সমাজের সবচেয়ে আদি প্রতিষ্ঠান হলো পরিবার। পরিবারকে বলা হয় মানুষের প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান; পারিবারিক শিক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তি ন্যায় অন্যায়, উচিত অনুচিত, ভালো মন্দ ইত্যাদি পার্থক্য করে নিজের আচরণে বা স্বভাবে প্রতিফলিত করে। সন্তান পরিবারের যে পরিবেশে বড় হবে সেই পরিবেশের প্রভাব জীবনে পরিলক্ষিত হয়। পিতামাতার আচার আচরণ, শাসন অনুশাসন, উৎসাহ প্রদান, সত্যবাদিতা, সহনশীলতা ও সহমর্মিতা ইত্যাদি সন্তানকে প্রভাবিত করবে।
পরিবারের মধ্যে থেকে সন্তান যদি নৈতিক শিক্ষা লাভ না করে পরবর্তীতে ওই সন্তান যত বড় ডিগ্রিধারীই হোক না কেন, তার মধ্যে নৈতিকতার অভাব পরিলক্ষিত হবে। সামপ্রতিক কালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি খবর বেশ আলোড়ন তুলে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ের এক শিক্ষককে তাঁর উচ্চ শিক্ষিত ছেলে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে বৌ ছেলে মেয়ে নিয়ে বিদেশে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়র শিক্ষক বাবার খবরও রাখে না। ওই ছেলেরা নিশ্চয় ভালো রেজাল্ট করেছে, দামি স্কুল কলেজে পড়েছে, হয়ত বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিও আছে, কিন্তু নৈতিক শিক্ষা লাভ করতে পারেনি। বই পুস্তকের বা সিলেবাসের সমস্ত বিষয় মুখস্ত করেছে, কিন্তু সহমর্মিতা, সহানুভূতি, সহনশীলতা, বিশ্বাস, ভালোবাসা, দায়িত্ব কোনো কিছুই তাদের হৃদয়ে নেই। পরিবার থেকে শুধু ভালো রেজাল্ট, ভালো চাকরি, ভালো অর্থ উপার্জন ইত্যাদি বিষয়ে তাদের শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল।
বর্তমানে আমাদের সমাজে দুই ধরনের অভিভাবক পরিলক্ষিত হয়। এক ধরনের অভিভাবক আছেন– খুব বেশি সচেতন। সন্তানদের শুধু ভালো রেজাল্ট, গোল্ডেন এ প্লাস ইত্যাদি নিয়ে তারা দিনমান ব্যস্ত থাকেন। সন্তানরা এত বেশি চাপের মধ্যে থাকে যে মানসিকভাবে ওরা দুর্বল হয়ে যায়। যে করেই হোক গোল্ডেন জিপিএ পেতেই হবে। গোল্ডেন এ প্লাস ধরতে গিয়ে সন্তানদের শৈশব ও কৈশোরের আনন্দ উচ্ছ্বাস থাকে না। নীল আকাশ, সবুজ মাঠ ঘাট, ভোরের দুর্বাঘাসের উপর শিশির, নির্জন দুপুর, সন্ধ্যায় নীড়ে ফেরা পাখির কিচির মিচির শব্দ অনুভব করার সুযোগও থাকে না। অভিভাবকেরা সন্তানদের প্রকৃতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময়টুকুও দেন না। পড়ালেখায় তাদের এত ব্যস্ত করে রাখেন প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনদের আনন্দ বেদনায় সাথে থাকার সময়ও তাদের নেই। প্রাণহীন প্রাণী হিসাবে তারা গড়ে ওঠে। পড়াশোনা শেষ করে বড় চাকরি বা অন্যান্য পেশায় গিয়ে বড় থেকে আরো বড় হওয়ার জন্য ব্যস্ত থাকে।
সমাজে আর এক ধরনের অভিভাবক আছেন–তারা সন্তানদের তেমন কোনো খবরই রাখেন না। উদাসীন অভিভাবক। সন্তান কোথায় গেল, কি করল, কাদের সাথে মেলামেশা করে, সঠিক সময়ে বাড়ি ফিরে কিনা, পড়ালেখা হচ্ছে কিনা এসব কিছুরই খোঁজ রাখেন না। সন্তান নৈতিক শিক্ষাপাচ্ছে কিনা, তাদের পড়ালেখার অগ্রগতি হচ্ছে কিনা ইত্যাদির খবরই রাখেন না।
সন্তানরা নৈতিক শিক্ষা প্রথমতঃ পরিবার অর্থাৎ পিতামাতা হতে লাভ করে থাকে। শিষ্ঠাচার, সততা, সত্যবাদিতা, ন্যায়বিচার, সহনশীলতা, সহমর্মিতা, শৃঙ্খলাবোধ, দানশীলতা, আতিথেয়তা, আত্মত্যাগ প্রভৃতি মানবিক গুণাবলী মানুষ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পরিবার থেকে শিক্ষা লাভ করে থাকে।
ভালো মানুষ ও দুষ্টু মানুষ কোনো না কোনো পরিবারের সদস্য। হয়তো কারো পিতামাতা, না হয় কারো ছেলে মেয়ে। সন্তান ভালো কি মন্দ তা প্রথম অনুভব করতে পারবে পিতা মাতা। আর পিতামাতা কেমন তা প্রথম উপলব্ধি করতে পারবে তার সন্তান। অবশ্য ব্যতিক্রমও হয়। বার্ট্রান্ড রাসেল ‘Education & the social order’ বইতে লিখেছেন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা যদি অনভিপ্রেত আচরণ করে তবে এই আচরণের জন্য ওই কর্মকর্তা যতটুকু দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী তার পারিবারিক পরিবেশ। পরিবার থেকে ছেলেমেয়েদের শৃঙ্খলাবোধ, সহমর্মিতা, সহনশীলতা, ন্যায়পরায়ণতা, সত্যবাদিতা, আইন মান্য করা, শ্রদ্ধাশীলতা, স্নেহপরায়নতা ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা জাগ্রত হওয়ার শিক্ষা প্রদান করতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও মানুষ হওয়া সম্ভব, কিন্তু পারিবারিক শিক্ষা না থাকলে যতই শিক্ষা ও ডিগ্রি থাকুক না কেন সে ব্যক্তির প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠা প্রায় অসম্ভব।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ,
উত্তর কাট্টলী আলহাজ্ব মোস্তফা–হাকিম ডিগ্রি কলেজ।