আমাদের বাসায় বাবা–ঠাকুরদা–জ্যাঠা–কাকাদের বেশ পুরনো আমলের সাদা–কালো দু’একটা ছবি নিতান্তই ঘরোয়া জীর্ণ–শীর্ণ ব্যবহার্য জিনিষপত্রের ভিড়ে, এখনো, খানিকটা অক্ষত আছে। সে ছবিগুলোর মধ্যে একটা আমার প্রয়াত পিতা প্রশান্ত ভট্টাচাযের্র সবিশেষ যত্নে সংরক্ষিত, ফ্রেমে বাধাঁনো। সাদা পাঞ্জাবী–পায়জামায় কাকুর এনলার্জড ক্লোজ পোর্ট্রেট। সম্ভবত তাঁর সাতাশ–আটাশ বছর বয়সের ছবি। সতেজ, স্থির, শান্ত–সৌম্য, অপলক দৃষ্টিতে কাকু তাকিয়ে রয়েছেন। ছবির সে মানুষটিকে দেখেছি পরে, কৈশোরে। শুনেছি তাঁর জলদ–গম্ভীর, অনবদ্য ও অনুপম কণ্ঠস্বর। সব মানুষেরই কৈশোরে–তারুণ্যে–যৌবনের কোনো না কোনো পর্বে একজন ‘রোল মডেল’/ ‘নায়ক’ বা ‘প্রিয় মানুষ’ থাকেন। আমার পিতৃব্য, ছোট কাকু পংকজ ভট্টাচার্য আমার কাছে, তেমনই একজন। তিনি আমার কাছে ছিলেন অনেকটাই ‘লিভিং লিজেন্ড’! আমার প্রাত্যাহিক অনুভব–অনুভূতির এত বিপুল ও বিশাল অংশ জুড়ে তাঁর উপসিহতি যে, যাঁকে উপেক্ষা করা কিংবা দু–চার ছত্রে ব্যক্ত করা নেহায়েত সাধ্যাতীত।
আমার পিতৃব্য পংকজ ভট্টাচার্য উত্তাল ’৬০–এর দশকের প্রবাদপ্রতিম ছাত্র আন্দোলনের নেতা ও নেতৃস্থানীয় সংগঠকদের একজন। প্রথমত অবিভক্ত ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কার্যকরী সভাপতি, ’৬২–র লৌহমানব আইয়ূব–বিরোধী ঐতিহাসিক ছাত্র আন্দোলনের সংগঠক, সে সময়ের বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারার গণ–আন্দোলন ও নানামাত্রিক সামাজিক–সাংস্কৃতিক তৎপরতার অন্যতম সংগঠক ও উদ্যোক্তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য, মুক্তিযুদ্ধে ন্যাপ–সিপিবি–ছাত্র ইউনিয়ন গেরিলা বাহিনির ডেপুটি কমান্ডার, ২নং সেক্টরের অধীনে মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখ সারির বীরযোদ্ধা, পরবর্ত্তীকালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)-র দীর্ঘ দু–দশকের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক (১৯৭২–১৯৯৩), গণফোরামের কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়ামের সদস্য (১৯৯৩–২০১০), গণ–ঐক্য কমিটির কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক (২০১০–২০১৩) এবং সর্বশেষ ঐক্য ন্যাপ–এর কেন্দ্রীয় সভাপতি (২০১৩–২০২৩)। পাশাপাশি, ‘সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন’ এবং ‘সামপ্রদায়িকতা ও জঙ্গীবাদ বিরোধী মঞ্চ’ এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, উদ্যোক্তা ও সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে তাঁর রয়েছে সবিশেষ ভূমিকা। চিরকালের প্রচারবিমুখ, নিতান্তই সচেতনভাবে পাদ–প্রদীপের আলো থেকে যোজন মাইল দূরে থাকা একান্ত স্বভাবলাজুক–কাকু। দৃশ্যত: তাঁর সৌম্য–শান্ত–সুমিষ্ট প্রাণবন্ত ভদ্রজনোচিত আচরণ ও লক্ষ্যণীয় রকমের শিষ্টাচার ও সৌজন্যের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে এক দৃঢ়চেতা–বলিষ্ট–আপোষহীন প্রচণ্ড সাহসী ও দেশ–পাগল দ্রোহী মানুষের তেজোদীপ্ত সত্তা।
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের কিংবদন্তী পুরুষ সূর্যসেন ও মহাকবি নবীন চন্দ্র সেন–এর ম্মৃতি বিজড়িত বীর প্রসবিনী চট্টগ্রামের রাউজান থানার পূর্ব গুজরার নোয়াপাড়া গ্রামে কাকুর জন্ম। পিতা বিশিষ্ট শিক্ষাব্রতী প্রফুল্ল কুমার ভট্টাচার্য ও মাতা মণিকুন্তলা দেবীর অপত্য–স্নেহ–আদর–আদর্শে কেটেছে তাঁর শৈশব। পাচঁ ভাইয়ের মধ্যে কাকু সর্বকনিষ্ট।
কাকুর শিক্ষাজীবন কেটেছে চট্টগ্রামের কলেজিয়েট স্কুল, মিউনিসিপ্যল মডেল হাই স্কুল, চট্টগ্রাম কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ’৫২–র ভাষা আন্দোলন তৎকালীন পূর্ব বাংলার অগনিত কিশোর–তরুণের মত তাঁকেও টেনে নিয়ে গেছে প্রতিবাদী মিছিলে। সেই আগুনের পরশমণির ষ্পর্শ আমূল বদলে দিয়েছে তাঁর উত্তরকালের জীবনের গতিপথ। ছাত্র রাজনীতিতে সংশ্লিষ্টতার দরুণ একপর্যায়ে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হন তিনি। ছাত্রজীবনে মেধাবী, সাহিত্য–মনষ্ক, খেলাধুলায় ভীষণ আগ্রহী ছিলেন কাকু। তিনি ছিলেন চট্টগ্রামের প্রথম সারির ক্রীড়া সংগঠন ‘রাইজিং স্টার’ ক্লাবের গোলকিপার। সে দলটি প্রাদেশিক পর্যায়ে একবার চ্যম্পিয়ন হবার গৌরবও অর্জন করে। সম্ভবত: ম্যাচের একটি খেলায় প্রতিপক্ষ ও রেফারীর অন্যায় আচরণ ও ভুল সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গোলপোস্ট থেকে তিনি দৌড়ে যান এবং সরাসরি দৈহিক আক্রমণ করে বসেন রেফারীকে। ঘটনাটি নেহায়েত ক্ষুদ্র হলেও সেদিনের পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক প্রবল প্রতিক্রিয়াশীল আবহে এটির তাৎপর্য ব্যাপক। একজন সংখ্যালঘু হিসেবে নিজেকে কখনো তিনি দেখেননি, ভাবেনও নি। ধর্ম–বর্ণ–জাত–পাত নির্বিশেষে সামষ্টিক বৃহত্তর স্বার্থের স্বপক্ষে তাঁর ভূমিকা ছিল আজীবন। সংখ্যালঘু, আদিবাসী, অনগ্রসর ও পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর হয়ে তাঁর সোচ্চার ভূমিকার কথা মনে পড়লে সেসব অর্থবহ মনে হয়। সম্ভবত ১৯৬১–৬২ সালে চট্টগ্রামের চন্দনপুরার বাসা থেকে পুলিশ প্রথমবার তাঁকে গ্রেফতার করে। তখন শীতের রাত। কেবল হালকা পোশাক গায়ে তাঁর। আমার শিক্ষাব্রতী স্কুল সুপারিন্টেন্ডেন্ট দাদু প্রফুল্ল কুমার ভট্টাচার্য নিজে থানায় গিয়ে এর প্রতিবাদে ফেটে পড়েন। ঘটনাকাল ১৯৬৪–৬৫ সাল। কাকু তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি। ছাত্র আন্দোলনের এক পর্যায়ে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে হাতকড়া পরিয়ে ঢাকা থেকে কুমিল্লা জেলে নিয়ে যাচ্ছে, ট্রেনে। কুমিল্লায় ট্রেনটি থামলে কাকু দেখেন অপর বিপরীতমুখী ট্রেনে করে তাঁর বাবা–মা–বোন চিরতরে দেশান্তরী হয়ে ভারত পাড়ি দিচ্ছেন। প্রয়াত নজরুল সংগীত শিল্পী সোহরাব হোসেন এ বিয়োগান্তক ঘটনাটির প্রতক্ষ্যদর্শী। কাকু বাবা–মা–ভাই–বোনদের বলেন স্বদেশ ত্যাগ তাঁর পক্ষে অসম্ভব। কথা দেন দেশ ও দশের স্বর্থে কাজ করবেন, আমৃত্যু সম্মান অক্ষুণ্ন রাখবেন পিতা, পরিবার ও বংশের। কাকু কথা রেখেছেন। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় একটি অসাম্প্রদায়িক–গণতান্ত্রিক শোষণ–বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার সুকঠিন ও দীর্ঘমেয়াদী লড়াইয়ে ব্যাপৃত রেখেছেন নিজেকে।
কাকুর সাথে দাদুর দেখা হওয়ার সুযোগটি হয়েছিল দীর্ঘ ৯/১০ বছর পর, স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে যখন দাদু কয়েকদিনের জন্য দেশে আসেন। বাবার মুখে শুনেছি, ঢাকা এয়ারপোর্টে দাদুকে প্লেনে তুলে দিতে গেলে প্লেনটি টেক অফ্ের সময় কাকু এত বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন যে দোতলা থেকে অনেকটা লাফ দিয়ে পিতাকে শেষ বিদায় জানান অশ্রুসিক্ত নয়নে। আমার দাদু আর বাংলাদেশে, পৈত্রিক ভিটায় ফিরে আসেননি কখনো। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে ফিরে যাবার সময় সাথে করে নিয়ে গেছেন জন্মভূমির মাটি। আমৃত্যু আগলে রেখেছেন এ মাটি ও সন্তানদের স্মৃতি তিনি। আজ আমাদের পৈত্রিক ভিটা রমেশ পুরোহিতের নোয়াপাড়ার বাড়িটি জমি–জমা, পুকরি সমেত অলক্ষ্যে অন্যের দখলে, সে বাড়ি ও জমি–জমা আজ কালের গতিধারায়, হাত বদলে জনৈক ‘হাজী সৈয়দ আহমেদ সিকদার–এর নতুন বাড়ি’। বহুবার আমি দখল হয়ে থাকা আমাদের সে পৈত্রিক ভিটাটি দেখে এসেছি, কখনো আমার স্ত্রী ও দু’কন্যাকে নিয়েও।
পুরো পাকিস্তান আমল জুড়ে বিভিন্ন সময়ে কাকুর এবং তারঁ সর্তীথদের ওপর গোয়েন্দা ও পুলিশী নজরদারী, কখনো হুলিয়া, গ্রেফতার, গ্রেফতার পরবর্তী ইন্টারোগেশনের নামে নানাভাবে নানামাত্রায় শারীরিক–মানসিক নির্যাতন, হয়রানি তাঁর মনে ও শরীরে রেখেছে গভীর ক্ষতচিহ্ন। সে পর্বে কাকুর জেল আাত্মগোপনের প্রতিমুহূর্তের অনিশ্চয়তায় একান্ত নিকটজন বলতে ছিলেন কেবল আমার বাবা প্রশান্ত ভট্টাচার্য ও মেজ জ্যাঠা দিনাজপুরে শেষ জীবনে কর্মসূত্রে স্থায়ী হওয়া প্রয়াত পবিত্র কুমার ভট্টাচার্য। বোনদের বিয়ে হয়ে গেছে, কেউ কেউ ভারতে। বাবা–মাও পাশে নেই। অন্য আত্মীয় পরিজন সকলেই দেশে ও ভারতের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। নেই পৈত্রিক ভিটামাটিটুকু পর্যন্ত। ’৬৫–র সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ৬৬’র ৬ দফা–১১ দফার আন্দোলন, বাম রাজনীতিতে চীন–সোভিয়েত মতাদর্শগত বিরোধ–বিভক্তি, ’৬৯–এর গণ অভ্যুত্থানের কালবেলা, ’৭০–এর নির্বাচন, ’৭১–এর রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের কালে কাকু এক র্দীঘ সময় জুড়ে সম্পূর্ণ একা মোকাবেলা করেছেন প্রতিকূল সময়, রাজনৈতিক বহুবিধ ঘূর্ণাবর্ত ও প্রতিকূল ব্যক্তিক–সামাজিক–রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে। সম্ভবত ১৯৭৪–৭৫ সালে কাকু সংসারী হন। আমার কাকীমা তাঁর রাজনৈতিক সহযোদ্ধা এককালের ছাত্র ইউনিয়ন নেত্রী, আইনজীবী ও মহিলা পরিষদ নেত্রী সিলেটের রাখী দাশ পুরকায়স্থ। কাকুর রাজনীতির জন্য কাকীমাকেও কম ত্যাগ ও কষ্ট শিকার করতে হয়নি। কাকুর রাজনৈতিক–সামাজিক নানবিধ কর্মকাণ্ডের নেপথ্যে অন্যতম প্রেরণাদায়িনী ছিলেন তিনি। ২০২০–এ মারা যান কাকীমাও। বঙ্গবন্ধুর সাথেও কাকু জেলে ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁকে স্নেহ করতেন। কাকুর কণ্ঠস্বর, কখনো কখনো, আমার কছে মনে হয় যেন প্রায় অবিকল বঙ্গবন্ধুর মত! জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের পর চট্টগ্রামের লালদিঘি মাঠে সে নির্মম হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে কাকুর জ্বালাময়ী বক্তৃতা অনেককে কাঁদিয়েছে। অসংখ্য সভা–সমাবেশে তাঁর মোহনীয় বক্তৃতার আমিও অন্যতম বিমুগ্ধ শ্রোতা, প্রত্যক্ষদর্শী। অথচ, আশ্চর্যজনকভাবে প্রেস–মিডিয়ায়, প্রচারমাধ্যমে ভীষণরকমের অনুপস্থিত ও উপেক্ষিত রয়ে গেছেন তিনি।
২০২৩–এর এপ্রিলের শেষার্ধ। দু’বারের কোভিড সংক্রমণ কাটিয়ে, প্রেস্টেট সমস্যায় জটিল অপারেশন শেষে, আক্রান্ত ফুসফুসের তীব্র ক্ষত নিয়ে, নিউমোনিয়া–আক্রান্ত কাকু পান্থপথের হেল্থ এন্ড হোপে শুয়ে আছেন আইসিউইতে, ভেন্টিলেশনে। আমি ঢাকা ছুটে যাই। মাত্র এক সপ্তাহ আগেও আমার সাথে ফোনে কথা হয়েছে। তারও মাস খানেক আগে তাঁকে দেখে এসেছি দু’বার, ধানমণ্ডির বাসায়। সবসময় কথা বলতেন দেশ–দল–সমাজ–রাজনীতি নিয়ে; তাঁর বিশ্বাস–অবিশ্বাস, আশঙ্কা ও আশাবাদের কথা, আমাদের দিয়েছেন কত না নির্দেশনা! ঘড়ির কাঁটার সাথে রাত গভীর হচ্ছে, হাসপাতালের ঘ্রাণ আর দমবদ্ধ আবহ আমাকে অস্থির করে তোলে, আমি হাসপাতালের আইসিইউ–র বাইরে, ওপরে–নিচে, কড়িডোরে ক্রমাগত পায়চারী করি, শেষে ভেতরে ঢুকে পড়ি। দেখি, তখনো কত না যন্ত্র, নল লাগানো তাঁর সারা শরীরে, বুক উঠছে–নামছে, তিনি শ্বাস নিচ্ছেন! রাত ১১.৪৫। আমি নিচে নেমে আসার আগে, গোপনে, তাঁর একটি ছবি তুলে নিই, আমার ফোনে। মনে হয়েছে, তাঁর জীবন্ত ছবি আর তোলা হবে তো! ১২.৩০–এর ফোন পাই, কাকু আর নেই। আমার চোখের সামনে ঢাকার জ্যোস্নালোকিত ২৪ এপ্রিল ২০২৩–এর রাতের আকাশটি মধ্যরাতে, মুহূর্তে, প্রবল মেঘময়, কালো, নিকষ হয়ে ওঠে! অলক্ষ্যে, আমি টের পাই, আমার চোখের সামনে থেকে ক্রমশ: দূরে, বহু দূরে সরে যাচ্ছে সে আকাশ!