যেমনিভাবে বিশ্বব্যাপী মাথাব্যথার কারণ তেমনি আমাদেরও উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে দিন দিন আমাদের ফসলি জমি কমে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। কমছে গাছপালা, বন–জঙ্গল। তার চেয়ে বড় বিষয় আমাদের নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। অন্যান্য জলাধারের অবস্থাও কাহিল। সামপ্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকিপূর্ণ তিনটি দেশের একটি বাংলাদেশ। এ অবস্থায় পরিবেশের প্রতি আমাদের মনোযোগী হওয়া আবশ্যক।
মরুকরণ এতদিন পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না হলেও এখন এটি পরিবেশ বিজ্ঞানীদের যথেষ্ট ভাবিয়ে তুলেছে। সমপ্রতি আমাদের দেশ দিয়ে বয়ে যাওয়া আম্ফান, ফণী, সিডর, আইলা, নার্গিসসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ এই ভাবনাকে আরো প্রবল করে তুলেছে।
মরুকরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এই সুজলা–সুফলা শস্য–শ্যামল দেশটি হয়তো একদিন হারিয়ে যেতে পারে মরুভূমির ধূসর বালির গহ্বরে। বাংলাদেশের সামগ্রিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে বিশ্লেষকরা এটাই আশঙ্কা করছেন। তারা বলেছেন মরুকরণের প্রধান দুটি বিষয় হচ্ছে একটি বিস্তৃত এলাকা ছেড়ে যদি সেখানকার মাটি অনুর্বর হতে থাকে এবং যদি নদী–নালা, খাল–বিল শুকিয়ে যেতে থাকে ও বৃষ্টির অভাব ঘটে। বিগত কয়েক দশক ধরে এ লক্ষণগুলো বেশিভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে বাংলাদেশে।
এ পরিস্থিতিতে কৃষিজমি সংরক্ষণ, কৃষিকাজে জৈব সার ব্যবহারে কৃষকদের উৎসাহিতকরণে দেশব্যাপী ব্যাপক প্রচারণা, অপরিকল্পিত নগরায়ন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা, নদীর পানি প্রবাহে যথাযথ উদ্যোগ, খাল–বিল ও জলাভূমিসমূহ সংরক্ষণে গুরুত্ব দিতে হবে।
পরিবেশ বিজ্ঞানীরা খরা ও মরুকরণ প্রতিরোধে বৃক্ষরোপণ এবং বিকল্প জ্বালানি সৃষ্টির ওপর জোর দিচ্ছেন। বিশিষ্ট প্রযুক্তিবিদ ও পরিবেশবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. ওবায়দুল করিম দৈনিক আজাদীকে জানান, বাংলাদেশ চিরসবুজ বৃষ্টিবহুল দেশ। এই ভূপ্রকৃতি এক বিশেষ জীব বৈচিত্র্যের জন্ম দিয়েছে। আর এর সাথে অস্তিত্ব পেয়েছে এক বিশেষ সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য। এই বৈচিত্র্য হারিয়ে গেলে, হারিয়ে যাবে প্রাণ আর উদ্ভিদের ভারসাম্য। হারাবে নদী আর সবুজ ধানক্ষেত নিয়ে পল্লীগীতি। গ্রামীণ ক্রীড়া পাবে লোপ। আমরা যে মাছে –ভাতে বাঙালি তাও হারাবে। তো আমাদের ভাষা থেকে বহু বাগধারা, শব্দ হারিয়ে যাবে। যদিও এগুলো সময় নেবে অনেক, কিন্তু তা ঘটবে। ক্লাইমেট চেঞ্জের এই ধারা আমাদের প্রকৃতির উপর অতিরিক্ত ক্রিয়ার ফল। এখনই তা বন্ধ করতে হবে। পরিবেশ শিক্ষা সবার আগে অগ্রগণ্য হতে হবে।












