সময়ের কথন
অতীত সময়ের মূল্য ভিন্ন ভিন্ন। কারো কাছে অতীত মৃত। অধিকাংশ লোকের কাছে অতীত থেকে শেখার আছে– যা বর্তমান–ভবিষ্যতে চলার পথে কাজে লাগে। অতীত নিয়ে নাড়াচাড়া করেই বা কি লাভ? তারপরও সময়ের বহতা নিয়ে পৃথিবীর প্রায় ভাষাতেই কালজয়ী সাহিত্য রচিত হয়েছে। আমাদের বঙ্গসাহিত্যেও “আমার ছেলেবেলা” থেকে ‘সেই সময়’ অনেক অতীত কথন ভিত্তিক নামী–দামী সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে।
৭ দশকের জীবনকে আর কতই ভবিতব্যের দিকে নেওয়া যায়? তাই অতীতের জীবন, স্মৃতিকে শাশ্বত সমাজের আয়নায় স্থাপিত করার চেষ্টা।
আমাদের দেশে খুব কম সংখ্যক লোক বংশ তালিকা মেইনটেইন করে। যারা করে তারাও দু–চার–দশ পুরুষের নাম হয়ত রক্ষা করে। বংশ তালিকা জরুরীও নয়। তবে শ্বেত মানুষরা যথা–সম্ভব বংশ–তালিকা সংরক্ষণ করে। যেমন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার, ক্লিনটন–এরা প্রেসিডেন্ট হয়েই উত্তর আয়ারল্যান্ডে তাদের পিতৃপুরুষদের ভিটেয় বেড়াতে যান। বাংলা সাহিত্যের মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের বংশ তালিকা বিশেষ করে তার শ্বেতাংগিনী স্ত্রী হেনরিয়েটার সন্তানদের বংশ ক্রম অত্যন্ত যত্ন সহকারে সংগ্রহ করেছেন মধুসূদন গবেষক লন্ডন প্রবাসী গোলাম মুরশীদ সাহেব। তার মধুসূদন জীবনীর নাম “আশার ছলনে ভুলিয়া” এই বই প্রকাশিত হওয়ার পর পশ্চিম বাংলার সাহিত্য জগত গোলাম মুরশীদের পান্ডিত্যে বিস্মিত হয়।
চট্টগ্রামে হাটহাজারী থানার সন্নিকটে চারিয়া নামে এক গ্রাম আছে। সেখানে কাজী পাড়া নামে একটা পাড়া আছে। এই বংশের স্থানীয় যাত্রা শুরু করেন আবিদ কাজী নামে একজন উচ্চ বংশীয় কাজী। আবিদ কাজী তার আরও ৩ জন বন্ধু নিয়ে গৌড়ে মুসলিম শাসনের পতনের সময় পালিয়ে চারিয়া গ্রামে চলে আসেন। এটা সম্ভবতঃ ১৪–১৫ শতকের ঘটনা। বন্ধুকে ফারসী ভাষায় ‘ইয়ার’ বলে। চার ইয়ার (চার–বন্ধুর) এর অপভ্রংশ হিসেবে চারিয়া নামের উৎপত্তি। আবিদ কাজী গৌড়ের শেষ ‘কাজী’ (বিচারক ছিলেন)। ২০ শতকের শুরুতে এই কাজীর এক বংশধর হাটহাজারী নুর মসজিদ সংলগ্ন এলাকায় চলে আসেন। আরেকজন কাটিরহাটের পূর্ব হাধুরখীলে বসতি করেন। গৌড়ের কাজী আবিদের ২০তম বংশধর হাটহাজারী দারুল উলুমের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মৌলানা হাবিবউল্লাহ সাহেব। কাটিরহাটের ২০তম বংশধর ও সরকারী মফিদুল ইসলাম মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা রেংগুনের ব্যবসায়ী নজির আহমদ হেডম্যান। সেই সুবাদে আমাদেরও নামের আগে ‘কাজী’ প্রাপ্তি। বেশী লম্বা বলে আমি সংক্ষেপে কিউ.এম. লিখি।
হাটহাজারী মাদ্রাসার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মৌলানা হাবিবউল্লাহ সাহেবের নসবনামা আরো ১০০ পুরুষক্রম ঊর্ধ্বে গিয়ে কুরাইশদের ইবনে হিশামদের সাথে যুক্ত হয়েছে। প্রত্যেকের নামসহ এই বংশ তালিকা ‘মাশায়েখে চাটগাম’ নামে বইয়ে লিপিবদ্ধ। হাটহাজারী মাদ্রাসার বর্ষীয়ান হুজুরদেরকে আমি জিজ্ঞাসা করি এত লম্বা নসবনামা উনারা কোথায় পেলেন? ফার্সি ভাষায় লিখিত এই বংশনামা নাকি মোগলদের থেকে গৌড়ে, গৌড় থেকে চারিয়ায় আসে।
গৌড় ছিল বাংলার রাজধানী। এখানে বৌদ্ধ, পাল, সেন ও মুসলিম শাসকদের রাজধানী ছিল। অবিভক্ত বাংলার দীর্ঘতম সময়ের রাজধানী ছিল গৌড়। ভৌগলিকভাবে এই এলাকা বাংলাদেশের চাপাই নবাবগঞ্জ ও পশ্চিম বাংলার মালদাহ জেলায় অবস্থিত। রাজমহল থেকে ভাটিতে ৪০ কি.মি. দূরে গঙ্গার পশ্চিম তীরে গৌড়ের অবস্থান ছিল। তিন ধর্মের শাসকরা গৌড়কে ভাষা, সাহিত্য, কৃষ্টিতে এক অন্যতম নগর রূপে গড়ে তুলেন। ১৫০০ খ্রীস্টাব্দে পৃথিবীর অন্যতম জনবহুল শহর ছিল গৌড়। সমৃদ্ধির শীর্ষে ছিল বলে গৌড়ের আরেক নাম ছিল জান্নাতাবাদ। জহুরা কালী মন্দির, ফিরোজ মিনার, দাখিল দরওয়াজা, কদম রসুল মসজিদসহ অসংখ্য স্থাপনা কালের প্রবাহে শুধু ধ্বংস চিহ্ন নিয়ে গৌড় অঞ্চলে এখনো বিদ্যমান। তবে অযত্নের ছাপ সব স্থাপনাতেই দৃশ্যমান। আরবসুফী শাহজালাল তাবরিজী রসুল (সঃ) এর একটা পদচিহ্ন সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন। সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ তা গৌড় দুর্গে নিয়ে আসেন। তার পুত্র সুলতান নসরত শাহ ১৫৩০ সালে কষ্টি পাথরের বেদীর উপর রসুল (সঃ) এর পদচিহ্ন স্থাপন করে মসজিদের ভিতর সংরক্ষণ করেন। কদম রসুল মসজিদও গৌড়ের দর্শনীয় স্থান।
চারিয়ার কাজীদের একজন আরব পূর্ব পুরুষ আল–নাসের স্পেনের আলহামরা ও কর্ডোভার উমাইয়া আলহামরা কর্ডোভাতে উমাইয়ারা এক বিস্ময়কর সভ্যতা গড়ে তোলেন। যখন অক্সফোর্ড, কেমব্রিজের অস্তিত্ব ছিল না তখনো আলহামরা কর্ডোভাতে তাবৎ বিশ্বের জ্ঞান–পিপাসুরা সেখানে উচ্চতর জ্ঞান অর্জন করতে আসত।
ইতিহাসে কত গোত্র, কত বংশ কাল পরিক্রমায় হারিয়ে যায়। কিন্তু এটা একটা দৈব ঘটনা বলেই মনে হয় যে মাশায়েখে চাটগাম এর রচয়িতারা এত দীর্ঘ একটা বংশ–তালিকা সংরক্ষণ করেছেন। উল্লেখ্য যে–হাটহাজারী মাদ্রাসার বর্তমান প্রধান মুফতি খলিল সাহেব মৌলানা হাবিবউল্লাহ সাহেবের নাতি।
অতীতও কথা কয়। দীর্ঘ একটা সময় পরিক্রমায় কত মানুষ, তাদের কারো কথা লিখিত, কেউ নিশ্চুপে কবরে শায়িত। ইসলামের প্রথম শতক কৃচ্ছতার শতক ছিল। জাঁকজমক, জৌলুষ নিরুৎসাহিত মনে করা হত। উমাইয়ারা খেলাফতে এসে জাঁকজমক ও বিত্তকে প্রাধান্য দিতে থাকে। বর্তমানে সব মানুষই জৌলুষে মত্ত। কিন্তু কাজী বংশধারার মৌলানা হাবিবউল্লাহ নিতান্ত ‘ফকীহ টাইপের জীবন যাপন করেছেন। তার হাত দিয়ে রেংগুন থেকে অনেক পয়সা কড়ি দান আসত। কিন্তু তার জীবন কখনো বৈভবে ছিল না। এটাও এক অলৌকিকতা এই বংশের।
লেখকঃ প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, চিকিৎসক