মৃত্যু এক অনিবার্য নিয়তি যার কাছে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া মানবজীবনের অন্য কোন উপায় থাকে না। সাবেক মন্ত্রী, সাংসদ ডা. আফছারুল আমীনও মানব জীবনের সেই গন্তব্যে প্রস্থান করেছেন। তিনি একাধারে রাজনীতিবিদ, স্বাধীনতা সংগ্রামী, বীর মুক্তিযোদ্ধা, চিকিৎসক, শিক্ষাব্রতী, মানবপ্রেমি এবং সমাজহিতৈষী ছিলেন।
আফছারুল আমীন যদিও রাজনীতির মূলধারা থেকেই আবির্ভূত হয়েছিলেন, তথাপি চট্টগ্রামের রাজনীতিতে স্বতন্ত্র মহিমায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। চট্টগ্রামের আওয়ামী রাজনীতিতে আফছারুল আমীনের স্থান নির্ণয় করতে হলে তাঁর যে স্বতন্ত্র মহিমার কথা বলা হলো সেটা বুঝতে হবে। এই স্বাতন্ত্র্যই আফছারুল আমীনকে গড়পড়তা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ থেকে পৃথক করেছে। সেটা হলো তিনি কড়া ধাতের রাশভারি প্রকৃতির লোক ছিলেন। কঠোর শৃঙ্খলাপরায়ণ রাজনীতিবিদ, লঘু চিত্তের শিথিল চরিত্রের মানুষ ছিলেন না। অন্যায়কে অপছন্দ করতেন, অনিয়মের ঘোর বিরোধী ছিলেন। সততা ছিলো তাঁর চরিত্রের ভূষণ।
ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে দীক্ষা নিয়ে জাতীয় রাজনীতির মূল স্রোতধারা, যাকে আমরা বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতি হিসেবে শনাক্ত করতে পারি, তাতেই অবগাহন করে আফছারুল আমীন স্বাধীনতা সংগ্রামের পাঠ নিয়েছিলেন।
চট্টগ্রাম সিটি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে ১৯৬৭ সালে ডা. আফছারুল আমীন রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। তাঁর আপন ছোট চাচা সিরাজুল আমীন তখন সিটি কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি। বঙ্গবন্ধু’র ৬ দফা, ছাত্রদের ১১ দফাসহ বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে রাজপথের আন্দোলনে লড়াকু সৈনিক ছিলেন আফছারুল আমিন।
৬৯–এর গণঅভ্যুত্থান, ‘পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি’ পুস্তক বিরোধী আন্দোলনের সংগ্রামী মিছিল সমাবেশে তাঁকে দেখা যেত পুরোভাগে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাত থেকে মাতৃভূমিকে মুক্ত করার জন্য ডা. আফছারুল আমীন অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন। তখন তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ছাত্র। শহরের ঝাউতলা, টাইগারপাসসহ বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তানি সৈন্যদের হামলায় আহতদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করান। ওই সময়ে চট্টগ্রাম মেডিকেলে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান ছাড়াও তাদের অস্ত্র লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি।
আফছারুল আমীন ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭৭ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় তৎকালীন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের নির্দেশে গ্রেপ্তার হয়ে তিনি চট্টগ্রাম ও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কারাভোগ করেন। চট্টগ্রাম কারাগারে অবস্থানকালে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করে আমি ৭৫–এর ১৫ সেপ্টেম্বর বোয়ালখালী থানার রেঙ্গুরা স্টেশন থেকে গ্রেফতার হয়ে ডেটিনিউ হিসেবে চট্টগ্রাম জেলে বন্দী ছিলাম। সে সময় আমরা জেলখানায় রাজনৈতিক ক্লাস চালু করেছিলাম। আফছারুল আমীন আমাদের সঙ্গে রাজনৈতিক আলোচনা চক্রে অংশগ্রহণ করতেন।
১৯৮৩ সালে তিনি বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন, চট্টগ্রাম শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন । ১৯৮৪ সালে দক্ষিণ কাট্টলী ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহ–সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮৩ সালে সরকারি চাকরি ছাড়ার পর প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আত্মনিয়োগ করেন। এমবিবিএস পাস করে সরকারি চাকরিতে ঢোকার পর তাঁর পক্ষে প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ সম্ভব ছিলো না। স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সম্মেলনে তিনি সহ–সভাপতি নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে জড়িয়ে পড়েন নগর আওয়ামী লীগে। ১৯৯২ সালে নগর আওয়ামী লীগের সম্মেলনে তিনি ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৯২ সালে আফছারুল আমীন স্বাধীনতার স্বপক্ষের চিকিৎসক সমাজ হতে বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন, চট্টগ্রাম শাখার সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থী হন।
১৯৯৩– ৯৬ সাল পর্যন্ত পাহাড়তলী থানার আওতাধীন চট্টগ্রাম পশ্চিমাঞ্চলে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের পক্ষ হতে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবির আন্দোলনে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। চট্টগ্রামের রাজনীতিতে তিনি প্রয়াত সিটি মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর ভাবশিষ্য হিসেবে পরিচিত ছিলেন। আশির দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, বন্দর রক্ষার আন্দোলন, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের অসহযোগ আন্দোলনসহ বিভিন্ন সংগ্রামে তিনি মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে ভূমিকা পালন করেন। ১৯৯৭ সালে ডা. আফছারুল আমীন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন ।
ডা. আফছারুল আমীন তিনবার জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। প্রথম দুইটি নির্বাচনে পাঁচ লাখেরও বেশি ভোট পেয়ে সামান্য ভোটের ব্যবধানে হেরে যান। ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম–৯ (পাহাড়তলী, হালিশহর, খুলশী, ডবলমুরিং ও পাঁচলাইশ আংশিক) আসনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন না পেলেও তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয় করায়ত্ত করেন। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী তাঁকে প্রকাশ্যে সমর্থন দেন। সেবার তিনি প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তাঁর কাছে পরাজিত হন বর্তমানে বিএনপি’র কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান জনাব আবদুল্লাহ আল নোমান। নির্বাচনে জয়লাভের পর তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীত্ব্ব লাভ করেন। প্রথমে পান নৌ–পরিবহন মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রীর (৬ জানুয়ারি ২০০৯) দায়িত্ব। পরবর্তীতে দপ্তর বদল হলে তিনি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের (৩১ জুলাই ২০০৯ হতে ২০১৩) দায়িত্ব পান। ২০১৩ সালে আফছারুল আমীন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সহ–সভাপতি নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালে ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম–১০ (২৮৭) আসন হতে দ্বিতীয়বারের মত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং ২০১৮ সাল পর্যন্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি পদে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৬ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হতে তাঁকে আজীবন সম্মাননা প্রদান করা হয়। ২০১৮ সালে ১১তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম–১০ (২৮৭) আসন হতে তৃতীয়বারের মত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি পদে দায়িত্বরত ছিলেন। ২০১৯ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে সিন্ডিকেট মেম্বার পদে ভূষিত হন।
১৯৯১ সালে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে পতেঙ্গা হতে কাট্টলী পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়, জলোজ্বাসে লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিলো। পরে ঘূণিদূর্গত এলাকায় ব্যাপক আকারে ডায়রিয়া ছড়িয়ে পড়ে। বাত্যাপীড়িত মানুষের অসহায় অবস্থা প্রত্যক্ষ করে আফছারুল আমীনের প্রাণ কেঁদে উঠেছিলো। ডায়রিয়া রোগে কাতারে কাতারে মানুষকে মৃত্যুমুখে পতিত হতে দেখে তিনি বিচলিত হয়ে উঠেন এবং দুর্যোগপূর্ণ এলাকায় একাধিক ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন করে সেবা দান করেন। ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী জাপান সরকারের সহায়তায় জাতীয় অধ্যাপক মরহুম ডা. নুরুল ইসলামসহ উপকূলীয় অঞ্চলে ঘরবাড়ি নির্মাণে সহায়তা করেন।
আফছারুল আমীন তাঁর পিতা ডা. ফজলুল আমীনের মতই মানবতাবাদী ছিলেন। ডা. ফজলুল আমীন অসহায়, গরীব রোগীদের নাম মাত্র ফি–তে চিকিৎসা করতেন। কেউ যদি তাও দিতে অপারগ হতো, তাহলে তিনি বিনামূল্যে ব্যবস্থাপত্র দিতেন। দেওয়ানহাটে তিনি বসতেন। পরে তাঁর পুত্র আফছারুল আমীনও ডা. হয়ে সেখানে বসে রোগী দেখেছেন। বর্তমান শেখ মুজিব রোডের পশ্চিম পাশে আগ্রাবাদ, হাজিপাড়া, বেপারীপাড়া, পানওয়ালাপাড়া, দক্ষিণ কাট্টলী, হালিশহর প্রভৃতি বিস্তীর্ণ অঞ্চলের জনসাধারণের জন্য তিনি একাই ছিলেন রুগ্ন মানুষের বন্ধু, চিকিৎসক। আফছার পিতার মানবসেবার গুণটি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন।
রাজনীতি ও চিকিৎসা সেবা প্রদানের পাশাপাশি শিক্ষাখাতেও অবদান রেখেছেন আফছারুল আমীন। নগরীর দক্ষিণ কাট্টলী এলাকায় তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠে প্রাণহরি আমীন একাডেমি। এই একাডেমির অধীনে এবং এর বাইরেও একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।
ডা. আফছারুল আমীন ব্যক্তি জীবনে অত্যন্ত সৎ, নির্লোভ, নির্মোহ মানুষ ছিলেন। স্পষ্টভাষী মানুষ হিসেবে সবাই তাঁকে সমীহ করত। অত্যন্ত সাদামাটা জীবনযাপন করতেন। এমপি এবং সংসদীয় কমিটির সভাপতি হয়েও অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন। তাঁর নিরাপত্তার জন্য কোন গানম্যান রাখার প্রয়োজন মনে করেননি। কারণ তাঁর কোন শত্রু ছিলো না। তিনি গাড়িতে ব্যবহার করতেন না সংসদীয় কমিটির সভাপতি হিসেবে প্রাপ্য পতাকা। এমনকি গাড়িতে সংসদ সদস্যের স্টিকার পর্যন্ত লাগান নি।
পাঁচ বছর মন্ত্রী, প্রায় ১২ বছর ধরে এমপি। কিন্তু একটুও পরিবর্তন হয়নি তাঁর বাড়ি, অফিস–ঘর। দেওয়ানহাটের মোড়ের চেম্বারটা এখনো আগের মতো। জীর্ণশীর্ণ কক্ষ, পুরোনো পর্দা, নেই কোনো সাজসজ্জা। ছোট্ট এই অফিস ঘরও ছিলো বড় বেশি সাদামাটা। কেবল একটি অনাড়ম্বর টেবিল ঘিরেই তাঁর জগৎ।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে ডা. আফছারুল আমীনের ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়ে। প্রথমে তিনি সিঙ্গাপুর থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন। এরপর দেশে নিয়মিত চিকিৎসা নেন। চলতি ২০২৩ সালের ২ জুন কর্কট রোগের সাথে দীর্ঘ লড়াইয়ে হেরে যান ডা. আফছারুল আমীন। থেমে যায় একটি মহৎ জীবনের সংগ্রামী পথচলা।
শেষকথা : মাতৃগর্ভ থেকে সম্পূর্ণ নিষ্পাপ একটি মানবশিশু ভূমিষ্ঠ হয়। সেই শিশু বড় হয়ে একটি সম্পূর্ণ মানব জীবন অতিবাহিত করে যখন পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়, তখন তাঁর কর্মের মূল্যায়ন হয়। সে কী পঙ্কের মধ্যে বিচরণ করেও রাজহংসের মতো শুভ্র দেহে বেরিয়ে আসতে পেরেছে? না কি হিংসা, দ্বেষ, মলিনতা, পাপ, কৈবল্য, বিকৃতি স্পর্শ করে তার জীবনকে ক্লেদাক্ত করে ফেলেছিলো? এই বিচারে ডা. আফছারুল আমীন একজন অপাপবিদ্ধ মানুষ হিসেবেই নশ্বর জীবনকে অতিক্রম করে অবিনশ্বর অমৃতলোকে প্রবেশ করেছে। আফছারুল আমীন দ্বাদশ বর্ষকাল সংসদ সদস্য এবং পঞ্চবর্ষ ওজারতি করলেও কোন দুর্নীতি, অন্যায়, অনাচার করেননি। ক্ষমতার অপব্যবহার করে অর্থবিত্ত বা বিষয়–সম্পত্তি অর্জন করেননি।
লেখক : সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, সংস্কৃতি সংগঠক