‘সুজলা–সুফলা–শষ্যে–শ্যামলা’ এই চারটি শব্দের ব্যঞ্জনায় পরিপূর্ণ বাংলার চিত্র। বিশ্ব উন্নয়নের তুলনায় সামাজিক–অর্থনৈতিক চকচকে জৌলুস আবৃত অবকাঠামো হতে অনেকখানি পিছিয়ে থাকা বাংলার চালচিত্র। কিন্তু তখনের তুলনায় বর্তমান চালচিত্র তুলনা করলে বলতে হয়, পরিবর্তন ছুঁয়েছে অনেক। ছোট্ট একটা উদাহরণে বলা যায়, উন্নয়নের ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকা পাহাড়ি এলাকায় দাঁড়িয়ে কোনো যুবক ইন্টারনেটে তার অনর্গল ইংরেজি আর শুদ্ধ বাংলায় ভিডিও কন্টেন্ট তৈরি করে তাক লাগাবে বিশ্বে, যা কখনো কল্পনাও করা যায়নি। জনপ্রিয়তা পেয়ে বাংলাকে পরিচয় করাবে নতুন করে, দুর্গম পাহাড়ে বসেই আয় হবে মার্কিন ডলারে। সবই হয়তো সম্ভব হচ্ছে দেশের অভাবনীয় কিছু উন্নয়নের মধ্য দিয়ে।
একটু পেছনে ফিরে তাকালে সহজেই অনুমান করা যায়– কতোটা পরিবর্তন ছুঁয়েছে আমাদের, আমাদের দেশের মানুষকে।
স্বাধীনতা–পরবর্তী বাংলাদেশের অবকাঠামোর অবস্থা ছিল অনেকাংশেই নড়বড়ে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী দেশজুড়ে যে ধ্বংসযজ্ঞ চালায় তাতে ধ্বংস হয়েছিল বহু সড়ক ও রেলপথসহ বহু অবকাঠামো। ফলে যোগাযোগ ও সরবরাহ ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়ে। এগুলো সচল করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে প্রয়োজন পড়ে সার্বিকভাবে পুরো দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনর্গঠনের।
উল্লেখ্য, স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রাক্কালে দেশে বিদ্যমান চার হাজার ৬৫৬টি সেতু ও কালভার্টের মধ্যে প্রায় ২৭৪টি সেতু ও কালভার্ট সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। এ অবস্থা মোকাবেলা করার লক্ষ্যে প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় চলমান অবকাঠামোগত উন্নয়ন কার্যক্রম সম্পন্নকরণ, প্রয়োজনীয়সংখ্যক সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ, পরিবহন যানের মানোন্নয়ন এবং নতুন অবকাঠামো উন্নয়নের বিষয়ে বিশেষ জোর দেয়া হয়। এছাড়া বিদ্যমান ডকইয়ার্ড ও পোর্ট, নৌযান, বিমান যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন, বিমানবন্দর স্থাপন এবং সমুদ্রবন্দর মাইন মুক্ত করা প্রভৃতি বিষয়েও বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।
স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় দেশের বৈদ্যুতিক অবকাঠামো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯৭১–এ কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা ছিল প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। দেশের প্রায় সব বৈদ্যুতিক গ্রিড লাইন, ১২৫–এর অধিক ট্রান্সমিশন লাইন, গ্রিড স্টেশন, ডিস্ট্রিবিউশন লাইন ও সাবস্টেশন ধ্বংস হয়। যুদ্ধের পরপরই এসব অবকাঠামো পুনর্নির্মাণের ব্যাপক কর্মযজ্ঞ গ্রহণ করা হয় শিল্পায়নের ভিত্তি হিসেবে প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়।
স্বাধীনতা–পরবর্তী বাংলাদেশের পথচলাগুলো মসৃণ ছিল না। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক বাঁকবদল সবকিছু সামলে বাংলাদেশ অনন্য অর্জনের দাবিদার। আর গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চলছে একের পর এক বিস্ময়কর পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের মানুষ অর্থাৎ আমাদের নিজস্ব একটা স্যাটেলাইট হবে তা ছিলো শুধু কল্পনা মাত্র। আর এখন বাঙালির নিজেদের একটা স্যাটেলাইট আছে। বিষয়টি বাঙালি জাতির অসাধারণ একটা প্রাপ্তি। ২০১৮ সালে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট–১ নির্মাণ এবং উৎক্ষেপনের পুরো প্রক্রিয়ায় ব্যয় হয়েছিল প্রায় দুই হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। উৎক্ষেপণের সময় থেকে স্যাটেলাইটটির মেয়াদকাল ১৫ বছর বলা হলেও মেয়াদকাল আরও তিন বছর বাড়িয়ে ১৮ বছর সমপ্রসারিত করা সম্ভব বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের অবস্থান ১১৯.১ ডিগ্রী পূর্ব দ্রাঘিমার কক্ষপথে। এর ফুটপ্রিন্ট বা কভারেজ হবে ইন্দোনেশিয়া থেকে তাজিকিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত। শক্তিশালী কেইউ ও সি ব্যান্ডের মাধ্যমে এটি সবচেয়ে ভালো কাভার করবে পুরো বাংলাদেশ, সার্কভুক্ত দেশসমূহ, ফিলিপাইন এবং ইন্দোনেশিয়া। তিন দশমিক সাত টন ওজনের বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটটির ডিজাইন এবং তৈরি করেছে ফ্রান্সের কোম্পানি থ্যালাস অ্যালেনিয়া স্পেস। আর যে রকেট এটাকে মহাকাশে নিয়ে যাচ্ছে সেটি বানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের স্পেসএঙ। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট–১ এর তিন বছর পূর্তিতে প্রকাশিত বিবিসির এই রিপোর্টটিতে আয়ের বিবরণও তুলে ধরা হয়। রিপোর্টে জানানো হয় তিন বছরে এই স্যাটেলাইট আয় করেছে ৩০০ কোটি টাকাও বেশি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও তার তথ্য প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের উদ্যোগে বাংলাদেশের নিজস্ব এই স্যাটেলাইটের যাত্রা শুরু হয়।
অদম্য সাহসিকতার পদ্মা সেতুর কথা বললে যা এখন বাঙালির বিজয় বার্তাও বলা চলে। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাস্তবায়ন হয় ২০০১ সালে এই সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে। এরপর মাঝের কয়েক বছর দেশের ক্ষমতায় না থাকার কারণে এই সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা ঝুলে গেলেও ২০০৮ সালে দেশের ক্ষমতায় আসার পর আবার এই পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হয়। ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৮ লাখ ৭৬ হাজার ব্যয়ে নির্মিত হয় বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ স্বপ্নের এই পদ্মা সেতু। এর মধ্য দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের ১৯টি জেলাকে রাজধানীর সঙ্গে যুক্ত করে এই সেতু যা এই জেলাগুলোর সাথে যুক্ত হয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নে অনন্য ভূমিকা রাখবে আশা করা যায় নিঃসন্দেহে। নির্মাণ ও আধুনিকতায় এই সেতু অন্যতম মাইলফলক হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছে বিশ্বে।
দেশের বাইরে অনেক দেশে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। সেখানে মেট্রোরেল ব্যবহার করার সুযোগ হাতছাড়া করিনি। দেখেছি কতো কম সময়ে মানুষ এ–শহর থেকে ও শহরে যাতায়াত করতে পারে। সভ্য দেশগুলোতে দেশের মানুষের সুবিধার কথা চিন্তা করে তৈরি করা এসব সুযোগ কোনো না কোনোভাবে হিংসারও কারণ হয়েছে নিজেদের মানুষের যানজটের ভোগান্তির কথা চিন্তা করে। মনে মনে ভেবেছিলাম একদিন …বাংলাদেশে একদিন মানুষও আকাশ পথে রেলে চলাচল করবে, দীর্ঘদিনের চলার পথে যানজটমুক্ত জীবন উপভোগ করবে– এটা ছিল বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন প্রায় বাস্তবায়নের পথে রয়েছে। ইতিমধ্যে মেট্রোরেলে তিনটি রুটের মধ্যে একটি রুটের সংক্ষেপিত পথের উদ্বোধন হয়ে গেছে। আশা করা হচ্ছে, চলতি বছরের শেষ নাগাদ বাকি রুটের রেলপথ সবার জন্য উম্মুক্ত হবে। মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) দেওয়া তথ্যানুসারে, কর্মঘণ্টা কাজে লাগিয়ে ও যানবাহন পরিচালনার ব্যয় কমিয়ে প্রতিবছর মেট্রোরেল থেকে ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা আয় হবে। এই পথে মেট্রোরেল পথ নির্মাণ করতে ব্যয় হয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা।
চায়না বেইজিং শহরে গিয়ে প্রথম টানেলে চলাচল করে খুব অবাক হয়েছিলাম এই ভেবে যে কিভাবে নদীর বুক চিরে এপার থেকে ওপারে কিভাবে জলযান ছাড়া অনায়াসে পারি দেয়া যায়। সেই বিস্ময়কর অনুভূতি এখন নিজের দেশে আর কল্পনা করতে হবে না। কারণ খুব শিগগিরই উদ্বোধন হবে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মিত বঙ্গবন্ধুর টানেল। এই টানেল চালু হওয়ার পর কঙবাজারের সঙ্গে সড়কে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরত্ব কমে যাবে। ৯ দশমিক ৪২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই টানেল নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। এটি শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই নয় পার্শ্ববর্তী দেশ মায়ানমার ও ভারতের সঙ্গে যোগাযোগেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
একশো সেতু ও সড়ক উদ্বোধনের বিরল নজির স্থাপন করেছে এই সরকার। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরীর দেওয়া তথ্যানুসারে, সারা দেশে ২২ হাজার ৪৭৬ কিলোমিটার সড়ক নেটওয়ার্ক রয়েছে। একদিনে একশ রাস্তা উদ্বোধনের সরাসরি সুবিধাভোগ করতে পারবে ৫১টি জেলা। এ ছাড়া নতুন সেতুগুলো দুর্গম অঞ্চল পার্বত্য চট্টগ্রামে যাতায়াতকে সুগম করবে। রাজধানী থেকে দেশের প্রত্যন্ত জায়গায় চলাচলে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে এসব সেতু ও সড়কের মাধ্যমে। এই নির্মাণ সরকারের সক্ষমতা বিশ্বের দরবারে খুব ভালভাবেই তুলে ধরেছে।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হচ্ছে এক্সপ্রেসওয়েরই উড়াল সড়ক বা ফ্লাইওভার যা অবশ্যই এটা কমপক্ষে ৪ লেনের হবে। বিদেশ বিভুইয়ে দেখা এমন সড়কের প্রতি দীর্ঘশ্বাসকে মুছে এখন আমাদের দেশেই নির্মিত হচ্ছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। আর দ্রুত গতিতেই এগিয়ে চলেছে আমাদের ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েরে নির্মাণ। এর দৈর্ঘ্য হবে ৪৬ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে শুরু হয়ে ঢাকা–চট্টগ্রাম হাইওয়ের কুতুবখালীতে শেষ হবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে মোট ১৬ হাজার ৯০১ কোটি টাকা। প্রকল্পটি ২০২২ সালের নভেম্বরে উদ্বোধন হয়েছে। এটির নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে উদ্বোধন হওয়ার চার বছরের মধ্যে।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব না হলে ২০২৪ সালের মধ্যেই উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পৌঁছে যেত বাংলাদেশ। তারপরেও সর্বাঙ্গীন উন্নয়ন হচ্ছে তা নিঃসন্দেহে বলা চলে। তবে সব উন্নয়ন শব্দটির সার্থকতা আসবে তখনই যখন উন্নয়ন সকলের জন্য হবে। যারা ধনী, শুধু তাদের জন্য উন্নয়ন হলে চলবে না। সাধারণ মানুষের কাছেও যেন উন্নয়নশীল দেশের সুফল পৌঁছায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তাদের কাছে যাতে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সামাজিক সুরক্ষার সুফল পৌঁছায়, সেদিকে নজর দিতে হবে। পরিশেষে বলতে হয়, বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে অদম্য গতিতে। আর এই ধারা অব্যাহত থাকুক আগামী দিনেও। বাংলাদেশ নামটি বিশ্ব দরবারে একটা উদাহরণের নাম হয়ে থাকুক।
লেখক : প্রাবন্ধিক; শিক্ষক, অর্থনীতি বিভাগ, ওমরগণি এমই এস কলেজ।