লাঠ্যৌষধিই মহৌষধ!
এমনিতে খাবার দাবারের ব্যাপারে তেমন কোনো আগ্রহ না থাকলেও, নানান নতুন নতুন বিদেশী খাবারের ব্যাপারে তুমুল আগ্রহী দীপ্র, তার খায়েশ জানাতেই, অনিবার্যভাবে মা তার ধমকে উঠলো– ‘না কোনো দরকার নেই। অযথা একগাদা টাকা নষ্ট করে ওইরকম অখাদ্য খাওয়ার।’
এতোক্ষণ বেইজিঙের পাখির বাসার চত্বরে তীব্রহীম বাতাসে নাকাল হয়ে একটু আগেই গাড়ির পেটের মধ্যে ঢুকে উষ্ণতার আরাম পেয়ে যুৎ হয়ে বসতে না বসতেই, এ মুহূর্তে গাড়ির পেছন দিকের আবহাওয়া যেরকম গরম হয়ে উঠছে দেখছি, প্রমাদ গুনলাম তাতে আপন মনে।
আমাদের সমাজে যাকে বলে মুরুব্বীদের মুখে মুখে কথা বলা, কিশোর বয়সের অনিবার্য হরমোনের প্রাকৃতিক প্রভাবে দীপ্রর মধ্যে তা প্রকাশিত হচ্ছে অহরহই বেশ কিছুকাল ধরেই। প্রায়শই সে বিশেষত মায়ের সাথে, নানান কিছু নিয়ে জড়িয়ে পড়ছে দ্বৈরথে। যদিও দেখেছি কথা বলার সময়, ও যুক্তি দিয়েই নিজের মত প্রতিষ্ঠা করতে চায়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমাদের হাড়ে মজ্জায় ঢুকে আছে যে সংস্কার, তাতে মুরুব্বিদের কাছে ছোটদের যে কোনো যুক্তি, হোক তা যতোই যৌক্তিক; পাত্তা পায় না মোটেই। সেটাই ঘটে মা পুত্রের দ্বৈরথেও। তাতে চড়ে যায় পুত্রের গলা, যা নাকি আবার হয়ে দাঁড়ায় চরম বেয়াদবির নামান্তর। এরকম অবস্থায় পড়লে নিজের অবস্থা হয় আমার, ত্রিশংকু। না পারি মুরুব্বী সংস্কৃতিকে সেলাম করে সরাসরি মায়ের পক্ষ নিতে। না পারি যুক্তির পক্ষাবলম্বন করে মায়ের বিপরীতে পুত্রের পক্ষাবলম্বন করতে। কারণ, মায়ের কাছে তার অনুবাদ হবে, বেয়াদবিকে প্রশ্রয় দেয়া। যা করতে হলে আবার ঘাড়ে আমার রাবনের মতো শুধুই দশটা না আরো অনেক অনেক মাথা থাকা দরকার। আবার যদি থাকি চুপচাপ নিরপেক্ষ, তাতেও বাড়তে থাকে উত্তাপ ক্রমশ। মোটকথা হলো, ত্রিশংকু অবস্থা বলতে যা বোঝায় আমদের ভাষায়, অভিধান পড়ে তা কক্ষনো হৃদয়ঙ্গম করতে না পারলেও, পারিবারিক এ ধরনের নানান ঘটনায় বুঝেছি তা হাড়ে হাড়ে বারে বারে, যার মুখোমুখি হতে চাই না কখনোই আমি একেবারেই। কিন্তু এইমাত্র মায়ের কাছ থেকে আসা ঐ ধমক, সেরকমই একটা পটভূমি তৈরি করেছে। অতএব পরিস্থিতি লাগাম দ্রুত টেনে ধরার মানসে, কাত হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে গাড়ির পেছনের যাত্রিদের উদ্দ্যেশে বললাম– শোন শোন, ওটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কোনো কারণ নেই। জানিই না তো ঐ স্যুপ কোন হোটেলে পাওয়া যায়। তবে যা তা হোটেলে যে, এ বহুমূল্য স্যুপ পাওয়া যায় না, তা জানি। আচ্ছা অভ্র তুমি তো আগে একসময়, মানে আরো ছোট ছিলে যখন, তখন নানান অদ্ভুত ঘরবাড়ি আঁকতে; মনে আছে? সে সময় যখনই জিজ্ঞেস করতাম কেন ঐ বাড়িটা ঐরকম এঁকেছো? তুমি বলতে ওটা ফিউচারিস্টিক বাড়ি, তাই ওটা এমন। পাখির বাসার ডিজাইনে বানানো এই স্টেডিয়ামটাও কিন্তু ঐরকমই ফিউচারিস্টিক ডিজাইনের।
‘তাই নাকি?’
‘কী রকম ? কী রকম?’
দীপ্র ও অভ্রের এরকম তুমুল কৌতূহলে বোঝা গেল, কেটেছে ফাঁড়া। সঠিক সময়ে আলোচনা ঘুরিয়ে দেবার টেকনিকটা কাজে লেগেছে। ফলে আর দেরী না করে দ্রুত বলতে শুরু করলাম
প্রথমত এটা হল নাকি, এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে স্টিল দিয়ে যতো কিছু বানানো হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় স্ট্রাকচার। সুইচ টিপে দিয়েই নাকি এটির উপরে ছাদ প্রয়োজনে খোলা বা বন্ধ করা যায়! তবে ফিউচারইস্টিক হবার জন্য সেটাই বড় কথা না। বড় কথা হচ্ছে এটাকে এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, যাতে এতে যেমন দিনের বেলায় সূর্যের আলো প্রচুর ঢুকতে পারে, যাতে বাড়তি কোনো আলো জ্বালাতে না হয়। এছাড়া দিনের বেলার ঐ সূর্যের আলো থেকে ইলেক্ট্রিসিটি তৈরি করার জন্যও অসংখ্য সোলার সেল বসানো আছে এতে।
‘হুম বুঝতে পারছি এটাতে রিনিউয়েবল এনার্জি তৈরি হয়’ বিজ্ঞের মতো দীপ্র ফোঁড়ন কাটতেই পুত্র গৌরবে আনন্দিত হয়ে বললাম, একদম ঠিক বলেছ বাবা। এছাড়া আরো আছে। এই যেমন স্টেডিয়াম পরিষ্কার রাখা, ও ঠাণ্ডার সময়ে এটিকে গরম রাখার জন্য কিম্বা গরমের সময়ে ঠাণ্ডা রাখার জন্য এটিতে বৃষ্টির পানি ব্যবহার করা হয়। আর তা করার জন্য বৃষ্টির সময়ে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য ঐ এলাকায় বিশাল লেইক বানানো হয়েছে। সেই লেইকে জমা বৃষ্টির পানি, রিফাইন করে যেমন খাওয়ার পানি তৈরি করা হয়, তেমনি অসংখ্য পাইপ দিয়ে ঐ পানি স্টেডিয়ামের ভেতরে এমন কি মাঠের মাটির নিচেও সাপ্লাই করে, গরমের সময় মাঠ ও স্টেডিয়ামকে ঠাণ্ডা রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
‘ওয়াও ! আচ্ছা বাবা এটা কি আসলেই চায়নিজরা বানিয়েছে?’
সন্দেহমিশ্রিত অভ্রের এবারের এই প্রশ্নে, ফের বোঝা গেল চায়নিজদের সক্ষমতা নিয়ে তার সন্দেহ এখনো যায়নি। সেই যে কুনমিং এ রোলস রয়েস আর ফেরারি দেখে প্রথমে তুমুল উত্তেজিত হলেও, পড়ে ঠিকই জিজ্ঞেস করেছিল ওগুলো কি আসল? নাকি চায়নিজ? তার মনের সেই দ্বন্দ্ব এখনো ঘোচেনি।
হাসতে হাসতে বললাম কেন বাবা এখনো তোমার এরকম মনে হচ্ছে? এ ক’দিনে তো, সেই হাজার হাজার বছর আগে বানানো এদের চমৎকার সব জিনিষ দেখলে। আবার আজই তো, অত্তো বড় গ্রেট ওয়ালটাও দেখলে। এসবই তো এরা নিজেরাই বানিয়েছে ! তাও এখন না, অনেক আগে। তাতেই তো বোঝা যায় অনেক আগে থেকেই কিন্তু চায়নিজরা খুবই বুদ্ধিমান ছিল। আচ্ছা, তোমাদের কি বলেছিলাম যে, এরাই কিন্তু এই পৃথিবীতে প্রথম কাগজ, ছাপাখানা, কম্পাস, বারুদ, কাগজের টাকা এসব আবিষ্কার করেছিল। তবে হ্যাঁ এই স্টেডিয়ামটি তোমরা যেটাকে ফিউচারিস্টিক ডিজাইন বল, সেরকম বানাতে গিয়ে অবশ্যই তারা একা বানাতে পারেনি। এটি বানাতে পাঁচ বছর ধরে সুইজারল্যান্ড, ইংল্যান্ড, আমেরিকা ও চায়নার নানান কোম্পানি কাজ করেছে। এটির মূল ডিজাইন করেছেন সুইজারল্যান্ডের দুইজন আর্কিটেক্ট, নাম মনে করতে পারছি না ওদের এখন। তবে ঐ দুইজনেরই বস ছিল কিন্তু, একজন চায়নিজ আর্কিটেক্ট। মজার কথা কি জানো বাবারা, আমার কোম্পানির হেড কোয়ার্টার সুইজারল্যান্ডের যেই বাসেল শহরে,ঐ দুই সুইস আর্কিটেক্টও কিন্তু ঐ শহরেরই।
‘অভ্র, অভ্র, ঐ যে দেখো, বি এম ডব্লিউটা! এবার কিন্তু তুমি আর বলতে পারবে না যে ওটা তুমি আগে দেখেছ, বুঝলে?’ দীপ্রর এ কথায় পাখির বাসা নিয়ে, নিজের নানান সময়ের আধখেঁচড়া পড়ার স্মৃতি আর হোটেল থেকে দেয়া বুকলেটের বদৌলতে পাওয়া তথ্যে এরই মধ্যে আমার বিদ্যার জাহাজ যতোটুকু ভরে উঠেছিল, সুযোগে পেয়ে তা থেকে যে জ্ঞান বর্ষণ করছিলাম তাতে বাঁধা পড়তেই, মেজাজ একটু খিচড়েই গেল।
একেতে তো সামনের সিটে বসে বেমক্কাভাবে কাত হয়ে পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে কথা বলতে গিয়ে যেমন ঘাড়টা টন টন করছে, তেমনি কাঁধের পেশিতেও পড়েছে টান। হঠাৎ করেই পুত্রদের বিষয়ান্তরে চলে যাওয়াটাই নয় শুধু, মেজাজ খিচড়ে দেবার ব্যাপারে শরীরের এই অস্বস্তিও কম দায়ী নয়, এ কথা বুঝলেও, তা ছাপিয়ে মনে হল, এতো কষ্ট করে ওদের একটু জ্ঞান দিতে চেষ্টা করলাম আর তা কি না বিফলে গেল বাইরের রাস্তায় হঠাৎ কোনো এক বি এম ডব্লিউ গাড়ির দেখা পেতেই! নাহ, এরকম আচরণকে প্রশ্রয় দেয়া তো মোটেই ঠিক নয়! দেবো নাকি মৃদু করে হলেও একটা ধমক ওদের?
আরে রাখো তোমার জোর করে জ্ঞান বিতরণ করা! জানো না, জোর করে জ্ঞান গেলানো যায় না? বলে উঠলো সাথে সাথেই এসময় মনের দ্বিতীয় জন। তবে থামল না সে তাতেই। বরং বলতে লাগল, শোন এ ব্যাপারে জোরের কোনো জায়গা নেই। যদিও আমাদের দেশে এমনকি জানি এই চায়নার সংস্কৃতিতেও বাচ্চাদের জ্ঞানার্জনে বাধ্য করার ব্যাপারে লাঠির কোনো বিকল্প নেই বলেই মনে করা হতো একসময়। জ্ঞান বিতরণের ক্ষেত্রে শিক্ষক আর বেত এ দুটি, আমাদের সমাজে যেমন ছিল একে অন্যের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে, ছিল তেমনি তা চায়নাতেও। তবে হ্যাঁ, সে ব্যাপারটি ইদানীং আমাদের দেশে যেমন বদলেছে, এখানেও তেমন ঘটেছে কি না, তা তো জানি না ! তবে জানি জাতি হিসাবে চায়নিজরা কাউকে দিয়ে কিছু করানোর ব্যাপারে লাঠির উপর যে ভরসা রেখেছিল শত শত বছর ধরে, মাও থেকে শুরু করে কম্যুনিস্ট পার্টির তাবৎ নেতারাই রাজনীতিতে তা অত্যন্ত সুচারুরূপে কাজে লাগালেও শুনেছি স্কুলে বেতের প্রয়োগ নাকি নিষিদ্ধ করেছিল বেশ আগেই। তারপরও তা নাকি পুরোপুরি উঠে যায়নি অনেকদিন। এখন যখন তারা অর্থনীতিতে পুঁজির বেধড়ক রকমের কৌশলী চর্চা করছে আর ফ্যাশনের ব্যাপারে আম্রিকান ধাঁচ আত্মস্থ করছে বেদম দ্রুত, একই রকমভাবে শিক্ষায় তারা বেতকে এক্কেবারেই নির্বাসন দিয়েছে কি না তা জানি না। ঘটনা আদতে যাই হোক, মনে মনে কিন্তু এখনো আমার মনে এটাই গেঁথে আছে যে, চায়নিজদের কাছে লাঠ্যৌষধিই মহৌষধ।
এসব ভাবতে ভাবতে, অবশেষে মনোযোগ আর চোখযোগ একই সাথে উইন্ডশিল্ডের বাইরে নিবন্ধ করতেই দেখি এরই মধ্যে রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে বেশ। কপালগুনে জ্যামে যে পড়িনি এখনো, তাতেই বেঁচে গেছি। লি খাঁ চালাচ্ছে গাড়ি একটানা একই গতিতে। যদিও বুঝতে পারছি খুব জোরে চালাচ্ছে না সে, আবার এই রকম শহরের ভেতরের মোটামুটি যাকে বলা যায় গাড়িসঙ্কুল রাস্তা, তাতে হয়তো গতিসীমা নির্ধারিত থাকাতেই রাস্তার অন্যান্য গাড়িগুলোকেও খুব জোরে ধেয়ে যেতে দেখছি না। তারপরও অকারণ কৌতূহলে কাত হয়ে, হেলে, লি খাঁর হাতে ধরা স্থির স্টিয়ারিঙয়ের ফোকড় গলে, ড্যাশ বোর্ডে নজর ফেলতেই দেখি, স্পিডোমিটারে কাঁটা ৬০ কিমি এর ঘরে দাঁড়িয়ে কাঁপছে সামান্য। অন্যদিকে চি চি করে বাজছে কোন, গানও ড্যাশবোর্ডে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ সাহিত্যিক