নজরুলের রচনার মধ্যে যে আবেগ এবং প্রাণবন্যা ছিল তা একদিকে যেমন জনমানসে প্রচণ্ড উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিল; অপরদিকে তেমনি ইংরেজ শাসক ও রক্ষণশীলদের মনে তীব্র আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল। তাঁর লেখা কবিতা ও গান এদেশের অসংখ্য মানুষকে মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে এবং আত্মদানে উদ্বুদ্ধ করেছিল। জনমানসে তিনি যে গভীর প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিলেন তার কারণ শুধুমাত্র তাঁর কবিমানস নয়, ব্যক্তিমানসেও তিনি তৎকালীন যুবসমাজের আশা–আকাঙ্খার প্রতীক হতে পেরেছিলেন। বালক বয়সে কঠোর দারিদ্রের সঙ্গে তাঁর সংগ্রাম, মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও দারিদ্রের কষাঘাতে মাত্র ষোল বছর বয়সে সৈন্যবাহিনীতে যোগদান, পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের জন্য তাঁর অদম্য আকুতি ও আবেগ, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তাঁর ঐকান্তিক ও অকৃত্রিম উদ্যোগ তাঁকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছিল। কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় লিখেছেন, “মহা–বিদ্রোহী রণ–ক্লান্ত/ আমি সেই দিন হব শান্ত,/ যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন– রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,/ অত্যচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ–ভূমে রণিবে না-/ বিদ্রোহী রণ–ক্লান্ত/ আমি সেই দিন হব শান্ত!”
বিশের দশকে অসাম্প্রদায়িক বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কবির অসাধারণ যোগসূত্র ছিল। নজরুল সাহিত্য আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাস্কৃতিক ইতিহাসে বাঙালির নিরন্তর প্রয়োজনেও প্রণোদণার উৎস। তিনি যুগে যুগে মানবতার মুক্তিসংগ্রামে সকল প্রকার অন্যায়, অবিচার, শোষণ, নির্যাতন, নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের শক্তি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও কল্যাণকামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে নজরুলের দর্শন, চেতনা ও বিশ্বাসকে ধারণ ও লালন করা অত্যাবশ্যক। কবি নজরুল সবসময়ই চেয়েছেন মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টিকারী ধর্মীয় সংস্কৃতির রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক অচলায়তন ভেঙে ফেলতে। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসকেরা চেয়েছিল ‘ভাগ কর ও শাসন কর’ অপকৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে হিন্দু ও মুসলিম উভয় ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে ভারতীয় উপমহাদেশে তাদের শাসন–শোষণকে দীর্ঘস্থায়ী রূপ দিতে। তাইতো কাজী নজরুল ভৌগোলিক সীমারেখাকে ভেঙে দিতে চেয়েছেন। মানুষে মানুষে অবিভেজ্যতায় বিশ্বাসী নজরুল এ কারণেই শাসক–শোষক শ্রেণি এবং হিন্দু–মুসলিম গোঁড়া সমাজপতিদের নিকট শত্রুরূপে পরিগণিত হয়ে জেল–জুলুম নির্যাতন ভোগ করেছেন; তথাপি তিনি অসত্য ও মিথ্যার সঙ্গে কোনো প্রকার আপস করেননি। ১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর কাজী নজরুল ইসলামকে নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে কলকাতার এলবার্ট হলে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু বলেছিলেন, ‘বিশ শতক পার করে দিয়ে একুশ শতকের দুটি দশক অতিক্রান্ত হতে চলেছে; কিন্তু কালজয়ী কবির অনিবার্য অবস্থান সময়ের তালে আজও একটু টলেনি। নেতাজী তাঁর ভাষণে সমকালে নজরুলের প্রাসঙ্গিকতা মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেন, ‘তাঁর লেখার প্রভাব অসাধারণ। তাঁর গান পড়ে আমার মতো বেরসিক লোকেরর জেলে বসে গান গাইবার ইচ্ছে হতো। আমাদের প্রাণ নেই, তাই আমরা এমন প্রাণময় কবিতা লিখতে পারি না। আমরা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে যাব– তখন সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাব তখনও তাঁর গান গাইব। কবি নজরুল যে স্বপ্ন দেখেছেন, সেটা শুধু তাঁর নিজের স্বপ্ন নয়, সমগ্র বাঙালি জাতির।’
১৯৪১ সালের ৫ এপ্রিল কলকাতা মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির রজত জয়ন্তী উৎসবের সভাপতি হিসেবে ‘যদি আর বাঁশি না বাজে’ শিরোনামে কবি নজরুল জীবনের শেষ ভাষণ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘বিশ্বাস করুন, আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসিনি, আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম– সে প্রেম পেলাম না বলে আমি প্রেমহীন নীরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম। হিন্দু–মুসলমানে দিনে–রাতে হানাহানি, জাতিতে–জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধবিগ্রহ, মানুষের জীবনে একদিকে কঠোর দারিদ্র, ঋণ, অভাব– অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা পাষাণ স্তূপের মতো জমা হয়ে আছে– এই অসাম্য, এই ভেদজ্ঞান দূর করতেই আমি এেেসছিলাম। আমার কাব্যে, সংগীতে, কর্মজীবনে অভেদ–সুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম– অসুন্দরকে ক্ষমা করতে, অসুরকে সংহার করতে এসেছিলাম, আপনারা সাক্ষী আর সাক্ষী আমার পরম সুন্দর। আমি যশ চাই না, খ্যাতি চাই না, প্রতিষ্ঠা চাই না, নেতৃত্ব চাই না– তবু আপনারা আদর করে যখন নেতৃত্বের আসনে বসান, তখন অশ্রু সংবরণ করতে পারি না। তার আদেশ পাইনি, তবু রুদ্রসুন্দর রূপ আবার আপনাদের নিয়ে এই অসুন্দর, এই কুৎসিত অসুরদের সংহার করতে ইচ্ছে করে। যদি আপনাদের পেমের প্রবল টানে আমাকে আমার একাকিত্বের পরম শূন্য থেকে অসময়েই নামতে হয়– তাহলে সেদিন আমায় মনে করবেন না আমি সেই নজরুল। সে নজরুল অনেকদিন আগে মৃত্যুর খিড়কি দুয়ার দিয়ে পালিয়ে গেছে। সেদিন আমাকে কেবল মুসলমানদের দলে দেখবেন না– আমি যদি আসি, আসব হিন্দু–মুসলমানের সকল জাতির ঊর্ধ্বে যিনি একমেবাদ্বিতীয়াম্ তারই দাস হয়ে।’ কবির এই ভাষণের মধ্যেই আমরা তাঁর বহুমাত্রিক প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পাই।
কবি কাজী নজরুল ছিলেন নিপীড়িত মানবতার কবি। তিনি সবসময় সমাজের শোষিত–বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে কলম ধরেছিলেন। সকল প্রকার কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা ও কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে তাঁর লেখনী নির্ভীক চিত্তে অব্যাহত ছিল। কোনো প্রকার লোভ–লালসা বা মোহের নিকট তিনি আপস করেননি। কারা নির্যাতন ভোগ করলেও আদর্শ থেকে কখনো এতটুকু বিচ্যুত হননি। আবার মানুষের হৃদয়ের কোমল আবেগ–অনুভভূতির প্রতিও তিনি সমানভাবে সাড়া দিয়েছেন। নিপীড়িতদের শোষণ–বঞ্চনা থেকে মুক্তি কিংবা প্রেম ও মানবতার বাণীতে তিনি আজও সমুজ্জ্বল। জাতীয় পর্যায় থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত মন ও মননের চর্চায় এখনো আগের মতোই সমতালে কবি নজরুল ইসলামের বহুমাত্রিক প্রাসঙ্গিকতা আমরা উপলব্ধি করি। কবির আবির্ভাবের কাল থেকেই আমরা লক্ষ্য করছি, যে কোনো সংকটে, বিপদে–আপদে, আন্দোলন–সংগ্রামে, উত্তরণে–জাগরণে কাজী নজরুলের গান, কবিতা, ভাষণ–অভিভাষণ, বাণীগুলো প্রতিবাদী ও সচেতন মানুষের রুদ্ধ বাতায়নের অর্গল সহজেই লোপাট করে দেয়। সংকীর্ণ মন–মানসিকতাকে পরিহার করে বিশুদ্ধ জীবনের পথ উন্মুক্ত করে দেয়। মানুষের অন্তর্নিহিত আত্মবিশ্বাস এবং আত্মপ্রত্যয়ের অনমনীয় চিত্তকে কবি নজরুল জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন তাঁর শেকল ভাঙার গান সব শ্রেণির গেরিলা যোদ্ধাদের মনে স্বাধীন চিত্তের ওই প্রদীপটিকে জ্বালিয়ে দিয়েছে। স্বাধীন–সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন–সংগ্রামে, গণঅভ্যুত্থানে, জাতীয় সংকটে, বিপর্যয়কালে এবং মহান মুক্তিযুদ্ধকালীনও কবি নজরুল ইসলাম ছিলেন প্রাসঙ্গিক। কারণ তিনি বাঙালির চিরকালের অমোঘ সাহস, সত্য ও প্রত্যয়। যে প্রদীপটি শিখা অনির্বাণ হয়ে জ্বলছে, অনন্তকাল ধরে জ্বলবে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কবিকে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর মনে এই বিষয়টি কাজ করেছিল, যে কবি নির্যাতিত ও শৃঙ্খলিত মানুষের মুক্তি চেয়ে দুর্বার বিদ্রোহের অনল জ্বালিয়েছিলেন, যে কবি হিন্দু–মুসলমান এই দুই সম্প্রদায়কে একই বৃন্তের দুটি ফুল বলে সম্প্রীতির গান গেয়েছিলেন, সর্বোপরি যে কবি শোষণবিহীন সমাজের ন্বপ্ন দেখে ‘গাহি সাম্যের গান’ উচ্চারণ করেছিলেন, সে কবির আত্মার দেশ হতে পারে প্রিয় বাংলাদেশ।
বিশ ও একুশ শতকের বিশ্বে মানবতাবাদী মনীষীর অভাব ছিল না। কিন্তু বর্তমান সময়ের পৃথিবীতে মহাপুরুষের সংকট অত্যন্ত প্রকট। মানবজাতি পৃথিবীর ইতিহাসে বর্তমান সময়ের মতো এমন সংকটে আর পতিত হয়নি। তাই বিগত সময়গুলোতে যাঁরা মানব জাতিকে মুক্তির বাণী শুনিয়েছেন, তাঁদের কথা বা বাণীগুলো শুনতে ও মানতে হবে এবং লেখনীগুলো হৃদয়ে ধারণ করতে হবে। এখানেই জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম প্রাসঙ্গিক। সংকট মোচনে, অন্যায় ও অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে চিরকাল প্রেরণা দেবে কবি নজরুল ইসলামের আদর্শ। আমাদের জাতীয় জীবনে তিনি একটি স্তম্ভ। সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে নজরুলের সৃষ্টিকর্মেও রয়েছে বেশ প্রাসঙ্গিকতা। কবি নজরুল হচ্ছেন কালোত্তীর্ণ কবি, যাঁর প্রাসঙ্গিকতা কোনো সময়ের আবর্তে কিংবা ভূগোলের বিভাজনে বিভক্ত করা যাবে না। যতদিন পৃথিবীতে শাসকের অন্যায়, অত্যাচার, শোষণ, নির্যাতন থাকবে; সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পুঁজিবাদী আগ্রাসন চলবে, ধর্মহীনতার সন্ত্রাস মানুষের মুক্ত চেতনাকে রুদ্ধ করে দিতে চাইবে; ততদিন পর্যন্ত নজরুলের প্রতিবাদী চেতনা আলোর পথ দেখাবে।
লেখক: শিক্ষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।