বেইজিঙয়ের পাখির বাসায়
ভেবেছিলাম যাচ্ছি মিং থেকে কিং এ, কিন্তু দেখছি এ কী? এসে তো পড়েছি মনে হচ্ছে এক্কেবারের হাল আমলের জমানায়! মানে এক্কেবারে আধুনিকে! এইমাত্র গতিজড়তা থেকে লি খাঁ গাড়িকে স্থিতিজড়তায় উপনীত করতেই, নিজের যাবতীয় চেষ্টাকে নিস্ফল করে যে ঘুম এসেছিল চোখে। কিছুক্ষণ আগে তা খান খান হয়ে ভেঙে যেতেই চারপাশের দৃশ্যাবলীতে চোখ হয়ে গেছে এক্কেবারে ছানাবড়া! পাশের জানালা আর সামনের উইন্ডশিল্ড ভেদ করে পড়ছে যা চোখে, তার সবই যে হল একবিংশ শতাব্দীর স্থাপনা, তাতে ভুল নেই কোন। যদি না ঘটে থাকে ব্যাপারটা স্বপ্নে। অবশ্য গায়ে চিমটি কেটে আর দেখার দরকার নাই যে আসলেই ব্যাপারটি কোন স্বপ্নদৃশ্য কি না।
কারণ এরই মধ্যে গাড়ির পেছন দিক থেকে নড়াচড়ার শব্দ আর ঘুম ভাঙার পরের আ উ ইত্যকার শব্দে বোঝা গেল ভেঙেছে ঘুম সকলেরই। এরই মধ্যে দীপ্র বলে উঠেছে – ‘আমরা কি শহরে চলে এসেছি? কোথায় এসেছি বাবা?’
কোথায় যে এসেছি, তাই বা আর বলি কীভাবে আমি? তবে যতোটুকু চোখে পড়ছে এ পর্যন্ত তাতে পুরোপুরি একমত ওর সাথে যে, কিং রাজাদের প্রাচীন গ্রীষ্মকালন প্রাসাদ এলাকায় না, এসে যে পড়েছি খোদ আধুনিক বেইজিং এর বুকে, সন্দেহ নেই তাতে কোনো। খিচড়ে গেল মেজাজ কিছুটা তাতে। মনে পড়লো, লি খাঁ কে ঐ মুতিয়ানু মহাপ্রাচীর এলাকা থেকে রওয়ানা করার আগে সামার প্যালেসের কথা বলেছিলাম, তাতে কেমন যেন বিভ্রান্ত হয়েছিল সে। মানে কী এর? সে আমাদের গাইড হয়েছে বলে কি তার মতেই চলতে হবে নাকি? এমনিতে তো এমন ভাব ধরে চুপ করে আছে সারাক্ষণ যেন ভাজা মাছটি উল্টে খেতে পারে না। এখন তো দেখছি কমিশনবুদ্ধি তার ভালোই আছে! যেমন দেখেছি বিশেষত ব্যাংককে আর মালেশিয়ায়। সে কি কমিশনের লোভে নিয়ে এসেছে তাহলে আমাদের কোনো শপিং মলে?
কথা হচ্ছে ভিনদেশে তাও আবার চায়নার মতো দুর্বোধ্য দেশে এসে তারই কোনো দুর্বোধ্যতর নাগরিকের সাথে চট করে বিরক্তি বা মেজাজ দেখানো ঠিক হবে না। এরকম ভেবে মনকে শান্ত করে, লি খাঁর পাশের জানালা দিয়ে যতোটুকু দেখা যায়, তা দেখে ফের নিশ্চিত হতে চেষ্টা করলাম যে আসলেই সে কি আমাদের কোনো শপিং মলে টলেই নিয়ে এলো নাকি? যেখানে কেনাকাটা করলে থাকবে তার মোটা কমিশন।
একটু আগে গাড়িটা থামালেও, লি খাঁ ওটাকে এখন বাদিকে কাটিয়ে পিছু হটাচ্ছে, পার্কিং করবে বলে। এসময় ওর পাশের জানাল দিয়ে যতোটুকু চোখে পড়লো, তাতে তো মনে হচ্ছে দেখলাম বুঝি এক ঝলক ঐ পাখির বাসাটাই! মানে পাখির নীড়ের মতো চোখ তূলে বেইজিং তাকাতে চাইছে বুঝি এখন আমাদের দিকে!
এরই মধ্যে গাড়ি যথাস্থানে পার্ক করা হতেই সকলেরই নজরে এলো বিশালায়তনের ঐ পাখির বাসাটি। তাতে একটু আগে যে মেজাজ খিঁচড়ে গিয়েছিল লি খাঁকে কমিশনখোর মনে করে; উবে গেল তা নিমিষেই। মনে পড়ল গতকাল তিয়েন আন মেন স্কয়ারের আন্ডার গ্রাউন্ড রাস্তার গোলক ধাঁ–ধাঁর চক্করে পড়ে, এইখানে আসার যে পরিকল্পনা ছিল তা মাঠে মারা গিয়েছিল। সে জন্যই কি তবে লি খাঁ তার আজকের প্রায়োরিটি লিস্টিতে তা রেখে দিয়েছিল এটিকে সামার প্যালেসের আগে? আচ্ছা বাজে কটা এখন? মনে হতেই গাড়ি থেকে নামার আগেই ফের ড্যাশ বোর্ডে চোখ ফেলে দেখলাম বাজে সাড়ে চারটা। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
বুঝলাম খুব বেশি ঘুমাইনি বা ঝিমাইনি তা হলে। কপাল আরো ভালো এই যে, বেশ কবারই জ্যামে পড়তে গিয়ে শেষ পর্যন্ত পড়িনি আর আটকা পড়িনি জ্যামে। এখানটায় এসে গাড়ি থামানোর আগে, একদম শেষ যে জ্যামটিতে পড়বো পড়বো মনে হচ্ছিল সেখানটায় গাড়ির গতি কমিয়ে এক্কেবারে ২০/৩০ কিলিমিটারে নামাতে হয়েছিল। তাতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে হয় পাঁচ সাত বা দশ মিনিটের জন্য। কারণ জ্যামে আর যতো রকমের ঝঞ্ঝাটই হোক না কেন, বড় রকমের দুর্ঘটনার ভয় থাকে না।
‘ওয়াও বাবা। ইটস কূল।’ ইতোমধ্যে ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে লি খাঁ পেছনের দরজা খুলে ধরতেই, গাড়ি থেকে নামে নামতে বলে উঠলো অভ্র।
এরই মধ্যে নিজেও গাড়ি থেকে নেমে, বলা চলে পড়লাম এক্কেবারে হিমবাতাসের তোপের মুখে। সকালে মহাপ্রাচিরের ওখানে বাতাসের যা তোড় ছিল, দুপুরের দিকে তা বেড়েছিল। কিন্তু তা এতোটা জোরের ছিল না। জানি না, এখনি বাড়লো কি না বাতাসের তোড় গোটা বেইজিং জুড়েই। নাকি ছিল তা এরকমই আগে থেকেই। মহাপ্রাচীরের ওখানটায় মহাপ্রাচির আর পাহাড় মিলে এই বাতাসের গতি শ্লথ করে দিয়েছিল কি না কে জানে?
‘ইস দাদা, খুব বাতাস আর ঠাণ্ডা এখানে।’ ভাইপোদ্বয়কে জড়িয়ে ধরে বাতাসের ঝাপটা এড়ানোর জন্য গাড়ির আড়ালে দাঁড়িয়ে বলে উঠল হেলেন। এদিকে নিজের প্রতিজ্ঞা মোতাবেক লাজু নামেনি গাড়ি থেকে।
বাতাসের তোড় যে ভালোই এখানে, তার প্রমাণ হিসাবে দু তিনটা অস্থায়ী স্টলের প্লাস্টিক সিটের, ছাদ ও পাশের বেড়াকে, স্টলটির লোহার কাঠামো থেকে কিছুটা মুক্ত হয়ে, বাতাসের ঘায়ে ফরফর করে আওয়াজ তুলতেও শুনলাম ও দেখলাম। লাল নীল রঙের ফোলানো রাবারের তৈরি একটা স্টল তো এক্কেবারে কাত হয়ে পড়ে আছে মাটিতে। বার্ডসনেস্ট নামে বিশ্বজুড়ে সুপরিচিত বেইজিং ন্যাশানাল স্টেডিয়ামের এলাকায় ঢোকার যে মূল গেট সেটিও দেখছি বন্ধ। আমাদের বায়ে বেশ খানিটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা, ৪২ হাজার টন চকচকে নানান আকারের স্টীলের বিম দিয়ে আধুনিক ইঞ্জিনিয়রিংয়ের কারিশমায় বানানো, বেইজিংএর পাখির বাসাটি ছাইরঙের ধোঁয়াশার কারণে একদম চকচক না করলেও, বেশ উজ্জ্বলই মনে হচ্ছে সেটিকে। এই ঝলকে দ্রুত গোটা এলাকাটা নিরীক্ষণ করে বোঝা গেল, বেশ বিশালাকার এক কংক্রিট চত্বর পেরিয়েই যাওয়া যাবে ওইটির কছে। মুহূর্তে এতো বড় চত্বরটিতে যেখানে অনায়াসে দুই চার লাখ লোক সমবেত হতে পাড়ে, এক্কেবারে জনশূন্যই বলা চলে তা। দর্শনার্থী বলতে এই মুহূর্তে আমরা এই পাঁচ বঙ্গসন্তান বাদে, আশেপাশে আর কাউকেই দেখতে পাচ্ছি না। এছাড়া এ মুহূর্তে আছেন যারা এখানে, তাদের চলনবলন ভাবভঙ্গি আর ইউনিফর্ম দেখে বোঝা যাচ্ছে এরা এই স্টেডিয়ামের নানান ধরনের কর্মী। বেশিরভাগই তারা অলস ভঙিতে বসে আছে, না হয় দাঁড়িয়ে আছে টিকিট ঘরের ভেতরে, বারন্দায় না হয় সিকিউরিটি পোস্টে।
আমাদের দেশে কোনো গ্রামের হাটের উপর দিয়ে আচমকা দমকা হাওয়া বয়ে গেলে বা এমনকি শহরেরও কোনো এলাকা যদি পড়ে ক্ষণস্থায়ী কালবোশেখির তোড়ে, তাতে তৎপরবর্তী সময়ের কিছু কালের জন্যে হলেও যেরকম ছেড়াবেড়া ভাব হয় ঐ এলাকায়, এখনাকার অবস্থাটাও তাই। মনে হচ্ছে এখন বাতাসের তোড় যে রকমই হোক, একটু আগে এখানে হয়তো ঝড়ের মতোই কিছু একটা হয়েছে। আমাদের দেশের কালবোশেখির মতো মরুতে যেমন মরুঝড় হয়, মেরুতে হয় তুষার ঝড়, চায়নায় তুষার না পড়লেও এখানের এই হিম ধোঁয়াশা আবহাওয়াতেও হয়তো বা ধোঁয়াশা ঝড় হয়েছে এখানে কিছু আগেই।
সব দেখে শুনে, তা লি খাঁ কাহা, কী করা যায় বলেন তো? বলতে বলতে, গাড়ি পার্ক করার জায়গাটি থেকে ডান দিকে মিটার পঞ্চাশেক দূরে থাকা ঘরটার দিকে এগুতে থাকা চাচার পেছন পেছন এগুতে লাগলাম। আমার খাস বাংলা কথায় একবার পেছন ফিরে তাকিয়ে আঙ্গুল দিয়ে সেই ঘরটির দিকে দেখিয়ে নীরব দেহভাষায় লি খাঁ যা বলল, তার মানে আমার কাছে দাঁড়ালো –
‘আরে বাপু, একটু ধৈর্য ধরো না, খবর নিয়ে আসি।’
প্রায় একইসঙ্গে দু’জনে ঐ ঘরটিতে পৌঁছে বুঝলাম আসলেই ওটা টিকিটঘর। এখানে পৌঁছেই লি খাঁ তার দেশি ভাইদের সাথে চুং চাং চিং চাং শুরু করতেই, ঐদিকে বেহুদা কান না দিয়ে, সামনে থাকা দ্বিভাষিক সাইনবোর্ডটিতে মনোযোগ দিলাম।
ঐ সাইনবোর্ড মোতাবেক পাখির বাসা দেখার জন্য তিনস্তরের ব্যবস্থা আছে। ২০০৮ সনের বেইজিং অলিম্পিক গেইমস উপলক্ষে সুইজারল্যান্ডের স্থপতিদের নকশায় ছোট্ট সুইফট পাখির বাসার আদলে মূলত স্টিল স্ট্রাকচারের উপর নির্মিত এই স্টেডিয়াম এলাকায় ঢুকতেই গুনতে হবে জনপ্রতি ৪০ রেন মেন বি। ভেতরে গিয়ে এর সোনালি হল বা করিডোর দেখতে হলে যোগ করতে হবে আরো চল্লিশ। আর গোটা স্টেডিয়ামটি পাখির চোখে মানে ইংরেজিতে যাকে বলে বার্ডস আই ভিউতে দেখা, তা দেখতে হলে জনপ্রতি গুনতে হবে ১০০ রেন মেন বি। মানে আমাদের ছোটবেলার সিনেমা হলের মতোই এটিকেও ফার্স্ট ক্লাস, সেকেন্ড ক্লাস বা থার্ড ক্লাসে দেখা যাবে।
লি খাঁ ততক্ষণে তার বাৎচিত শেষ করে আমার দিকে ফিরে এমনভাবে শুধুই ‘নো’ উচ্চারণ করলেও, তার মানে দাঁড়াল আমার কাছে, নৈব নৈব চ। এর আভিধানিক মানে কখনোই নয়, কিছুতেই নয় হলেও এ মুহূর্তে তা হল এখন তো নয়ই, কিছুতেই নয়।
তবে কারণটা যে কী? তা তো বুঝতে পারছি না। আর বুঝতে চাইলেও যে তা বোঝা যাবে, তাও তো নয়। অতএব হাত নেড়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে মুখ ভঙ্গিতে হতাশা প্রকাশ করে যেই না লি খাঁ কে ইশারা করলাম যে, তাইলে চল কাহা, যাই এখন গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদেই। তীরে এসে তরী ডুবলই যখন, এখন আর এখানে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। আগে না বুঝলেও আজ হাড়ে হাড়েই বুঝেছি, সময় আসলেই খুব মূল্যবান!
ঠিক তখনই, লি খাঁ একটা ছোকরা মতো গার্ডকে ডেকে কি যেন বলল, তাতেই দেখি সে গার্ড সাহেব আমাকে হাতের ইশারায় তার পশ্চাৎগমন করার জন্য বলে এগুতে লাগলো, বেইজিং এর পাখির বাসার মূল চত্বরে ঢোকার মুখে যে বিশালাকায় গেইটটি আছে, যেটি এখন দাঁতে দাঁত কামড়ে মুখ বন্ধ করে আছে; সেই দিকে।
চায়নিজ ভাষা না বুঝলেও ইশারা যে কিছুটা হলেও বুঝি তা তো এ ক’দিনে বেশ অনেকবারই প্রমাণিত হয়েছে। তারপরও ঐ বন্ধ গেটের দিকে গিয়ে কী হবে? তা বুঝতে না পেরে লি খাঁর দিকে তাকাতেই, বেশিরভাগ সময়েই তার যে ভাবলেশহীন চেহারা, তাতে একটা আবছা হাসি দেখা গেল। সাথে সেও হাত নেড়ে আমাকে এগুতেই বলল।
অতএব, ঠিক আছে দেখিই না কী হয়, এ মন্ত্র মনে মনে আওড়িয়ে এগুতে এগুতে, পার্ক করা লি খাঁর গাড়িটি পার হতে হতে দলের বাকীদের অবস্থান জানার জন্য ঐদিকে তাকাতেই, ঐটির পাশ দরজা খুলে দীপ্র মাথা বের করে জিজ্ঞেস করলো
‘বাবা, টিকিট করেছ কি? আমরা কি গাড়িতে করে ভেতরে যেতে পারবো? যা ঠাণ্ডা?’ বিকেলের দিকে এমনিতেই যেমন হিমমাত্রার প্রকোপ বেড়েছে, তার সাথে যে বোঝার উপর ওজনদার পাথর হিসাবে যোগ হয়েছে বাতাসের তোড়, তা থেকে বাঁচার জন্য এরই মধ্যে ওরা সবাই সেঁধিয়ে গিয়েছিল গাড়ির পেটের ভেতরকার আরামদায়ক ওমের ভেতর। সামনে এগুতে এগুতে, ঘাড় ঘুরিয়ে গলা চড়িয়ে জানালাম, না, তা মনে হয় না। টিকিট করেও সম্ভবত গাড়ি নিয়ে যাওয়া যায় না, আর আমাদের তো টিকিটই দিল না। তারপর কি মনে করে যে বললো ফের তার সাথে যেতে, যাচ্ছি তাই। তোমরা গেলে চলে আসো দ্রুত সাথে সাথে ধুপধাপ দু পুত্রের সাথে হেলেনও গাড়ি থেকে নেমে পিছু নিলেও, লাজু রয়ে গেল গাড়ির ভেতরে নট নড়ন চড়ন।
এদিকে সেই ছোকরাগার্ড মূল গেইটের একদম ডান দিকে থাকা একটা ছোট্ট পকেট গেইট খুলে, একটু পিছিয়ে থাকা আমাদেরকে ডেকে, সেই গেইট পেরিয়ে ভেতরের চত্বরে ঢোকার ইশারা করতেই, দ্রুত এগিয়ে হুড়মুড় করে সেই গেইট পেরিয়ে আট পা রাখলাম আমাদের, বেইজিঙয়ের পাখির বাসার চত্বরে।
লেখক: প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ সাহিত্যিক