চ্যাটজিপিটি ও আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক পেশার ভবিষ্যৎ কী

অনুপ দাশগুপ্ত | বুধবার , ২৪ মে, ২০২৩ at ৫:৪৪ পূর্বাহ্ণ

চ্যাট জিপিটি নিয়ে এখন পৃথিবীব্যাপি আলোড়ন চলছে। বর্তমান সময়ের পৃথিবী বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী ও দার্শনিক নোয়াম চমস্কি চ্যাট জিপিটি নিয়ে বলেছেন, “এটা মূলত ‘অত্যাধুনিক চৌর্যবৃত্তি’এবং ’না শিখতে চাওয়ার রাস্তা”।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই আসলে হলো, পৃথিবীর ৯৯% মানুষের মেধা, চিন্তাশক্তি ও ব্রেইনকে অচল করার ব্যবস্থা। গুটি কয়েক মানুষের হাতে সমস্ত পৃথিবীর সমস্ত মানুষের চিন্তা শক্তির নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে। চ্যাট জিপিটি যেভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক পেশাকে অস্থিতিশীল করে তুলবে, তা নিয়ে ভাবার বিষয় আছে। এ আই চার্স যত তর্জন ও গর্জন শুরু করেছে, আসলেই কি তাই! যত গর্জে তত কি বর্ষে? বিশ্বজুড়ে সাড়া জাগানো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন কম্পিউটার অ্যাপ হলো চ্যাপজিটিপি। বলা হচ্ছে ইন্টারনেট আবিষ্কারের মতোই যুগান্তকারী ঘটনা এই চ্যাটজিপিটির উদ্ভাবন। ওপেন এআই নামে একটি প্রযুক্তি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান গত বছরের নভেম্বরে এটি সবার জন্য উম্মুক্ত করে। অল্প সময়ে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে পড়ে চ্যাটজিপিটি। এটাকে বলা হচ্ছে ল্যাঙ্‌গুয়েজ মডেল, যা কথোপকথনের মাধ্যমে মানুষকে সাহায্য করতে পারে। ব্যবহারকারীর সঙ্গে কথাবার্তা, প্রশ্ন বা আলাপের ভিত্তিতে উত্তর সরবরাহ করতে পারে।

যদি চ্যাটজিটিপি মুহূর্তের মধ্যেই যে কোনো বিষযে একাডেমিক ক্ষেত্রে উত্তীর্ণ হওয়ার মতো রচনা লিখে ফেলতে পারে, তবে এই একাডেমিক রচনার ভবিষৎ কী? চ্যাট জিটিপি মূলত একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সার্চ টুল বা যন্ত্র। এ প্রযুক্তিটি একটি বৃহৎ ল্যাঙ্‌গুয়েজ মডেলের সাহায্যে ওয়েবে থাকা তথ্যগুলোকে সম্বন্বয় করে যে কোনো বিষয়ে একটি সুসজ্জিত ফলাফল প্রদান করে থাকে। গতবছরের নভেম্বর মাসে চ্যাটজিটিপির আবির্ভাবে ভবিষ্যতে বিশ্ব প্রযুক্তিতে এক আমূল পরিবর্তন আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। কিন্তু তা নিয়ে এখন বিতর্ক চলছে সারা বিশ্বে। চ্যাটজিটিপি নাকি এমবিএ পাস করে আগামীর শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ভাবিয়ে তুলেছিল। ঠিক তেমনি ভাবে এবার ইউএস মেডিক্যাল লাইসেসিং পরীক্ষায় বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে পাস করে চিকিৎসাবিজ্ঞানে এর ব্যবহার নিয়েও সংশ্লিষ্টদের ভাবিয়ে তুলেছে। এছাড়া গত বছর ওপেন এআই ক্ষেত্রে সাড়া ফেলেছিল ওপেন এআই ইমেজ জেনারেটর ডলডি। প্রযুক্তিটি টেক্সটের নির্দেশনা অনুযায়ী ছবি তৈরী করতে পারে।

নোয়াম চমস্কি চ্যাট জিটিপির উত্থানকে স্মার্ট ফোনের সাথে তুলনা করেছেন। তার মতে, “অনেক শির্ক্ষার্থীই আছে, যারা ক্লাসরুমে বসেই তাদের আইফোনে অন্যদের সাথে চ্যাটিং করে। এটি থামানোর একটি উপায় ক্লাস রুমে আই ফোন নিষিদ্ধ করা। আরেকটি উপায় ক্লাসকে আরো আর্কষর্ণীয় করে তোলা। শিক্ষার্থীদের না শিখতে চাওয়ার আগ্রহ এবং নিজেদের শেখার বদলে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার ‘শিক্ষাব্যবস্থার পতন’এর একটি চিহ্ন”।

শিক্ষা যদি শিক্ষার্থীদের কাছে আর্কষণীয় না হয়, তাদের আগ্রহী না করে তোলে, তাদের চ্যালেঞ্জ না করে, তাদের শেখার কাজে উদ্বুদ্ধ না করে, তারা এই শিক্ষাব্যবস্থা থেকে দূরে চলে যাবে বলে আমার ধারণা।

চ্যাটজিটিপি নাকি কবিতা, গল্প গান, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, উপস্থিত বক্তৃতা, সভা সমিতিতে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য স্ক্রিপ্ট সহ বলতে গেলে দৈনন্দিন জীবনের এবং সৃষ্টিশীল কাজের সবই নাকি লিখে দেবে ও করে দেবে এবং এখন দিচ্ছেও। খবরে প্রকাশ, গত ফেব্রুয়ারিতে নাকি চ্যাটজিটিপির বদৌলতে ‘অলরাউন্ডার’লেখকের আবির্ভাবে চ্যাটজিটিপিতে লেখা বইয়ে সয়লাব হয়ে গেছে আমাজন। ধারণা করা হচ্ছে সৃষ্টিশীল মানুষ, শিক্ষক, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীসহ অসংখ্য বুদ্ধিবৃত্তিক পেশার লোক চাকরি নিয়ে হুমকির মুখে পড়বে। যদিও তার পাশাপাশি অন্য ধরনের অসংখ্য নতুন নতুন চাকরির দ্বার উম্মুক্ত হবে। এসব এখনও পুরোপুরি ধারণার মধ্যেই আছে। এগুলো সব আসলে নির্ভর করবে উদীয়মানএআই প্রযুক্তিকে কীভাবে কাজে লাগানো যায়, তার উপর। তবে এখনও বুঝে ওঠার চেষ্টা করছে উদ্যোক্তা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে এই মুহূর্তে এগুলোর ব্যবহার বেশ সীমিত, নতুন পণ্য তৈরি, ব্যবসা কার্যক্রম সরল করা বা কর্মীদের অধিক দক্ষ করে তোলার কাজে।

ইতিহাস থেকে দেখা যায়, প্রযুক্তির প্রভাব তৈরি হতে আমাদের ধারণার চেয়ে বেশি সময় লেগে যায়। যেমন ধরুন বিদ্যুৎ। ১৮ শতকেই উদ্ভাবিত হয়েছিল বৈদ্যুতিক সার্কিট, লাইট ও মোটরের মতো যন্ত্রপাতি। কিন্তু বিদ্যুৎশক্তির সার্বিক ব্যবহার শুরু হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বৃদ্ধিতে লেগে যায় আরও এক শতক।কম্পিউটারও নয় তার ব্যতিক্রম। ১৯৫০এর দশকেই বাজারে আসে প্রথম দিককার কম্পিউটার। কিন্তু ১৯৯০ দশকের আগপর্যন্ত উৎপাদনশীলতায় তার প্রভাব সেভাবে দেখা যায়নি।

কিছু প্রযুক্তি নিঃসন্দেহে উৎপাদনশীলতা বাড়ায়, সঙ্গে কমায় শ্রম চাহিদা। যেমন স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি কর্মসংস্থান কমিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি করেছে। এই প্রক্রিয়া চলে আসছে সেই শিল্প বিপ্লবের সময় থেকেই। তবে কিছু প্রযুক্তি অসাধারণ হওয়ার পরও চাকুরি প্রতিস্থাপনে তাদের প্রভাব বেশ নীরবই বলা যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ইন্টারনেটের কথা। এই প্রযুক্তি কি গত চার দশকে আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা ও জীবনযাত্রার প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেনি? আমরা যেভাবে বন্ধুত্ব পাতাই, বিনোদন মাধ্যমে যুক্ত হই বা এমনকি নিজের জীবনের গল্পগুলোকে রেকর্ড করি বা ব্যবসার উদ্যোগ গ্রহণ করি, তা নিঃসন্দেহে বদলেছে। ইন্টারনেট তৈরি করেছে অযুত কোটি ব্যবসা, আর তাতে ধনকুবেরও বনেছেন অনেকেই।

গুগল ইতিমধ্যে তাদের নিজস্ব এআই প্রতিষ্ঠা করছে। এর অংশ হিসেবে জনপ্রিয় এ সার্চ ইঞ্জিনটি বর্তমানে কথপোকথনবিষয়ক এবং ভয়েস সার্চ নিয়ে গবেষণা করছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জগতকে আরও অগ্রসর করতে গুগল ডিপমাইন্ড নামক একটি এআই কোম্পানি নিয়ে কাজ করছে। এখন কথা হলে চ্যাটজিপিটি কি ত্রুটিমুক্ত? আমার তো মনে হয় না। বর্ণ, জেন্ডার এবং সংস্কৃতি নিয়ে সামাজিক পক্ষপাতকে স্থায়িত্ব দেওয়ায় এআই প্রযুক্তি ইতিমধ্যেই বিতর্কিত হয়ে পড়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করা তাদের কিছু প্রজেক্টের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে অ্যালফাবেট ইংকয়ের গুগল এবং আমাজনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে,’ সেগুলো নৈতিকভাবে অনির্ভরযোগ্য।”

অন্যান্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক উদ্ভাবনের মতোই স্বাভাবিক ভাবেই চ্যাটজিপিটি ত্রুটিমুক্ত নয়। টুলটি ‘আপাতত বিশ্বাসযোগ্য প্রতীয়মান,’ কিন্তু ভুল বা অর্থহীন উত্তর দিয়ে সাড়া দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে বলে স্বীকার করেছে ওপেন এআই। তবে এই সমস্যার সমাধান করা চ্যালেজিং বলে মনে করে প্রতিষ্ঠানটি। চ্যাটবলটি পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করতে পারে বলেও সতর্ক করেছে তারা।

তবু ২০০০এর দশকে অর্থনীতিবিদ রবার্ট গর্ডন বলেন, “ইন্টারনেট মহান আবিষ্কারগুলোর প্রতিবন্ধকতা উতরানোর পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। কারণ, এটা আমাদের সস্তায় তথ্য ও বিনোদন লাভের সুযোগ করে দিলেও এর অধিকাংশ সেবাই বিদ্যমান কর্মকাণ্ডের বিকল্প মাত্র”। তাই প্রায় চার যুগ পরেও উৎপাদনশীলতার বিপ্লব সূচনা করতে পারেননি ইন্টারনেট। যে কারণে স্মার্টফোনও পারেনি।

এ আই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কি তাহলে স্মার্ট ফোনের সাথে তুলনা করা উচিত, নাকি করতে হবে স্বয়ংক্রিয় উৎপাদন যন্ত্রের সাথে? সার্বিকভাবে এটা কি চাকরি নষ্ট না করে শুধু কাজের ধরন বদলে দেবে? নাকি বুদ্ধিবৃত্তিক পেশার কেন্দ্রগুলোরও শূন্য মেধায় রূপ দেবে?

এ প্রযুক্তি কোথায় চাকুরি শূন্যতা সৃষ্টি করবে, তা এখন অনুমান করা কঠিনই বলা যায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এ আই নিয়ে এখন যে হৈচৈ হচ্ছে,তাতে আমার শুধু মনে পড়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জনক অ্যালান টিউরিং এর কথা। ১৯৩৬ সালে যিনি প্রথম ‘টিউরিং’ নামক বিশেষ যন্ত্র আবিষ্কার করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিষয়টি প্রথম পৃথিবীর সামনে নিয়ে আসেন। তিনি বেঁচে থাকলে আজ কী বলতেন? তবে মাঝে মাঝে মনে হয় ইলন মাস্কের এক সাক্ষাৎকারের কথা যেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘এ আই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিউক্লিয়ার বোমা থেকেও ভয়াবহ’।

দেখা যাক ভবিষ্যতে কী হয়। তার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে হয়তো আরো বিশ বা পঁচিশ বছর।

লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধকবি কাজী নজরুল ইসলামের নবযুগ