বৈচিত্র্যপূর্ণ মাদকের অনুপ্রবেশ মাদক পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে। হাতের নাগালে এসব মাদক পেয়ে অভিজাত শ্রেণির সন্তানরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তাদের কাছে নেশা করা রীতিমতো মর্যাদা ও আভিজাত্যের প্রতীক। পরিচিত মাদকের পাশাপাশি তারা অপরিচিত বিদেশি মাদকে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। নিয়মিত মাদক সেবনের আসর বসাচ্ছে। অভিযানের মাঝেও এখন পর্যন্ত ইয়াবার প্রকোপ কমেনি। তার সাথে একে একে ক্রিস্টাল মেথ বা আইস (মিথাইল অ্যাম্ফেটামিন), এলএসডি (লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইথ্যালামাইড), ডিওবি (ডাইমেথক্সিব্রোমো অ্যাম্ফেটামিন), খাট (ক্যাথিনোন ও ক্যাথিন), ম্যাজিক মাশরুম ও ক্র্যাটম প্ল্যান্ট, ম্যাজিক মাশরুম, কুশ, এক্সট্যাসি, হেম্প, মলি, ডিএমটি (এনএন ডাইমিথাইলট্রিপটামিন) ও ডিওবির মতো মাদকের অনুপ্রবেশ ঘটেছে নানা পথে। ইউনাইটেড ন্যাশনস অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম (ইউএনওডিসি) বলেছে, বাজারে যত মাদক ঢোকে, তার মাত্র ১০ শতাংশ উদ্ধার করা হয়।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মানজুরুল ইসলাম বলেন, সারা বিশ্বে যত মাদক পাওয়া যায় তার সব ক’টিকে চারটি শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে। এগুলো হলো অপিয়ডস বা ঘুম–অবসাদ উৎপাদনকারী, স্টিমুল্যান্টস বা উত্তেজক, সিডেটিভ–হিপনোটিক ও ট্রাঙ্কুলাইজার এবং হ্যালুসিনেশনস বা মনোবৈকল্য–বিভ্রম সৃষ্টিকারী মাদক।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে গাঁজা বা ক্যানাবিসের ব্যবহার পুরনো। আশির দশক পর্যন্ত সরকার নির্ধারিত বিক্রয়কেন্দ্র থেকে গাঁজা বিক্রি হতো। ১৯৮৮ সালে গাঁজা নিষিদ্ধ হওয়ার পর মাদকের বাজার দখল করে নেয় অপিয়ডস বা ঘুম–অবসাদ উৎপাদনকারী মাদক হেরোইন। এই গোত্রভুক্ত অন্যান্য মাদক, যেমন পেথিড্রিন, কোডেইন (ফেনসিডিল) ও মরফিনের ব্যবহারও পুরনো। এরপর বাজারে আসে স্টিমুল্যান্টস বা উত্তেজক মাদক ইয়াবা।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি যেসব মাদক সাম্প্রতিক বছরগুলোয় উদ্ধার করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, উত্তেজক মাদকের মধ্যে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে শক্তিশালী আইস বা ক্রিস্টাল মেথ ও এমডিএমএ (মেথাইলিন ডাইঅক্সি মেথা অ্যাম্ফেটামিন) নিয়মিত ঢুকছে বাংলাদেশে। এর বাইরে ধরা পড়েছে হ্যালুসিনেশনস বা মনোবৈকল্য–বিভ্রম সৃষ্টিকারী মাদক এলএসডি, ম্যাজিক মাশরুম, ডিএমটি (এনএন ডাইমিথাইলট্রিপটামিন) ও ডিওবি।
মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে ইয়াবা ও আইস এবং ভারত সীমান্ত দিয়ে ফেনসিডিল ঢুকছে অনেক বছর ধরে। তবে নতুন মাদকগুলো ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ও কানাডা থেকে পার্সেল হিসেবে আসে।
স্টিমুল্যান্টস বা উত্তেজক গোত্রের মাদক আইস বা ক্রিস্টাল মেথ প্রথম উদ্ধার করা হয় ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এরপর থেকে নিয়মিত বিরতিতে আইনশৃক্সখলা রক্ষাকারী বাহিনী আইস উদ্ধার করে আসছে। প্রথম এলএসডি উদ্ধার করা হয় ২০১৯ সালের ১৫ জুলাই। ২০২১ সালে আলোচনায় আসে এলএসডি। একাধারে ঘুম–অবসাদ তৈরি করে এবং মতিভ্রম ঘটায় এমন মাদকের গাছ ক্র্যাটম প্ল্যান্ট উদ্ধার করা হয় ২০২২ সালের ১৭ মার্চ। ক্র্যাটম গাছের পাতা দেখতে অনেকটা কদম গাছের পাতার মতো। ক্র্যাটম দীর্ঘস্থায়ী ব্যাথার চিকিৎসার জন্য অ্যানালজেসিক (ব্যথানাশক) হিসেবে বহু বছর ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। অপিয়ড শ্রেণিভুক্ত মাদকের নেশা কাটাতে ক্র্যাটম প্ল্যান্টের ব্যবহার হয়ে থাকলেও গবেষণায় প্রমাণিত হয়, এটি নিজেই আসক্তি তৈরি করে। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) ক্র্যাটম প্ল্যান্ট থেকে তৈরি পণ্য ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল।
ক্র্যাটম প্লান্টের পর গত বছরের মাঝামাঝি অপ্রচলিত নতুন মাদক কুশ, এক্সট্যাসি, হেম্প, মলি নামে বিদেশে প্রচলিত মাদকের সন্ধান পায় র্যাব। র্যাব বলছে, কুশ, মারিজুয়ানা বা গাঁজার মতো এক ধরনের উদ্ভিদ। তাপ নিয়ন্ত্রণ করে বিশেষ পদ্ধতিতে এই মাদকের চাষাবাদ করতে হয়। বিভিন্ন অভিজাত ক্লাবে এসব মাদক সরবরাহ করা হচ্ছে। মূলত উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরাই টার্গেট এ চক্রের।
র্যাব কর্মকর্তা খন্দকার আল মঈন বলেন, ওনাইসী নামে এক যুবক একটি ‘ক্লোজ’ গ্রুপের মাধ্যমে এসব মাদক ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করে আসছিল। তার অন্যতম সহযোগী ছিল কানাডাপ্রবাসী ফয়সাল নামের এক যুবক। ওনাইসী সাঈদ বাংলাদেশে একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ও কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করে মালয়েশিয়ায় যায়। সেখানে বিবিএ ও এমবিএ সম্পন্ন করে ২০১৪ সালে দেশে ফিরে। প্রথম দিকে ফয়সাল নামের এক ব্যক্তি থাইল্যান্ডে অবস্থান করার সময় সেখান থেকে ওনাইসীকে বিভিন্ন ধরনের অপ্রচলিত মাদক সরবরাহ করত। পরে ওই ব্যক্তি কানাডায় যাওয়ার পর সেখান থেকে মাদক সরবরাহ করত। কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে এসব মাদকের পার্সেল আসত।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক ড. দুলাল কৃষ্ণ সাহা অপ্রচলিত নতুন মাদক সম্পর্কে বলেছেন, মাদক হিসেবে কুশ বেশি ভয়ংকর ও ক্ষতিকর। এটি একটি সিনথেটিক মারিজুয়ানা, যা বাংলাদেশে প্রচলিত গাঁজা থেকে অন্তত একশ গুণ বেশি শক্তিশালী। তিনি বলেন, হিন্দুকুশ পর্বতমালা পাকিস্তান ও আফগানিস্তান অঞ্চলের একটি দুর্গম ও বিপদসঙ্কুল পর্বত এলাকা এবং কুশ মাদকে ব্যবহৃত গাঁজার চাষ বেশি হয় এই অঞ্চলে। এছাড়া ফেন্টানল আফিমের চেয়ে ৪০ থেকে ৫০ গুণ বেশি শক্তিশালী। ইয়াবাসদৃশ নেশাজাতীয় পাউডার ক্যাটামিন ‘রেফ ড্রাগ’ সেবন করিয়ে তরুণীদের সম্ভ্রমহানি করা হচ্ছে। তবে মাদকটি দামি হওয়ায় অভিজাত পরিবারের সন্তানরা ছাড়া অন্যরা খুব একটা ব্যবহার করতে পারছে না। চেতনানাশক ইনজেকশন ক্যাটামিন দিয়ে মাদক রেফ ড্রাগ তৈরি করা হয়। মূলত কোমল পানীয়র সঙ্গে পাউডার জাতীয় মাদকটি মিশিয়ে সেবন করালে বোঝা যায় না। কারণ এর কোনো আকার, ঘ্রাণ বা রং নেই। তিনি বলেন, অতিরিক্ত সুখ খুঁজতে গিয়ে তরুণ–তরুণীরা নাচ–গানের সময় রেফ ড্রাগ ব্যবহার করে। মাদক ক্যাটামিন কেউ সেবন করলে সে অনেকটা কল্পনার জগতে চলে যায়। এটি সেবনের পর অনেকের স্বাভাবিক জ্ঞান থাকে না। তখন তাদের সঙ্গে অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে।