মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০৪১ সালের মধ্যে এই বাংলাদেশকে উন্নত, সমৃদ্ধ দেশ, স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরীর ঘোষণা করেছেন। তিনি আরো বলেছেন স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার মূল চাবিকাঠি হবে ডিজিটাল সংযোগ। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। স্বপ্নের মেট্রোরেল চালু স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরীর একটা শুভ সূচনা। প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ়প্রত্যয় এভাবে এক একটি সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময়েই উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ এর স্বপ্ন সার্থক হবে। এসব প্রচেষ্টার সাথে সাথে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মূল্যবোধ সম্পন্ন তরুণ জনগোষ্ঠী। কারণ তারাই স্মার্ট বাংলাদেশের কর্মক্ষম স্মার্ট নাগরিক হবে। এই স্মার্ট নাগরিক এর আওতায় প্রাইমারী, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সব ক্যাটাগরির শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতির প্রয়োজন। এদের প্রযুক্তিগত দক্ষতার সাথে সাথে উচ্চতর মূল্যবোধ সম্পন্ন মনমানসিকতা তৈরীতে লক্ষ্য রেখেই এগোনো প্রয়োজন। আজকাল বেশিরভাগ জনগণের মধ্যে মূল্যবোধের মাত্রা শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে যা ভবিষ্যতের উন্নত সমৃদ্ধ দেশ বিনির্মাণে হুমকি স্বরূপ। যাদের বয়স ৪২ বছর অতিক্রম করেছে তারা কর্মক্ষমতার আওতায় থাকছেন না, যেহেতু তাদের বয়স ২০৪১ সালে ৬০ বছর পূর্ণ হবে। সুতরাং ৪২ বছর এর নীচের বয়সের তরুণ জনগোষ্ঠীই এই উন্নত সমৃদ্ধদেশ তথা স্মার্ট বাংলাদেশের নাগরিকের মর্যাদায় ভূষিত হওয়ার মুখ্য জনগোষ্ঠী, কেননা প্রবীণদের চেয়ে তারাই উন্নততর সুবিধা ভোগ করার সুযোগ পাবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছেন যে স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরীতে চারটি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে এগোতে হবে। বিষয় চারটি হলো : স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট, স্মার্ট সোসাইটি। স্মার্ট সিটিজেন মানে সাধারণ জনগণ, যারা এখন ডিজিটাল সিটিজেন হিসেবে দক্ষতা অর্জন করেছে তারাই ২০৪১ সালে স্মার্ট সিটিজেন এ পরিণত হবে সর্বাগ্রে। স্মার্ট ইকোনমি ও স্মার্ট গভর্নমেন্ট এই দুই বিষয় তৈরীতে বেশিরভাগ দায় সরকার ও সরকারি সংস্থার। আর স্মার্ট সোসাইটি তৈরীতে অবশ্যই তিনটি বিষয় প্রস্তুত হলেই আপনা আপনি স্মার্ট সোসাইটি তৈরী হয়ে যাবে এই তিন ক্ষেত্রের সমন্বয়ের মাধ্যমে। সাধারণ জনগণ সরকারি উদ্যোগ এর পাশাপাশি ব্যাক্তিগত ভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশপ্রেম চেতনায় এগিয়ে স্ব স্ব দক্ষতার ক্ষমতা অর্জনই স্মার্ট সিটিজেন এ পরিণত হওয়ার উপায় বলে মনে হয়।
সাধারণ জনগণ এর জীবন উন্নত সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে বর্তমানে আন্তরিকতা, নৈতিকতা, জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ, সাম্যতা, মানবিকমর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার, সহমর্মিতা ইত্যাদি মূল্যবোধের দিকে রেখে আমাদের অন্তত প্রাইমারী, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাক্রমে প্রাধান্য দেওয়া প্রয়োজন। আশার কথা হলো পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, সরকার ইতিমধ্যে নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের বৈচিত্র্য ও মেধাকে গুরুত্ব দিয়ে পাঠদান পদ্ধতির পরিবর্তনের বাস্তবায়ন এই বছর থেকেই পরীক্ষামূলক ভাবে শুরু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। নতুন শিক্ষাক্রম ১ জানুয়ারি ২০২৩ থেকে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে ২০২৪ সাল থেকে বাকি শ্রেণিগুলোতে চালু করা হবে বলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এর রূপরেখায় ঠিক করা হয়েছে এখন এই নতুন পরিবর্তিত শিখন ও মূল্যায়ন সমন্বিত শিক্ষাক্রম শিক্ষার্থীদেরকে প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও উচ্চতর মূল্যবোধ সৃষ্টিতে সহায়ক হবে। আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে বলে আশাবাদী। শিক্ষার্থীদের এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে শিক্ষার মান উত্তোরণের প্রধান ভূমিকায় শিক্ষকগণের আন্তরিক ও দক্ষতাপূর্ণ পাঠদান অবশ্যই একান্তভাবে প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে চলমান প্রশিক্ষণ কার্যক্রম মনিটরের মাধ্যমে কার্যকর করা প্রয়োজন।
নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নকারী মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) ইতিমধ্যে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রদানের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন। দ্রুত এই কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরীতে তৈরীরত শিক্ষার্থী, নবীন প্রবীণ শিক্ষক ছাড়াও তাদের সাথে সংশ্লিষ্টদেরকেও প্রস্তুতিমূলক মনোভাব নিয়ে এগোনো প্রয়োজন। যেহেতু নতুন শিক্ষাক্রমে পরীক্ষার চেয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়ন বেশি, তাই শিক্ষকদের আন্তরিকতায় শিক্ষার্থীদেরকে শ্রেণিকক্ষে মূল্যবোধ সমৃদ্ধ শিক্ষা প্রদানের সুযোগ তৈরী হবে।
মূলত এই পরিবর্তনের মাধ্যমে যারা নিজেকে প্রস্তুত করে নিতে সক্ষম হবে তারাই হবে স্মার্ট বাংলাদেশের তরুণ। কারণ নজরুলের মতে– ‘পুরানোকে, প্রবীণ ধ্যান ধারণাকে, অতীত চিন্তা চেতনাকে শাণিত করে, যারা এগিয়ে যান নতুন ধারায়, তারাই নতুন, তারাই তরুণ’। পুরানোকে যারা গা ঝাড়া দিয়ে সতেজ করতে জানেন, পুরানোর ফাঁক ফোঁকড়্গুলো শুধরে যারা সৃষ্টিশীল চিন্তায় নিজেদেরকে নিয়োজিত রাখেন, তারাই তরুণ। ‘শুধু বয়সে তরুণ হলেই তাদের তরুণ বলা যায় না। বয়স একটা পরিসংখ্যান মাত্র। তাইতো রবীন্দ্রনাথ বলেছেন —‘ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা/ আধ মরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা’। এখানে কবি আধ মরা বলতে যত অশুভ, অলস, দায়িত্ববোধ বিবর্জিত, নীতিনৈতিকতাবিহীন মানুষদের বুঝিয়েছেন। যে নতুন বা নবীন তরুণ জঙ্গিবাদের মন্ত্রণা পেয়ে দেশে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে দেশে অরাজকতা সৃষ্টির পাঁয়তারা চালায় এমন তরুণ বা নবীনকে নিশ্চয় কেউ তরুণ বলবে না।
এই স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে নজরুলের চিন্তা চেতনা অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। তিনি তাঁর প্রবন্ধের বর্ণিত লাইনে বলেছেন, ‘এমনও নবীন আছেন যাদের উর্দির তলে পোড় খাওয়া কঙ্কালসার অস্তিত্ব, আবার এমনও প্রবীণ আছেন যাদের বার্ধ্যকের জীর্ণাবরণের তলে মেঘলুপ্ত সূর্যের মতো প্রদীপ্ত যৌবন। বয়সে তরুণ হলেও যারা পুরাতনকে, মিথ্যাকে, অশুভ শক্তিকে, কায়েম হয়ে থাকা স্থিত অবস্থাকে আঁকড়ে ধরে ধর্ম ও সংস্কৃতির দোহাই দেয়, পরিবর্তনকে স্বাগত জানান না, পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে পারেন না, তারাই প্রবীণ, তারাই বৃদ্ধ। যারা সৃষ্টিশীল তারা সমাজের অভিনব যাত্রার চলার ছন্দে ছন্দ মিলিয়ে চলতে পারেন, নতুন সূর্যের উদয় দেখে যারা নিদ্রাভঙ্গের ভয়ে দ্বার বন্ধ করে আছে, তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন, অতিজ্ঞানের অগ্নিমান্দ্যে অহংকার বশত; গম্ভীর হয়ে থাকা মানুষদেরকে ঘা মেরে ঝাঁকুনি দেন, সমাজকে সরল পথে চালিত করে তারাই নবীন ও আসল তরুণ। কবি সুকান্তের কথার মতো, নবীন মানে তরুণ, আর তারুণ্য মানে সাহস, সেই সাহসের প্রেরণা যোগানোই তরুণের কাজ। সব রকমের যুগপোযোগী পরিবর্তনের ইচ্ছা এবং শক্তি যাদের হাতে থাকে তারাই নবীন। আজকের উন্নত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে সেইসব নবীনদেরকেই প্রয়োজন। সঠিক সময়ে সঠিক কাজ শিখে উন্নত সমৃদ্ধ দেশ গড়ার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া তরুণদেরকেই আজকের বাংলাদেশ এর পতাকাতলে বেশি প্রয়োজন। কারণ এই বাংলাদেশ তো এই রকম তরুণের হাতেই সৃষ্টি।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর সঠিক সময়ে সঠিক চেতনা ও কাজের বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি তাঁর তরুণ বয়সে স্বাধীনতার স্বপ্নকে তাঁর নবীন দৃপ্তচেতনা হিসাবে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে স্বাধীনতার নেতা হতে পেরেছিলেন বলে ধারাবাহিক সংগ্রামের মাধ্যমে এই বাংলাদেশের সৃষ্টি, এবং সাথে সাথে তারুণ্যের চেতনার বাস্তবায়নে নিজে পরিণত হলেন, খোকা থেকে শেখ মুজিব, শেখ মুজিব থেকে মুজিব ভাই হয়ে বঙ্গবন্ধু, পরিশেষে জাতির পিতা।
জাতির পিতার তারুণ্য নির্ভর চেতনার বাস্তবায়নে আমরা পেলাম সোনার বাংলার স্বপ্ন নেওয়া স্বপ্নের বাংলাদেশ। আজকের এই ডিজিটাল বাংলাদেশকে উন্নত সমৃদ্ধ দেশ তৈরীতে কর্মক্ষম দক্ষ তরুণের কাছেই জাতির প্রত্যাশা যেন ঘুণেধরা মূল্যবোধহীন চেতনাকে শুধরে নিয়ে এগিয়ে যায়। তরুণদের পাশাপাশি তরুণদের বেড়ে ওঠার পরিবেশ, শিক্ষাক্ষেত্র, পড়াশোনা, শিক্ষক শিক্ষার্থীর পারস্পরিক সম্পর্ক, পরিবারিক শিক্ষা, তাদের আচরণ, বিচরণ, খেলাধূলায় অংশগ্রহণ, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড তথা জীবনাচরণের সবক্ষেত্রে সরকার এবং পরিবারকে মনোযোগী হওয়ার বিশেষ প্রয়োজন।
একথা ঠিক স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরীতে তরুণদেরকে অগ্রগণ্য করে হিসেব করলেও সেই তরুণদেরকে যারা পরিপালন, পরিতোষণ; ও প্রস্তুতকরণের জন্য মা, বাবা, পরিবেশ অনুযায়ী অভিভাবক, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সকলের সহযোগী মনোভাব এর মিথস্ক্রিয়াই তৈরী হবে, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা তথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উন্নত সমৃদ্ধ দেশ, স্মার্ট বাংলাদেশ।
লেখক : প্রাবন্ধিক; অধ্যক্ষ, হুলাইন ছালেহ নূর কলেজ।