কবি নজরুল তার সাহিত্য কর্মের শুরু থেকেই নারীর মুক্তির লক্ষ্যে কলম ধরেছিলেন। বাংলার সামাজিক জীবনে নারীরা যেমন উপেক্ষিত ছিল, সাহিত্যেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। নজরুলের ব্যক্তি জীবনের মত তাঁর কবিমানসেও বিশেষ স্থান দখল করে আছে নারী। নজরুলকে কবি নজরুল হিসেবে গড়ে তুলতে নারীর প্রেম বিরহ যে বিশেষ উপাদান হিসেবে কাজ করেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তৎকালীন সমাজে নারীদের অবদান স্বীকৃত ছিল না। নারীদের দেখা হত পরনির্ভরশীল দুর্বল হিসেবে। কিন্তু কবি নজরুল তার কবিতায় তুলে এনেছেন অমোঘ সত্য।
দ্বিধাহীন কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন সাম্যের বাণী– ‘সাম্যের গান গাই/আমার চক্ষে পুরুষ রমনী কোনো ভেদাভেদ নাই। বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণ কর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।’
নারীদের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠায় কবি নজরুল যে কতটা উন্মুখ অধীর ছিলেন তার চিত্র ফুটে উঠেছে ‘বারাঙ্গনা’ কবিতায়। এখানে কবি দাবী তুলেছেন ‘অসৎ মাতার সন্তান যদি জারজ হয়, তবে যারা অসৎ পিতা, তবে তাদের সন্তানও জারজ হবে’। অনৈতিকতার শাস্তি কেবল নারী পাবে, পুরুষরা তার ধারও ধারবে না, নজরুল ছিলেন তার ঘোর বিরোধী।
নজরুলের নারী বিষয়ক যে সব কবিতা রয়েছে তার মধ্যে ‘নারী’ কবিতাটি বেশ আলোচিত হয়েছিল। এই কবিতায় কবি চেয়েছিলেন নারীরা জেগে উঠুক। ভাঙ্গুক তাদের কয়েক‘শ বছরের ঘুম। শতাব্দীর পর শতাব্দী যে শিকল নারী বয়ে চলেছে তা ছুড়ে ফেলা হোক বহু দূরে। কাজী নজরুল তার গানে ও কবিতায়, গল্পে ও উপন্যাসে যুক্ত করলেন নারী মুক্তি জাগরণের কথা। তাঁব স্বকণ্ঠে প্রথম রেকর্ড করা হয়েছিল ‘নারী’ কবিতাটি। তাই বলা যায় তাঁর ধ্যান ধারনার মধ্যে নারী মুক্তির বিষয়টি খুব জোড়ালো ভাবে ছিল। নারীর বহুমুখী কাজের যে শক্তি সেটা যুগের পর যুগ উপেক্ষা করা হয়েছে। এই বলয়কে ভাঙতে চেয়েছেন কাজী নজরুল। তিনি যেভাবে অগ্রগামী চিন্তা ও চেতনায় স্বাক্ষর রেখে গেছেন, অন্য কোনো কবির সাহিত্য ও গানে তা আমরা কখনো পাইনি। কবির লেখার উৎস ছিল নারী, তা আমরা দেখি তার প্রথম স্ত্রী নার্গিসকে লেখা চিঠিতে। ‘তুমি এই আগুনের পরশ মানিক না দিলে, আমি অগ্নিবীনা বাজাতে পারতাম না। আমি ধুমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতামনা না।’ কবি নারীকে আকুল হয়ে ভালোবেসেছেন, তেমন নিদারুণ কষ্টও পেয়েছেন। তবুও নারীর বৈশিষ্ট্যে নিজেকে রাঙাতে চেয়েছেন।