রাজনীতি একটি খেলা – কে হারবে কে জিতবে, খেলা শেষে তা বোঝা যাবে
গণমাধ্যমের একজন সাংবাদিক আমাকে ফোন করেছিলেন। দেশের বর্তমান উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিষয়ে আমার মতামত জানতে চেয়েছিলেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে কলহ বিবাদ উত্তাপ ছড়াচ্ছে এই বিষয়ে সাধারণ মানুষের ধারণার সাথে আমি একমত। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে যে এই রাজনৈতিক উত্তাপ নিয়ে আশঙ্কার কোন কারণ নাই। যারা দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় আছে, তারা তাদের ক্ষমতায় থাকার জন্য তাদের কৌশল নির্ধারণ করবে। যারা দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার বাইরে আছে,তারা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তাদের কৌশল ঠিক করবে।
২০০৮ সালে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। তারপর তিন মেয়াদে সরকার পরিচালনা করছে। আওয়ামী লীগ তাদের দীর্ঘ শাসনামলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিপুল সাফল্য অর্জন করেছে। দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় দৃষ্টিভঙ্গিগত পরিবর্তন এনেছে। আগের সরকারগুলো বিদেশি দাতা এবং বিনিয়োগকারীদের উপরে অনেকাংশে নির্ভরশীল ছিল। জাতীয় বাজেটের একটি অংশ বিদেশি ঋণ, অনুদান ও বিনিয়োগকারীদের অর্থ থেকে আসত। ২০০৮ সালের পরে আওয়ামী লীগ সরকার ব্যক্তিগত খাতের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করে। আজকের বাংলাদেশের উন্নয়নের পেছনে ব্যক্তিগত শিল্প বিনিয়োগকারীদের অবদান উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশের সবচাইতে বেশি উন্নয়ন হয়েছে কৃষি খাতে। অতীতে বাংলাদেশ প্রান্তিক কৃষির উপর নির্ভরশীল ছিল। আওয়ামী লীগ সরকার প্রযুক্তির ব্যবহার উৎসাহিত করেছে এবং কৃষি বিষয়ক গবেষণা জোরদার করেছে। ভূমি ব্যবস্থাপনাও ডিজিটালাইজড করেছে। কৃষিতে পুঁজির বিকাশ ঘটেছে, যন্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে, নতুন নতুন ধরনের বীজ উদ্ভাবিত হয়েছে, সেচের সুবিধা বেড়েছে। কৃষকদেরকে সার্বক্ষণিক কৃষি বিভাগ থেকে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। কৃষি ক্ষেত্রে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও কৃষি বিষয়ক প্রতিষ্ঠানের গবেষকেরা অবদান রাখছে। খাদ্য উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ থেকে বিদেশে দক্ষ এবং অদক্ষ কর্মী প্রেরণের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশ বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে আগ্রহী হচ্ছে। এদিক থেকে বর্তমান সরকারের আমলে রেমিট্যান্স আয় অনেক বেড়ে গেছে। প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহারের কারণে ই–কমার্স ভিত্তিক ব্যবসা–বাণিজ্যের উন্নয়ন ঘটেছে। টেন্ডার প্রক্রিয়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভর্তি সহ অনেক কাজে অনলাইনের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনার ফলে সুশাসনের উন্নতি ঘটেছে। আওয়ামীলীগ রাজনৈতিক দল হিসেবে তার পক্ষে উন্নয়নের বিষয়টিকে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। আওয়ামী লীগ দাবি করছে যে জনগণ তাদের উন্নয়ন কার্যক্রমে সন্তুষ্ট এবং আগামী নির্বাচনে ব্যাপকভাবে তাদের ভোট দিবে। ২০২০ সালে করোনা মোকাবেলায় আওয়ামী লীগ সাফল্য দেখিয়েছে। অপরদিকে বিরোধী দল বিএনপি এবং তাদের সাথে যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত দলগুলি বলছে, আওয়ামী লীগ একটি কর্তৃতবাদী সরকার। তারা উন্নয়নের নামে মেগা প্রজেক্ট গ্রহণ করে মেগা দুর্নীতি করেছে। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অথবা নিরপেক্ষ সরকারের দাবি মানতে রাজি নয়। আওয়ামী লীগ বলছে সংবিধানে যেভাবে বলা আছে সেভাবে নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগ নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে। বিএনপি বলছে সরকারি দলের লোকেরা বিদেশে অর্থ পাচার করেছে। সরকারি দল রাষ্ট্রের কর্মচারীদের দলীয় কর্মীর মতো ব্যবহার করছে।
আওয়ামী লীগ দাবি করছে তারা সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করবে। নির্বাচনে কোন হস্তক্ষেপ সরকার করবে না। বিরোধী দল এবং বিরোধী জোট, আওয়ামী লীগের এ আশ্বাসে সন্তুষ্ট নয়। তারা আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ দাবি করছে। একসময় আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি করেছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে নানা জটিলতার সৃষ্টি হয়। আওয়ামী লীগ ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কার্যকলাপ এবং ২০০৬ সালে প্রেসিডেন্ট ইয়াজ উদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদ গ্রহণের কঠোর সমালোচনা করে।
পদ্মা সেতু নির্মাণ এবং দেশের যোগাযোগ ও সড়ক ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষকে আওয়ামী লীগের প্রতি আকৃষ্ট করে। মেট্রোরেলের কার্যক্রম পরিপূর্ণভাবে চালু হওয়ার ফলে সাধারণ মানুষ খুবই আনন্দিত। ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত এবং ঢাকা থেকে খুলনা পর্যন্ত সরাসরি রেল যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করেছে আওয়ামী লীগ। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় রেল যোগাযোগ অনেক সহজ হয়েছে। ফলে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে জনগণকে আন্দোলনে নামানো খুবই সহজ কাজ নয়। তবে সরকার বিরোধী দলগুলি নির্বাচনের আগে সরকারের বিরুদ্ধে কথাবার্তা বলবে না এটা গ্রহণযোগ্য নয়। যদি বিরোধীদল সহিংসতার পথ গ্রহণ না করে তাহলে সরকারের উচিত হবে বিরোধীদলকে তাদের কথাবার্তা বলতে দেয়া। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিরোধীদল সরকারের সমালোচনা করবে, এটি স্বাভাবিক নিয়ম। বিরোধীদলকে নিশ্চিহ্ন করার মনমানসিকতা গণতন্ত্র কখনো অনুমোদন করেনা।
আওয়ামী লীগের একটি বড় অভিযোগ হল বিএনপি এবং তাদের পক্ষ অবলম্বনকারী কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি বিদেশী শক্তির কাছে ধরনা দিচ্ছে। আওয়ামী লীগের বদনাম করার বিরোধীদল লবিস্ট নিয়োগ করেছে। কিছু কিছু বিদেশি রাষ্ট্রদূত নির্বাচন বিষয়ে নাক গলাচ্ছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনে সবচাইতে বেশি প্রভাব সৃষ্টি করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘোষিত ভিসা নীতি। এ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলেছে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে যেসব দল, ব্যক্তি বা সরকারি কর্মকর্তা হস্তক্ষেপ করবে, তাদের এবং তাদের পরিবারের সদস্যদেরকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা দেওয়া হবে না। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একটি অংশ মনে করে, বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতির উপরে প্রভাব বিস্তারের জন্য এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি কৌশল। আবার কোন কোন বিশ্লেষক মনে করেন, যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাবে না তাদের ভিসার কোন প্রয়োজন নাই। তাদের ক্ষেত্রে এই ভিসা নীতি কোন চাপ সৃষ্টি করতে পারবে না। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি আগামী নির্বাচনে কতটুকু প্রভাব বিস্তার করবে তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। বাংলাদেশ সরকার ভিসা নীতির ব্যাপারে স্পষ্টভাবে বলেছে যে তারা নির্বাচন কারচুপিমুক্তভাবে অনুষ্ঠান করবে। সুতরাং ভিসা–নীতিকে ভয় পাওয়ার কোন কারণ নাই। তবে গণমাধ্যমে আরও বিভিন্ন রকমের সংবাদ দেখা যাচ্ছে। আশঙ্কা প্রকাশ করে কেউ কেউ বলেছেন, এরপর কি আর কোন চাপ আসবে? বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে কোন বিদেশী শক্তি প্রভাব বিস্তার করবে কিনা তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। বিরোধী রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য সরকারের উপর গণআন্দোলন সৃষ্টির মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করলে, সেটাকে অস্বাভাবিক ব্যাপার বলার কোন সুযোগ নাই। আন্দোলনকারী দলকে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন করারও কোন দরকার নেই। কিন্তু ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন করার কোন পদক্ষেপ গ্রহণযোগ্য নয়। সুষ্ঠু এবং কারচুপিমুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠান সরকারের দায়িত্ব। আগামী নির্বাচনে কারা সরকারে যাবে জনগণ সেটা নির্ধারণ করবে।
নির্বাচনে যোগ্য প্রার্থীকে ভোট দিয়ে উপযুক্ত লোককে সংসদে পাঠানো জনগণের দায়িত্ব। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা সকল রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনের প্রধান দায়িত্ব হল সরকারের। সরকারকে কারচুপিমুক্ত নির্বাচন করতে হবে। রাজনৈতিক সংকট নিরসন করার দায়িত্ব বিরোধী দলেরও আছে। বিরোধী দল যদি নির্বাচন বয়কট করে, অথবা নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধা দেয়, তাহলে সংকট নিরসন হবে না। সর্বশেষ প্রশ্ন হল বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে, না বর্তমান সরকারের অধীনে হবে? এই প্রশ্নে সরকারি দল এবং বিরোধী দল একে অন্যের কাছ থেকে অনেক দূরত্বে অবস্থান করছে। এই দূরত্ব দূর না হলে সমস্যার সমাধান করা কঠিন হবে। সংঘাতের মাধ্যমে কেউ সমস্যা সমাধান করতে পারবে না। কেউ কাউকে নিশ্চিহ্ন করতে পারবে না। রাষ্ট্রের মালিক হচ্ছে জনগণ। বর্তমানে দেশের ভিতরে যে অর্থনৈতিক সংকট চলছে এই অবস্থায় জনগণের উপরে রাজনৈতিক সংকটের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষে উচিত হবে না।
রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংকট একত্রিত হলে তার জন্য বাংলাদেশের গরিব জনগণকে চরম মূল্য দিতে হবে। আমার ধারণা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট সম্পর্কে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং বুদ্ধিজীবী মহল সচেতনভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। আমরা একটা সুষ্ঠু নির্বাচন চাই যেন তাতে ভোটাররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের ভোট দিতে পারে। আমি মনে করি রাজনৈতিক দলের কোন নেতা নির্বাচনে নগ্ন হস্তক্ষেপ করবে না। সন্ত্রাসের মাধ্যমে নির্বাচন বানচাল করার চেষ্টা করবে না। দেশের অর্থনৈতিক সংকট, বিদ্যুতের ঘাটতি, পণ্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতি এসব বিষয় মাথায় রেখে রাজনীতিবিদদের কথাবার্তা বলার অনুরোধ জানাচ্ছি। মিষ্টি কথায় চিড়া ভিজবে সেই যুগ এখন বাসি হয়ে গেছে। কাল্পনিক আশ্বাস দিয়ে সাধারণ মানুষকে আশ্বস্ত করা যাবে না।
গণমাধ্যমের যে সাংবাদিক আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন উনাকে বললাম, আমার ধারণা নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে যে সংঘাত, তা সংলাপের মাধ্যমে সমাধান হয়ে যাবে। দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হবে এবং আমরা সবাই সেই নির্বাচনে ভোট দিতে পারব। রাজনীতি একটি খেলা। খেলায় কে হারবে কে জিতবে, খেলা শেষে তা বুঝা যাবে।
লেখক: প্রাক্তন অধক্ষ, সরকারি হাজী মোহাম্মদ মহসিন কলেজ, চট্টগ্রাম; শিক্ষাবিদ, কলাম লেখক।