দৈনিক আজাদীতে একই দিনে দুটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, যে দুটি সাধারণ পাঠকের জন্য আনন্দসংবাদ। একটি হলো : বাজারে মসলার পর্যাপ্ত মজুদ, পণ্যমূল্যও নিম্নমুখী। অন্যটি হলো : ‘চাক্তাই–খাতুনগঞ্জের আড়তে পেঁয়াজের স্তূপ, দাম কমেছে কেজিতে আরো ১০ টাকা’।
নিত্যপণ্যের দামের বর্তমান লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে সব স্তরের মানুষ ভোগান্তিতে পড়েছে। এ অবস্থায় উপরে উল্লিখিত সংবাদ দুটি কিছুটা হলেও আশার আলো ছড়ায় বুকে। কেননা, নিত্যপণ্যের দামের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি সীমিত আয়ের মানুষের জন্য অসহনীয় হয়ে উঠেছে। বলা যায়, গরিবরা আছে সংকটে আর মধ্যবিত্তরা দিশেহারা। জীবনযাত্রার ব্যয় সংকুলান করার কোনো পথ তারা খুঁজে পাচ্ছে না।
প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, আমাদের দেশে প্রায় সব ধরনের মসলা আমদানি করতে হয়। স্বাভাবিকভাবে কোরবানির সময় মসলার চাহিদা বেড়ে যায়। তাই অনেক সময় বাজারে সংকট দেখা দেয়। তবে এ বছরের চিত্র ভিন্ন। বতর্মানে বাজারে প্রচুর পরিমাণে মসলার মজুদ রয়েছে। দাম বাড়ার আশঙ্কা নেই। অন্য সংবাদে বলা হয়েছে, ভোগ্যপণ্যের বৃহৎ পাইকারী বাজার চাক্তাই খাতুনগঞ্জে দোকান–গুদামে ভারতীয় পেঁয়াজে সয়লাব হয়ে গেছে। প্রায় প্রতিটি দোকানে ভারতীয় পেঁয়াজের বস্তার সারি সারি স্তূপ। জায়গা সংকুলান না হওয়ায় অনেকে দোকানের বাইরে পেঁয়াজের বস্তা রাখেন। পেঁয়াজের সরবরাহ বাড়ার কারণে গত দুইদিনে ভারতীয় পেঁয়াজের দাম কেজিতে আরো ১০ টাকা কমেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, চাক্তাই খাতুনগঞ্জের বাজারে এখন গড়ে ২৫–৩০ ট্রাক ভারতীয় পেঁয়াজ প্রবেশ করছে। ফলে দামও কমছে। অন্যদিকে খুচরা বাজারে ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকায়। পাইকারীর সাথে খুচরার কেজিপ্রতি পার্থক্য ১৫–২০ টাকা। ভোক্তারা বলছেন, কোরবানির বাজারকে ঘিরে মসলার বাজার অস্থিতিশীল করে তুলে ব্যবসায়ীরা। তাই প্রশাসনকে বাজার মনিটরিং জোরদার করতে হবে।
নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতিতে সরকারের করণীয় কী–এ বিষয়ে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতামত প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকান্তরে। তাঁরা বলেন, সরকারের কাছে বাজার নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার তিনটি–১. পণ্যের ওপর শুল্ক–কর কমানো; ২. খোলাবাজারে পণ্য বিক্রি বাড়ানো এবং ৩. বাজার তদারকি জোরদার করা। যে কারণে পণ্যের দাম বেড়েছে, এর অনেকটা দায় জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি। অথচ কৌশলগত এ পণ্যটির ওপর প্রায় ৩৪ শতাংশ করারোপ করা হয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এ হার কমিয়ে বাজারদর সমন্বয় করা হয়েছে। সরকার খোলাবাজারে পণ্য বিক্রি করছে; কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এর আকার অনেক বেশি বিস্তৃত ও সহজ করা প্রয়োজন। আর শেষ হাতিয়ার হিসাবে বাজার তদারকির কাজটি খুব একটি কার্যকর নয় বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। অবৈধভাবে গড়ে ওঠা সিন্ডেকেটগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা সরকার নিতে পারছে না। এ দিকটাতে নজরদারি বাড়াতে হবে। তবে এটাও ঠিক যে, বাজার পরিদর্শন আর কিছু ব্যবসায়ীকে জরিমানা করে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়, যা অতীতে দেখা গেছে। এক্ষেত্রে যথাসময়ে পণ্যের জোগান নিশ্চিত করার মাধ্যমে কারসাজি বন্ধ করা সম্ভব বলে অভিজ্ঞমহল।
তবে অর্থনীতিবিদ ও পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন মধ্যস্বত্বভোগীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে বাজার। সরকার কেবল টিসিবির মাধ্যমে এদের মজুদদারিসহ মূল্যবৃদ্ধির কৌশল ঠেকাতে পারবে না। এজন্য আরো ব্যাপক পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি প্রয়োজন। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন চাল ও অন্যান্য ভোগ্যপণ্য উৎপাদনের যে হিসাব দেয়া হয়, তা সম্ভবত বাস্তবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। দ্বিতীয়ত, বার্ষিক কী পরিমাণ চাল ও অন্যান্য পণ্য আমদানি করতে হবে, তার সঠিক হিসাব করে আমদানির ব্যবস্থা করা দরকার। তৃতীয়ত, বিশেষ পরিস্থিতিতে জনস্বার্থে খাদ্যপণ্য আমদানিতে করের হার কমাতে হবে। চতুর্থত, মজুদদারির বিষয়ে কড়া তদারকি বজায় রাখতে হবে। পঞ্চমত, বাজারে মূল্য নির্ধারণ ও তা স্থিতিশীল রাখার ব্যাপারেও সরকারি নিয়ন্ত্রণ থাকা জরুরি। সরকারও একটি কার্যকর সরবরাহ চেইন তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছে। সরকারি নীতির ক্ষেত্রেও ভ্রান্তি দেখতে পাচ্ছেন অনেকে, যা দূর করা প্রয়োজন।
অর্থনীতিবিদরা বলেন, দাম নিয়ন্ত্রণে বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা অব্যাহত রাখাসহ প্রতিনিয়ত আন্তর্জাতিক বাজার দর সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের তাগিদ দেওয়া দরকার। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে দেশেও ভোগ্যপণ্যের দাম নির্ধারণের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।