সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্র থেকে অসহিষ্ণুতা দূর করতে হবে

| রবিবার , ১১ জুন, ২০২৩ at ৫:২২ পূর্বাহ্ণ

আমরা সম্ভবত ভুলেই বসেছি যে, সহনশীলতা মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের একটি মহৎ গুণ। সহনশীলতা অর্থ সহ্য করার ক্ষমতা। প্রতিকূল অবস্থায় নিজের আবেগ ও উচ্ছ্বাসকে দমন করা, শক্তি থাকা সত্ত্বেও প্রতিশোধ গ্রহণ না করে ধৈর্যধারণ করাই হলো সহনশীলতা। ইদানীং ব্যক্তি জীবন, পারিবারিকরাজনৈতিকসামাজিকপেশাগত জীবন তথা সর্বক্ষেত্রে সহ্যহীনতা ও অসহিষ্ণুতা বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। বেড়ে গেছে খুন, মারপিট, হিংসাবিদ্বেষ। সংঘটিত হচ্ছে চাঞ্চল্যকররোমহর্ষক অপরাধ। দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত কয়েকটি খবরে আমরা রীতিমত উদ্বিগ্ন। ৯ জুন প্রকাশিত খবরে জানা যায়, সিনিয়রের সামনে সিগারেট খাওয়া নিয়ে দ্বন্দ্বে পটিয়ায় স্কুল ছাত্রকে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। জানা গেছে, সিনিয়র ও জুনিয়র বন্ধুদের উপস্থিতিতে আবদুস সোবহান রাহাত আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের এক ছাত্রের সাথে সিগারেট খাওয়া নিয়ে পটিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র ও উপজেলার শোভনদন্ডী ইউনিয়নের হিলচিয়া গ্রামের নুরুল ইসলামের ছেলে মো. তাবিবুল ইসলামের বড় ভাই আশরাফুল ইসলাম তৌকিরের নেতৃত্বে ৮/১০জন কিশোর গ্যাং সদস্য ভিকটিমের বাড়ির পাশে আসে। এসময় কিশোর গ্যাং সদস্য পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ড গোবিন্দার খিল আমির ভান্ডার এলাকার মো. বাচনের ছেলে চৌধুরী বাবুর হাতে থাকা ছুরি দিয়ে আজাদ হোসেনকে আঘাত করা হয়। পরে তাকে স্থানীয়রা উদ্ধার করে পটিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেঙে নিয়ে গেলে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তার উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করেন।

অন্যদিকে, মোবাইল ব্যবহার করতে মানা করায় শিক্ষকের মাথা ফাটিয়ে দিল তাঁরই ছাত্ররা। স্থানীয় সূত্র জানায়, কতিপয় ছাত্রকে মুঠোফোন ব্যবহার করতে নিষেধ করায় তারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওই শিক্ষকের উপর রাতের আঁধারে হামলা করে। স্থানীয়রা ওই শিক্ষককে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে ফটিকছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙে ভর্তি করে।

আরেক খবরে জানা যায়, পতেঙ্গায় খাবারের দোকানি ও তার কর্মচারীর মারধরে মো. আলমগীর নামের এক ভাসমান পানসিগারেট বিক্রেতার মৃত্যু হয়েছে। ৮ জুন রাতে পতেঙ্গার চরপাড়া সৈকত এলাকায় এই ঘটনা ঘটে।

পতেঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আফতাব হোসাইন বলেন, চরপাড়া সৈকত এলাকার এক ভাতের হোটেল মালিকের সঙ্গে আলমগীরের কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে তারা মারামারিতে জড়িয়ে পড়েন। এসময় ওই হোটেল মালিক ও তার কর্মচারী মিলে আলমগীরকে মারধর করেন। পরে তিনি জ্ঞান হারালে স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

এসব ঘটনায় সহজেই অনুমান করা যায় যে, বাংলাদেশের মানুষ ক্রমশ অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছে। সামাজিক জীবনের ঘটমান বাস্তবতায় সামগ্রিক ভাবে এই অসহিষ্ণুতার প্রসঙ্গ ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। স্পষ্টত বলা যায়, ‘মানুষের জীবনে সহিষ্ণুতা ও অসহিষ্ণুতার ভারসাম্য যথাযথভাবে রক্ষিত হচ্ছে না। পাশাপাশি বৃহত্তর সমাজের সর্বত্রই চাপা উত্তেজনা ও অসহিষ্ণুতা কারণে প্রায়শই মানুষের স্বাভাবিক আচরণ ও কার্যক্রমসমূহ প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে’। সামাজিক মূল্যবোধ কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছেতা ভাবতে গেলেই শিউরে উঠতে হচ্ছে। এই প্রবণতা কতটা বিপজ্জনক, তা ধারণার বাইরে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্রমক্ষয়িষ্ণু ভঙ্গুর অবক্ষয়গ্রস্ত, অসভ্য, নিষ্ঠুর ও অমানবিকতার ঘেরাটোপে বন্দি আমাদের সমাজব্যবস্থা। মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের একপাক্ষিক দাবি পরাজিত এই অসভ্যতায়। অবক্ষয়ের তলানির দিকে ক্রমধাবমান সমাজ, সমাজব্যবস্থা। এই হিংসা, সহিংসতার স্থায়ী সমাধান জরুরি। তা না হলে আমাদের রক্ষা নেই। এজন্য পরিবারকে দায়িত্ব নিতে হবে, সমাজকে দায়িত্ব নিতে হবে; দায়িত্ব নিতে হবে রাষ্ট্রকেও।

আমাদের মনে রাখা জরুরি যে, সহনশীলতা বিশেষ একটি গুণ। একটি সামাজিক মূল্যবোধ। এই সহনশীলতার ওপর নির্ভর করে সমাজের স্থিতিশীলতা। স্থিতিশীলতা না থাকলে সহনশীলতাও আর থাকতে পারে না। মানুষ যতই এগিয়ে যাচ্ছে, ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে তার জ্ঞান। আবার ততই তার মধ্যে বৃদ্ধি পাচ্ছে অস্থিরতাও। মানুষের ভেতরে কেমন জানি চাহিদা বেড়ে গেছে। সারাক্ষণই কেবল পাওয়ার আশা। ফলে তার মধ্যে চাওয়াপাওয়ার তীব্রতা বাড়ছে। বাড়ছে মনের মধ্যে প্রচণ্ড চাপ। আর এই ক্রমবর্ধমান চাপ মানুষের জীবনকে ধৈর্যহীন করে তুলছে। ধৈর্যের অভাব একদিকে মানুষের আত্মবিশ্বাস থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে তার সাহসও কমিয়ে দিচ্ছে। এজন্য প্রয়োজন সহনশীল মনোভাব। ধৈর্য ও সহ্যগুণ মানুষকে অনেক দূর অগ্রসর করে। অস্থিরতা থেকে বাঁচাতে সাহায্য করে। তাই সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্র থেকেই অসহিষ্ণুতার বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকৌতুক কণিকা
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে