গত বছরের ৬ নভেম্বর তারিখের দৈনিক আজাদী পত্রিকায় ‘শিশু কিশোরদের খেলার মাঠ যখন মেলার দখলে’ শীর্ষক একটি উপসম্পাদকীয় কলাম লিখেছিলাম। লেখাটির পাশে সে সময়ে আউটার স্টেডিয়ামে চলমান বাণিজ্য মেলার একটা ছবিও ছাপানো হয়েছিল। পরবর্তীতে গত ৩রা মার্চ আমরা বিভিন্ন পত্রপত্রিকা মারফৎ অবগত হলাম, খেলার মাঠে মেলা না করার বিষয়ে ঘোষণা দিয়েছেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক এবং চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান। এর অংশ হিসেবে প্রথমত চট্টগ্রাম আউটার স্টেডিয়াম অংশের সীমানা চিহ্নিত করে সেটি দখলমুক্ত করে শুধুমাত্র খেলার জন্যই সেটি বিশেষায়িতভাবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়। পরবর্তীতে নগরীর অন্য মাঠগুলো পর্যায়ক্রমে দখলমুক্ত করে শুধু খেলার জন্যই বরাদ্দ রাখার সিদ্ধান্ত হয়। আর মেলার জন্য বরাদ্দ রাখা হবে বিশেষ কোনো স্থান। যেখানে শুধুই মেলার আয়োজন হবে। এটি জানার পর অসম্ভব এক ধরনের ভালো লাগা কাজ করেছিল তখন।
পরবর্তীতে ৮ মার্চ তারিখ সন্ধ্যায় দেখি নগরীর আউটার স্টেডিয়ামে লিডিং ই কমার্স সোসাইটি নামক একটি অনলাইন গ্রুপ দুইদিনব্যাপী একটি মেলার আয়োজন করে স্টল বানানো শুরু করে। তখন মনে হয়েছিল ৩রা মার্চ তারিখে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে যা বলা হয়েছিল তা কথার কথা। না, সেটি কথার কথা ছিল না। উক্ত ঘোষণা মতে আউটার স্টেডিয়ামে মেলাটির কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছিল জেলা প্রশাসন। শুধু বন্ধই করা হয়নি, ঐ প্রতিষ্ঠান মাঠ ভাড়া বাবদ যে টাকা জমা দিয়েছে সেটা তাদের ফেরত দেওয়া হয় এবং আরো যদি কোনও মেলার আবেদন থেকে থাকে তাহলে সেসবও বাতিল করা হয়। আরও দেখি পরবর্তীতে ১৯ মার্চ জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে কাজীর দেউড়ি আউটার স্টেডিয়ামের দুই পাশে গড়ে ওঠা স্থাপনা উচ্ছেদ শুরু করে এবং অভিযানে ১৫–২০টি স্থায়ী ও ভাসমান দোকান উচ্ছেদ করা হয়। আশান্বিত হই জেলা প্রশাসনের তড়িৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন দেখে। আসলে নাগরিক সমাজ এ ধরনের দখলদারদের বিরুদ্ধে হলেও কখনো সম্মিলিতভাবে আওয়াজ তুলতে সক্ষম হয়নি। কারণ দেখা যায় এই দখলদারদের অনেকেই রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী বা রাজনৈতিক নেতৃত্বের আশ্রয়ভুক্ত। তাই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে খেলার মাঠ দখলমুক্ত করার জন্য চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনকেই মাঠে নামতে হলো।
সম্প্রতি লক্ষ্য করি পত্রিকার পাতায় সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর বাকলিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের জলাবদ্ধ খেলার মাঠ পরিদর্শন করেছেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক। জানা যায়, তিন বছর ধরে মাঠটি ব্যবহার করতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। কারণ, মাঠের দুই–তৃতীয়াংশ এখন ডোবায় রূপ নিয়েছে। জমে থাকা পানিতে জন্মেছে কচুরিপানা ও ভাসছে ময়লা–আবর্জনা। মাঠটি আশপাশের সড়কের তুলনায় নিচু হওয়ায় পানি নিষ্কাশিত হয় না। ফলে বৃষ্টি ও জোয়ারের পানি ঢুকে মাঠটি জলাবদ্ধ হয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন ধরে পানি জমে ডোবায় পরিণত হওয়া এ মাঠটি সংস্কারে সব ধরনের সহায়তা প্রদানের আশ্বাস দেন। উনার এই পরিদর্শন ও আশ্বাসকে সাধুবাদ জানাই। কারণ মাঠটি সংস্কার হলে স্কুলের শিক্ষার্থী তথা পার্শ্ববর্তী এলাকার শিশু কিশোররা খেলাধুলা করতে পারবে। খেলাধুলা শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ তথা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। বর্তমানে আমরা লক্ষ্য করি, স্কুল ও এলাকায় মাঠের অভাবে বর্তমান প্রজন্মের শিশু–কিশোরদের খেলাধুলার চেয়েও মোবাইলে আসক্তি বাড়ছে। এভাবে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। খেলাধুলোয় যে শক্তি ক্ষয় হতো সেটা এখন ক্ষয় করছে অপরাধ চর্চার মাধ্যমে। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে জীবনযাত্রায়ও। অনেকে অল্প বয়সে মাদক সেবন করছে, আবার অনেকে জড়িয়ে পড়ছে কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে। অতএব মাঠ সংস্কারের মতো ছোট্ট উদ্যোগ একটি এলাকার শিশু কিশোরদের মধ্যে পজেটিভ পরিবর্তন আনতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি।
জেলা প্রশাসনের আরও একটি ভালো উদ্যোগ আমরা কিছুদিন আগে লক্ষ্য করলাম। ফৌজদারহাটে ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে শক্তিশালী একটি চক্রের অবৈধ দখলে থাকা প্রায় ২০০ একর খাসজমিকে পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে তুলে। নাগরিক জীবনে নির্মল আনন্দ দিতে ১২২ প্রজাতির ফুল দিয়ে যাত্রা শুরু করে ‘ডিসি ফ্লাওয়ার পার্ক’। গত ১০–১৮ ফেব্রুয়ারি, এ পার্কে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ‘ফ্লাওয়ার ফেস্টিভ্যাল ‘। আমার মনে হয় চট্টগ্রামের মানুষের প্রথম টিউলিপ ফুল দর্শন হয় উক্ত ডিসি পার্কে। ব্যস্ত নাগরিক জীবনে একটু প্রশান্তি ও স্বস্তির খোঁজে অনেক মানুষ ছুটে গিয়েছিল ঐ সময়ে। বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে যে আনন্দ লক্ষ্য করেছি তা মনে রাখার মত। জেলা প্রশাসনের এই উদ্যোগ চট্টগ্রামবাসীকে আনন্দে উদ্বেলিত করে এবং প্রশংসিত হয়।
সর্বশেষ যে উদ্যোগের কথা আমি বলব সেটি হল চট্টগ্রাম নগরকে পলিথিন মুক্ত করার অঙ্গীকার। গত ৩০ এপ্রিল চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আগামী তিন মাসের মধ্যেই চট্টগ্রামকে পলিথিনমুক্ত শহর করতে নানা উদ্যোগ নিয়েছেন। এরপর কেউ ব্যবহার করলে জরিমানার সম্মুখীন হতে হবে বলে সাবধান করা হয়। আমরা জানি বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে পলিথিন উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তিও জরিমানার বিধান রয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই আইনের কোনো প্রয়োগ আমরা লক্ষ্য করি না। ফলে চলে আসছে অবাধ পলিথিন এর উৎপাদন, বাজারজাতকরণ, এবং ব্যবহার। আইনী দুর্বলতার সুযোগে পরিবেশ বিপর্যয়ের এই উপাদান এখন বন্দরনগরীসহ সারাদেশেই সহজলভ্য। পলিথিন থেকে নির্গত বিষাক্ত পদার্থ মানবদেহের জন্য ভয়াবহ ক্ষতিকর। এছাড়াও এটি অপচনশীল হওয়ায় পরিবেশের জন্য মোটেই উপযোগী নয়। পলিথিন বর্জ্যের কারণে উর্বরতা হারাচ্ছে মাটি, বাতাসে ছড়াচ্ছে বিষ। ভরাট হচ্ছে খাল–বিল–নদী, দূষিত হচ্ছে পানি। মানুষের অবাধে ব্যবহারের পর যত্রতত্র ছুড়ে ফেলে দেয়া উচ্ছিষ্ট পলিথিন বৃষ্টির পানির সঙ্গে ড্রেনে–নর্দমায় ঢুকে পড়ে। দীর্ঘদিন ধরে পলিথিন ও প্লাস্টিক জাতীয় জিনিসের ব্যবহারে নগরের পানি চলাচলের নালা ও খালগুলো। মূলতঃ নগরের ড্রেনেজ সিস্টেম অকার্যকর হয়ে যায়। নালাগুলো ভরাটের কারণে গত কয়েক বছর বর্ষাকালে চট্টগ্রামে অল্প বৃষ্টিতেই পানি জমে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করেছি যা জনসাধারণের ভোগান্তি বাড়ায়। এসব দিকগুলো বিবেচনায় নিয়ে পলিথিন বন্ধ করাটা জরুরি। বিকল্প হিসেবে পাট অথবা কাপড়ের ব্যাগের কথা আমরা চিন্তা করতে পারি। পলিথিন বন্ধের এই মহান উদ্যোগ নেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসন ও চিঠি কর্পোরেশনের প্রতি ধন্যবাদ জানায়।
উন্নত বিশ্বে আমরা লক্ষ্য করি সরকারি বিভিন্ন সেবামূলক সংস্থাগুলো নিজেদের মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে জরুরি এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিক প্রকল্প গুলো বাস্তবায়ন করে থাকে। পলিথিন এর ব্যবহার বন্ধে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ও চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন –এ দুটি সংস্থার মধ্যে প্রাথমিক ধাপে সমন্বয়ের কারণে ধরে নিতে পারি পলিথিন বন্ধের এই উদ্যোগ আলোর মুখ দেখবে। তবে পরিবেশের বিপর্যয়ের সমস্যা থেকে জাতিকে মুক্ত করার জন্য কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা বিশেষ আইনই যথেষ্ট নয়, এজন্য দরকার দেশের সমগ্র জনসচেতনতা। শুনেছি জনসচেতনতা সৃষ্টির দায়িত্ব আপাতত সিটি কর্পোরেশনকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় গত ২০ দিনেও এ ব্যাপারে কোন দৃশ্যমান পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়নি। সিটি কর্পোরেশন এলাকায় যত হাট–বাজার আছে সেগুলোতে ভোক্তা পর্যায়ে প্রাথমিক জনসচেতনতা সৃষ্টি করে পলিথিনের ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করতে হবে। এক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরকে কাজে লাগানো যেতে পারে।
বাংলাদেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে, দেশের এগিয়ে যাওয়া দেখতে ভালো লাগে। কিছু সংখ্যক মানুষ যখন ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে দেশের সম্পদ যখন লুন্ঠন করে, অবৈধ ভোগদখলের মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ে, তখন আবার খারাপও লাগে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা আগামীতে বাংলাদেশ হবে স্মার্ট একটি দেশ। সে দেশের মানুষকেও হতে হবে স্মার্ট। দেশের এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্তগুলো হতে হবে স্মার্ট। আমরা চাই একদিকে জেলা প্রশাসন অবৈধ ভোগদখলদারদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান চলমান রাখবে। অন্যদিকে উদ্ধার হওয়া ভূমিতে পার্ক, খেলার মাঠসহ অন্যান্য পরিবেশবান্ধব স্থাপনা ও রাস্তা বানাবে সিটি কর্পোরেশন এবং অন্যান্য সরকারি সংস্থা। আগামিতে স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য বিভিন্ন পরিকল্পিত উন্নয়নের মাধ্যমে চট্টগ্রামকে স্মার্ট নগরীতে পরিণত করতে বিভিন্ন সেবামূলক সংস্থা যেমন– ওয়াসা, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, সিটি কর্পোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ সব সংস্থার সমন্বয় প্রয়োজন। প্রত্যাশা সব সংস্থার যৌথ সহযোগিতায় এগিয়ে যাবে চট্টগ্রাম, এগিয়ে যাবে দেশ।
লেখক: অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।