পৃথিবীতে পশুপাখি হতে আরম্ভ করে জীব, অণুজীব, কীটপতঙ্গসহ প্রতিটি প্রাণীই ত্যাগের মহিমায় কাজ করে। শুধু মানুষই দুটি বস্তুর আকাঙ্ক্ষায় থাকে। একটি ভোগ, অন্যটি ত্যাগ। কারো মধ্যে ভোগের ইচ্ছা প্রবল, আবার কারো মধ্যে ত্যাগের ইচ্ছা প্রবল। রসায়নশাস্ত্র অনুসারে, একটি মৌল সব সময় অষ্টক পরিপূর্ণ করতে চায়। এটাকে অষ্টক সূত্র বলে। কোনো মৌল ইলেকট্রন গ্রহণের মাধ্যমে অষ্টক পূর্ণ করে স্বাধীন ও সক্রিয়ভাবে থাকে, আবার কোনো মৌল ইলেকট্রন ত্যাগের মাধ্যমে শান্তিতে থাকতে চায়। যেমন খাদ্য লবণ সোডিয়াম ক্লোরাইডের গঠন থেকে দেখি সোডিয়ামের ইলেক্ট্রনবিন্যাস ২,৮,১ আবার অপর দিকে ক্লোরিনের ইলেক্ট্রনবিন্যাস হলো ২,৮,৭। সোডিয়াম তার অষ্টক পূরণের পর একটি ইলেক্ট্রন ত্যাগ করে অন্য কাউকে দান করে সোডিয়াম আয়নে পরিণত হয়। এই দান করার মাঝেই তার আনন্দ। অপর দিকে ক্লোরিনের বাইরের সেলে ৭টি ইলেক্ট্রন রয়েছে। তার অষ্টক পরিপূর্ণ করার জন্য একটি ইলেক্ট্রন দরকার। তখন সোডিয়ামের দান করা একটি ইলেক্ট্রন গ্রহণ করে ক্লোরাইড আয়নে পরিণত হয়। অর্থাৎ অষ্টক পরিপূর্ণ করে। এভাবে সোডিয়াম ও ক্লোরিনের পারস্পরিক আদান–প্রদান তথা ভোগ আর ত্যাগের মাধ্যমে সোডিয়াম ক্লোরাইডে পরিণত হয়। যা খাদ্য লবণ নামে পরিচিত এবং নিয়মিত আহারে যেটি আমাদের অত্যাবশ্যকীয় উপাদান বলে মনে করি। সোডিয়াম, ক্লোরিনের ভোগ আর ত্যাগের মহিমায় বিনিময়ের মাধ্যমে খাদ্য লবণ গঠন করে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। যাকে বলে ইতিবাচক মনোভাব তথা সুবুদ্ধি। আল্লাহর ৮৪ লক্ষ সৃষ্টির মধ্যে আশরাফুল মাখলুকাত তথা সেরা জীব মানুষের মধ্যেও এই রীতি বিরাজিত। মানুষভেদে এই রীতি কম বা বেশি হয়। কেউ ভোগ করে শান্তি পায়, কেউ ত্যাগের মাধ্যমে শান্তি পায়। এই দুটি জিনিসের আকাঙ্ক্ষার কারণে জগতের মাঝে মানুষ যত সুকর্ম ও কুকর্ম করে। এই চাহিদার জন্য কেউ আল্লাহর ইবাদত করছেন, আল্লাহকে সাধ্যমতো ডাকছেন, মওলার প্রেমে কাঁদছেন, তার নাম জপছেন এবং সৃষ্টির সেবা করে মানুষের কল্যাণ করছেন। এর মধ্যেই তার শান্তি। অপর দিকে একই চাহিদার জন্য কেউ ডাকাতি, চুরি, রাহাজানি, খুন, অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ, গরিবের হক আত্মসাৎ, কালোবাজারিরা দেশের ক্রান্তিকালে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য গুদামজাত করে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন, খাদ্যে ভেজাল মিশাচ্ছে শুধু বেশি মুনাফার লোভে। কামুক কামের সেবা করছে, হিংসুক হিংসা করছে, অহংকারী অহংকার করে তার মধ্যে শান্তি খুঁজে বেড়াচ্ছে। সবাই শুধু শান্তিই চায়। ইসলাম ধর্মও পরিপূর্ণ শান্তির কথা বলে। কোনো ধর্ম বা কোনো অবতার, নবী–রাসুল, বেলায়তের ধারকবাহক ব্যক্তিসহ সকলেই শান্তির অমীয় বাণী প্রচার করেছেন এবং করে যাচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো কেউ ত্যাগের মাধ্যমে শান্তি অন্বেষণ করে, কেউ ভোগের মাধ্যমে শান্তি খোঁজে। মূল কথা হলো, প্রকৃত শান্তি কোথায় পাবেন? মধু সংগ্রহের জন্য যদি ভিমরুলের বাসায় যাওয়া হয়, তাহলে মধু সংগ্রহ তো দূরের কথা, বরং ভিমরুলের হুলের আঘাতে কাঁদতে হবে। ভুল পথে শান্তি খুঁজলে শান্তির পরিবর্তে অশান্তি পাবেন বেশি। এ জন্য সঠিক পন্থায়, সঠিক দর্শন ও সঠিক পথপ্রদর্শকের সাহায্যে সুচিন্তার মাধ্যমে আল্লাহর সান্নিধ্যে যাওয়া ও পাওয়ার ধ্যানে নিজেকে নিমগ্ন থাকতে হয়।
মনোভাব দুটি– একটি ইতিবাচক মনোভাব ও অন্যটি নেতিবাচক মনোভাব। সৃষ্টির মাঝে আপনি যদি ইতিবাচক চিন্তা করেন, তাহলে সবকিছু ইতিবাচক হয়ে ধরা দেবে। ইতিবাচক মনোভাব অর্থই হলো সুবুদ্ধির পথে চলা, সুবুদ্ধির অনুসারী হওয়া। বেলায়তে ওজমা তথা উন্মুক্ত অধ্যাত্মবাদ দর্শনের অন্যতম আধ্যাত্মিক সাধক গাউছে ভাণ্ডার হজরত মতিয়র রহমান শাহ্ (ক.) ফরহাদাবাদী প্রকাশ শাহ ছাহেব কেবলা, যাকে সুবুদ্ধির দর্শনের স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রচারক বলা হয়। যিনি বিশ্ববাসীকে সুবুদ্ধির বাণী শুনিয়েছেন। তিনি তার ভক্ত–শিষ্যদের সবসময় একটি প্রশ্ন করতেন, কী বুদ্ধি? উত্তরও তিনি বলে দিতেন– ‘সুবুদ্ধি বলেন’। ভক্ত, শিষ্যগণ এই অন্তর্নিহিত ভাবগম্ভীর সুবুদ্ধিতত্ত্ব সম্পর্কে জানতে চাইলে, তিনি বলেন, ‘সুবুদ্ধিতে খোদা, সুবুদ্ধিতে রাসুল (সা.) সুবুদ্ধিতে কুরআন, সুবুদ্ধিতে ইসলাম, সুবুদ্ধিতে ঈমান, সুবুদ্ধিতে মানবতা।’ সু অর্থ ভালো, উত্তম, সুন্দর ইতিবাচক মনোভাব, আর বুদ্ধি অর্থ বোধ, বিচারশক্তি, কৌশল, জ্ঞান। সুবুদ্ধির চর্চা মানুষকে কালজয়ী শ্রেষ্ঠ মানুষে পরিণত করে। কুবুদ্ধির চর্চা মানুষকে ধ্বংস করে। সুবুদ্ধির চর্চা করলে প্রত্যেক কর্মে, চিন্তায়, ইতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। যদি সৃষ্টির মাঝে ইতিবাচক চিন্তা করেন, তাহলে প্রকৃতির দৃশ্যমান অদৃশ্যমান সবকিছুই ইতিবাচক হয়ে প্রকাশ পায়। এমনকি সৃষ্টির অধিপতি মহান আল্লাহকেও পাওয়া যায়। অপর দিকে কুচিন্তা জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। প্রখ্যাত জাপানি বিজ্ঞানী মরিসো ইমোতো বস্তুর উপর চিন্তার প্রভাব সম্পর্কে গবেষণা করতে গিয়ে নমুনা হিসেবে পানি নিয়ে পরীক্ষা করেন। তিনি একই নমুনার পানি দুটি বোতলে নিয়ে রাখেন। প্রথম বোতলের পানিকে বলতে থাকেন– তুমি খুবই উপকারী, তুমি মানুষের জীবন বাঁচাও, তোমাকে ধন্যবাদ। এরপর অন্য বোতলের পানিকে বলেন, তুমি খুবই খারাপ, তোমার কারণে ডায়রিয়া হয়ে মানুষ মারা যায়। এই দুই পানিকে ক্রিস্টালাইজ (৪৫০ সে.গ্রে. তাপমাত্রায়) করে মাইক্রোস্কোপের নিচে পরীক্ষা করে দেখলেন দুই বোতলের পানির বিন্যাস ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করেছে। ধন্যবাদ বা কৃতজ্ঞতা জানানো পানির অণুগুলো ফুলের মতো ও সুশৃঙ্খল আকার ধারণ করেছে, আর অন্যদিকে বিরক্তি প্রকাশ ও হুমকি দেওয়া পানির অণুগুলো বিক্ষিপ্ত এলোমেলো বিন্যাসহীন রূপ ধারণ করেছে। নেপোলিয়ান বলেন, ‘মানুষের মন যা ধারণ করে ও বিশ্বাস করে, সে সেটা অর্জন করে’। সু–মনোভাব মানবতাবোধ জাগিয়ে তোলে। মানবতাবোধ জাগ্রত হলে ভোগের মানসিকতা পরিহার করে ত্যাগের মহিমায় উদ্বুদ্ধ হওয়া যায়। তখন এই ত্যাগের মাঝে আনন্দ খুঁজে পাওয়া যায়। সুবুদ্ধি তথা ইতিবাচক চিন্তার ব্যক্তি অন্যের ক্ষতি করার পূর্বে একবার চিন্তা করবে। তার সুমনোভাব তাকে ক্ষতি করতে বাধা দেবে। তদ্রূপ আত্মার পরিশুদ্ধতার জন্যও সুবুদ্ধির চর্চার বিকল্প নেই। মানবতার জাগরণের পূর্বশর্ত নৈতিক জাগরণ। মানবতার জাগরণ হলে তবেই পৃথিবীতে হানাহানি, মারামারি, ধ্বংস, বোমাবাজি, রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি বন্ধ হবে। মুনাফালোভীরা মালামাল গুদামজাত করার পূর্বে একবার চিন্তা করবে। মানুষকে ঠকানোর পূর্বে ভাববে ঠিক হচ্ছে কি না। নৈতিক জাগরণ হলেই পরমাত্মিক জাগরণ আসবে। এটা একপ্রকারের ত্যাগ। ত্যাগ আর ভোগ নিয়েই মানুষের জীবনপ্রবাহ। কিন্তু ভোগ করতে গিয়ে নিজের স্বার্থসিদ্ধির মধ্যেও ইতিবাচক মনোভাবের কারণে একটু হলেও চিন্তা করবে যে আমার স্বার্থ হাসিল করতে গিয়ে কারো ক্ষতি হচ্ছে কি না। এটাও একপ্রকারের ত্যাগ। এটাই সুজ্ঞানের চর্চা। নৈতিক জাগরণের ফলেই আত্মিক জাগরণ হয়। সুচিন্তা, সুজ্ঞান মানুষকে পরমাত্মিক মহাজাগরণের দিকে পরিচালিত করে। আত্মা পরিশুদ্ধ হলে তার সুকর্মের প্রভাব সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর হয়ে জীবনে প্রতিফলিত হয়। তখন মানুষের ক্ষতি চাওয়াটা দূরের কথা, গাছের একটি পাতা ছিঁড়তেও চিন্তা হবে। পবিত্র কুরআন শরিফে মহান আল্লাহপাক বলেন, ‘যে ব্যক্তি নিজেকে পরিশুদ্ধ করল, সে–ই সফল; আর ব্যর্থ সে–ই, যে নিজের অন্তঃকরণকে কলুষিত করল’। (সূরা শামস আয়াত ৯–১০)। বর্তমান বিশ্ব অশান্তির আগুনে জ্বলছে। এর মূল কারণ সুবুদ্ধির পথ থেকে বিচ্যুতি। আল্লাহর ৮৪ লক্ষ সৃষ্টির মধ্যে মানুষ ও জিন ছাড়া প্রত্যেকের মনে ইতিবাচক মনোভাব বিরাজ করে। প্রত্যেকে যার যার অবস্থান থেকে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। সকলেই সৃষ্টিকে প্রতিনিয়ত ইতিবাচক কিছু দিয়ে যাচ্ছে। এমনকি আল্লাহর ৯৯ নামের একটি নামই হলো ‘আল্লাহ খাদেমুন’ অর্থাৎ আল্লাহ সেবক। প্রতি নিমেষে রিজিক, বৃষ্টি, আলো, অক্সিজেনসহ মানবের প্রয়োজনীয় যা কিছু, তা প্রতি পলে পলে ও ক্ষণে ক্ষণে দিয়েই যাচ্ছেন। কিন্তু একমাত্র মানবসম্প্রদায় অন্যের তথা সৃষ্টির ক্ষতি করে। এই মানবজাতি প্রতিনিয়ত আল্লাহর সেবা ভোগ করছে কিন্তু বিনিময়ে করছে তার নাফরমানি। মানব কুকর্মের কারণে শয়তানের চরিত্র ধারণ করে পশু হয়ে যায়। আবার সেই মানবই তার ইতিবাচক মনোভাবের কারণে সর্বশ্রেষ্ঠ আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। এ জন্য আমাদের নেতিবাচক তথা কুবুদ্ধির চিন্তা পরিহার করে দার্শনিক গাউছে ভাণ্ডার হজরত মতিয়র রহমান শাহ (ক.)-এর দেখানো সুবুদ্ধির পথ অবলম্বন করে পৃথিবী থেকে হানাহানি, হিংসা, মারামারি, ঘৃণা দূর করতে পারি। এর ফলে পৃথিবীতে জঙ্গিবাদ–উগ্রবাদ থাকবে না। জাতি–ধর্মনির্বিশেষে মানুষের মধ্যে বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক