দূরের দুরবিনে

অজয় দাশগুপ্ত

| রবিবার , ১১ জুন, ২০২৩ at ৫:২৭ পূর্বাহ্ণ

বিদেশী প্রভাব বনাম দেশের রাজনীতি

আমেরিকা এখনো স্বীকৃত এক নাম্বার দেশ হলেও তার জোয়ারে ভাটা পড়েছে । চীন ভারত রাশিয়া জাপান ব্রাজিলসহ আরো অনেক দেশের বিস্ময়কর অগ্রযাত্রা ও ইউরোপের ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ায় আমেরিকা সত্যি এক নাম্বার কি না তা নিয়ে মতবিরোধ থাকতেই পারে। শুরুতেই বলি আমেরিকা কিন্তু তারপরও আমেরিকা। কারণ তার অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র আর মেধার বিস্তার। এটা সবাই জানি দুনিয়া সেরা মেধা সেদেশে যায় আশ্রয় নেয়। অথবা সে দেশে থেকেই নাম্বার ওয়ান হয় কিংবা নাম্বার ওয়ান পদটি ধরে রাখার জন্য আমেরিকান হয়। এই যাত্রা পুরানো। একসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন বা পূর্ব ইউরোপের কমিউনিজম সে দেশগুলোর মানুষদের নাভি:শ্বাস তুলে দিয়েছিল। বস্তুত অবরুদ্ধ সেসব মানুষেরা সুযোগ পেলেই আমেরিকায় পাড়ি দিতো। অলিম্পিক বিজয়নী নাদিয়া থেকে আরো অনেক তারকাই আমেরিকা বেছে নিয়েছিলেন। তা ছাড়া জ্ঞান বিজ্ঞান খেলাধুলা সিনেমা সব বিষয়েই আমরিকা এখনো সেরা। আপনি হলিউড স্বীকৃত না হলে কিভাবে বড় অভিনেতা হবেন? হোয়াইট হাউসের প্রধানকে মানে না এমন দেশ বিরল। ইচ্ছে অনিচ্ছায় মানাটাই নিয়ম।

মজার বিষয় এই আমেরিকার ভূমিকা আমাদের মতো দেশের বেলায় সবসময়ই দুমুখী। সবচেয়ে বড় যে ভুল তারা করেছিল তা হচ্ছে একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও সংগ্রামকে অবহেলা করা। তারপর ছিল বিরোধিতা। পাকিস্তান আর আমেরিকা তখন হরিহর আত্মা। তাদের গলায় গলায় ভাব। আমরা যারা একাত্তর দেখেছি আমরা জানি কতটা ভয়ংকর রূপ ছিল আমেরিকার। তাদের তখনকার প্রেসিডেন্ট নিকসন আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিসিঞ্জার আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের দুশমন ছিলেন । সরাসরি না পারলেও হেন কোন কাজ নাই যা করে পাকিস্তানকে শক্তি যোগায় নি। শেষদিকে সপ্তম নৌ বহর ও পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল বঙ্গোপসাগরে। ভাগ্য ভালো তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল। ছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর মতো লৌহ মানবী। তাঁদের দূরদর্শিতা আর নেতৃত্বে আমেরিকা চীন পাকিস্তান পরাজিত হয়। একটা বিষয় দেখুন, চীন আর আমেরিকা চিরকাল সাপে নেউলে। অথচ আমাদের দেশের বিরোধিতার বেলায় তারা ছিল একজোট । আমেরিকা একাত্তরে পরাজিত হলে ও পঁচাত্তরে ছোবল মারতে পিছ পা হয় নি। উপমহাদেশে তার পরাজয়ের গ্লানি আমেরিক ভুলতে পারে নি আজো।

আর একটা মজার বিষয় হচ্ছে আমেরিকার গণতন্ত্র আর দেশটির প্রভাব। আমেরিআকর সাথে সরাসরি যুদ্ধ করে আমাদের চেয়ে বেশী লোকসান আর মৃত্যুর রেকর্ড নিয়ে স্বাধীন হয়েছে ভিয়েতনাম। আমেরিকা ভিয়েতনামে নাপাম বোমা মারতে ও দ্বিধা করে নি। ভিয়েতনামের জাদুঘরে দেখেছি বোমা হামলার পর নগ্ন শরীরে ছূটে যাওয়া মানুষের বীভৎস করুণ সব ছবি। অথচ সে আমেরিকার সাথে বন্ধুত্ব করার জন্য মুখিয়ে আছে ভিয়েতনাম। সে দেশে গিয়ে দেখলাম চীনের প্রেসিডেনহত আসছে বলে না আছে কো উৎসাহ না কোন উল্লাস। সব নিয়মমাফিক আয়োজন। অথচ ওবামা আসবেন শুনেই তাদের কি উল্লাস। এটাই আমেরিকা । আমরা চাই বা না চাই তাদের এড়িয়ে চলা অসম্ভব। আমাদের দিকে তাকালেও বুঝতে পারা যায়। দেশ স্বাধীন হয়েছিল ঘোর আমেরিকা বিরোধিতার মাধ্যমে। সে বিরোধিআত কি টিকলো? দেশে তখন সমাজতন্ত্র প্রায় আসি আসি অথচ তিয়াত্তর থেকেই শুরু হয়ে গেছিল আমেরিকা যাত্রা।

আজ এত বছর পর আমেরিকার বিরোধিতা আবার নানা কারণে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে। এইসব কথাগুলো বললাম এই কারণে নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে ততো ই জটিল হয়ে উঠছে পরিবেশ। প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন, এবারের নির্বাচন সহজ কিছু হবে না। তাঁর প্রজ্ঞা আর মেধায় এগিয়ে চলা দেশের কথা তাঁর চেয়ে ভালো কে জানে? সবাই জানেন দেশের মানুষ রাজনীতি বিষয়ে যতটা সচেতন তার চেয়ে অধিক বাইরের বাংলাদেশী । তারা দেশ ছেড়ে এলেও তাদের ধ্যানে জ্ঞানে সবসময় স্বদেশ। এই স্বদেশপ্রেম একদিকে যেমন দেশ ও প্রগতির সহায়ক, আরেকদিকে এর সাথেই বাড়ছে জন্‌জাল। আওয়ামী লীগের আমলে যাবতীয় উন্নয়ন ভোগ করা বাঙালির একাংশ মজে আছে দেশ বিরোধিতায় সরকার বিরোধিতা ও দেশ বিরোধিতা এক করে ফেলেছে এরা। আজকাল বাড়িতে বাড়িতে ডিনারের পর লাঞ্চের পর আলোচনা মানেই সরকার বিরোধিতা। এই কাজগুলো যারা করে তারাই দেশের সুবিধাভোগী। তাদের আত্মীয় স্বজনেরাও দেশে আছে মোটামুটি ভালো। তারপর ও মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধু শেখ হাসিনার বিরোধিতা না করলে তাদের ভাত হজম হয় না।

ডিজিটাল যুগে সবাই একেকটি মিডিয়া। এই সামাজিক মিডিয়ার যুগে এর আর্শীবাদ ও অভিশাপ আজ আমাদের চোখের সামনে । বিদেশে নিরাপদ ভূবনে বসবাসরত বাঙালির এক অংশ সরকার বিরোধিতার নামে যা খুশী বলার প্রতিযোগিতা ও নোংরামীতে রেকর্ড করার পথে। এদের ওপর নজরদারী বা নিয়ন্ত্রণ নাই। ফলে সব মিলিয়ে দেশের বাইরে জটিল এক সমীকরণে আছে মিনি বাংলাদেশগুলো ।

ভালো কাজের ফলাফল জমা হয় প্রগতির ঘরে । যার অভাবে আজ আমাদের সংস্কৃতির নাভি:শ্বাস উঠছে । দেশের বাইরে যে অপপ্রচার দেশ বিরোধী বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী তৎপরতা তাকে রুখতে সোজা সাপটা বাঙালির দরকার । আমি এটাও বলব ছোট ছোট বিষয়ে আত্মঘাতী প্রচার বা বিরোধিতার অবসান না হলে দেশের বাইরে দেশের সঠিক রাজনীতি গতি পাবে না। মজার ব্যাপার এই বিএনপি জামাত কিংবা আওয়ামী বিরোধীদের বেলায় নিশ্চুপ বা চুপ থাকা যারা নিজেদের মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন তারা জানেন না তাদের জন্য কি লোকসান হচ্ছে বা কতটা বিপদ হতে পারে ।

মোট কথায় নির্বাচন যখন ঘনিয়ে আসছে তখন সাবধানতার বিকল্প নাই। আওয়ামী লীগের শক্তি সাহস বা দেশ শাসনে উন্নয়নের দিক বিবেচনা করলে তাদের জয়লাভ করা ব্যাপার কিছু নয়। কিন্তু বাস্তবে পরিস্থিতি ভিন্ন। বিএনপির আসন এখনো জনমনে শক্ত। বিরাট এক অংশ তাদের দিকে ঝুঁকে আছে। মাঝখানে বিশ্বমন্দা কোভিড আগুন বাজারে আগুন সব মিলিয়ে সরকারের জন্য সময়টা সুখকর কিছু না। এখন তো ভয়াবহ গরম আর বিদ্যুৎ সংকটে মানুষের ত্রাহি ত্রাহি হাল। বিরোধী দল মাঠে ময়দানে সে সুযোগ নিতে না পারলেও ষড়যন্ত্রে এগিয়ে। বলাবাহুল্য শেখ হাসিনা থাকার কারণেই বারবার বেঁচে যাচ্ছি আমরা। সে জায়গায় নিজেদের ভেতর বিরোধ বা দেশের বাইরে পরিবেশ আওয়ামী বিরোধীদের হাতে তুলে দেয়া আত্ম হননের নামান্তর। একটা কথা মনে রাখতে হবে গঠনমূলক বিরোধিতা আর সমালোচনাই এগিয়ে রাখে। বাংলাদেশের রাজনীতি সেটা জানে। বঙ্গবন্ধু তাজ উদ্দীন সৈয়দ নজরুল, শেখ হাসিনা থেকে সৈয়দ আশরাফ তার সেরা উদাহরণ। এরা সমালোচনা সহ্য করতে করতে নিন্দা গালমন্দ শুনতে শুনতে কবেই তার আওতার বাইরে পৌঁছে গেছিলেন বা গেছেন নিজেরাই টের পান নি। তাঁরা সহ্য করতেন এবং করেন। যারা সহ্য করতে জানে না তাদের মাঠ পর্যায়ে থাকাটাও আশংকার।

আবারো বলি দেশের বাইরে প্রান্তিক ক্ষমতা সম্পন্ন বাংলাদেশীদের উচিত নির্বাচনের আগেই নিজেদের অবসহান পরিস্কার করে ঐক্যে থাকা। তারা তাদের আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধব সহ সবাইকে উদ্দীপ্ত করবেন। নিজেদের আদর্শের প্রচার করবেন বা মানুষকে উন্নয়ন ও প্রগতির কথা বলবেন। আর যারা একটু অগ্রসর তারা চাবুক মেরে হলেও দলের ভেতরের ময়লা জন্‌জাল ধরিয়ে দেবেন। যেসব বিষয়ে মানুষের রাগ সেসব সেনসিটিভ বিষয় নির্বাচন বা ভোট নিয়ে খোলামেলা সমালোচনার মাধ্যমে পথ সুগম করে তুলবেন। সেটা না করে বিদ্বেষ আর আবেগ ও অতিভক্তির আতিশয্যে যেন নিজেদের পায়ে কুড়াল মারার কাজটি করা না হয় ।

মনে রাখতে হবে শেখ হাসিনার বিকল্প নাই: তাঁকে ঘিরে আবর্তিত দেশের রাজনীতি বিদেশের বা বিদেশীদের কুনজরে পড়লে দেশ ও জাতির কপালে দুঃখ আছে। বিদেশীদের হাতে যেন না যায় রাজনীতি। সে কারণেই আওয়ামী লীগের শুদ্ধি অভিযান আর প্রবাসে অতি আবেগীদের কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।

লেখক : সিডনি প্রবাসী কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধশিল্পকলায় ঠিকানার খোঁজে ১২ ও ১৩ জুন