চট্টগ্রাম নানা কারণে অনন্য নগরী হিসেবে খ্যাত। পাহাড় পরিবেষ্টিত এই নগরীর প্রবহমান নদী ও সমুদ্র উপকূল ঘেঁষা সমভূমির কারণে বৈচিত্র্যপূর্ণ নগরী হিসেবে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তবে অনেকের অভিযোগ হাজার বছরের ঐতিহ্যের নগরী চট্টগ্রাম এখন আর আগের অবস্থায় নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, ব্যবসা–বাণিজ্যের বহুমুখী প্রসার, জনসংখ্যা, আবাসন, ব্যবসা ও শিল্প স্থাপনা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে বন্দর নগরীতে। শিল্পায়ন কিংবা নগরায়ন যেন বিষফোঁড়া হয়ে উঠেছে এই শহরের জন্য। কারণ অনেকাংশেই যথাযথ নিয়ম অনুসরণ না করে উন্নয়ন কাজের ফলে অনেক আগে থেকেই মাত্রাতিরিক্ত দূষণের শিকার এই শহর। অব্যাহত দূষণের ফলে ধুলাবালি ও ধোঁয়ার সঙ্গে বন্দর নগরীর বাতাসে বাড়ছে ব্ল্যাক কার্বনসহ নানান বিষাক্ত উপাদান, যা মানবদেহে শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগের সংক্রমণ বাড়াচ্ছে।’
গত ১৭ মে দৈনিক আজাদীতে ‘সড়কের পাশে ৫ মিনিট দাঁড়ালে পাল্টে যাবে চেহারা’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সড়কের পাশে মাত্র ৫ মিনিট দাঁড়ালে চেহারা পাল্টে যাবে। নিজেকে চেনা কষ্টকর হবে। নগরীর গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকালীন দুর্ভোগ এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে, শহরের প্রধান সড়ক হিসেবে বিবেচিত বিমানবন্দর সড়ক ধরে পথ চলা কঠিন হয়ে উঠেছে। বারিক বিল্ডিং, বন্দর, সল্টগোলা ক্রসিং, দেওয়ানহাট, টাইগারপাসসহ বিভিন্ন এলাকার অবস্থা শোচনীয়। খানাখন্দে ভরা রাস্তাটির বাড়তি আপদ ধুলো। চারপাশ অন্ধকার করে রাতে–দিনে ধুলো ওড়ে। শহরের ব্যস্ততম এলাকায় বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পটিতে জনভোগান্তি হ্রাসের চেষ্টা দৃশ্যমান নয়। রাস্তায় চার লেনের গাড়ি চলাচল নিশ্চিত করার কথা থাকলেও তা হচ্ছে না। যতটুকু রাস্তা রয়েছে তা খানাখন্দে ভরা। আগ্রাবাদ শেখ মুজিব রোডের কিছু অংশে রাস্তা ঠিক করা হলেও বেশিরভাগ অংশে বেহাল অবস্থা। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্সের রাস্তাটি ঠিক করে দেয়ার কথা থাকলেও নানা অজুহাতে সময়ক্ষেপণ করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাই সাধারণ মানুষের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হচ্ছে। স্থানীয়রা বলছেন, কোনো কোনো অংশে এত বেশি ধুলোবালি উড়ছে যে, চারপাশ অন্ধকার হয়ে থাকে। ধুলোবালির কারণে তাদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। বাসাবাড়ি বা দোকানপাটের জিনিসপত্র ধুলোময়। সারাদিন ধুলো ওড়ে। রাস্তার পাশে পাঁচ মিনিট দাঁড়ালে কিংবা বাস, রিকশা, টেক্সি ও টেম্পোযোগে এলাকায় গেলে নিজেকে চিনতে কষ্ট হয়। ধুলোয় শরীর ঢেকে যায়।
অভিযোগ আছে, রাস্তাটি ঠিক রাখার দায়িত্ব ম্যাক্স রেনকিংয়ের হলেও তারা এই ব্যাপারে উদাসীনতা দেখাচ্ছে। মাসের পর মাস শহরের প্রধান এই রাস্তাটির এমন বেহাল অবস্থা। সামনে বর্ষা আসছে। সড়কটির অবস্থা গতবারের মতো হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
আসলে চট্টগ্রাম মহানগরীর নাগরিকরা নানা রকমের দূষণের শিকার। তাঁরা জানেন, তাঁরা নিজেরা এবং তাঁদের সন্তানরা এই দূষণের কারণে এক ধীর বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নগরীতে এমন অনেক উপাদান ও পদ্ধতি বিদ্যমান, যেগুলোর সম্মিলিত প্রতিক্রিয়ায় নগরীর আবহাওয়া ক্রমশ দূষিত হচ্ছে। যে সব উপাদান বা পদ্ধতি পরিস্থিতিকে আরো ভয়াবহ করে তুলছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে সংকীর্ণ সড়ক, যানজট, মোটরযানে নিম্নমানের অথবা মবিলমিশ্রিত জ্বালানি ব্যবহার, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, পুরনো মোটরযানের অবাধ চলাচল, ঠাসাঠাসি যাত্রী পরিবহন ব্যবস্থা, খোলা ট্রাকে মাটি বালি–আবর্জনা–কয়লা বা সিমেন্ট পরিবহন, পুরনো লক্কড় ঝক্করমার্কা শিল্প কারখানা, শহরের আশেপাশে ইটের ভাটা, খোলা জায়গায় বর্জ্য–আবর্জনা পড়ে থাকা প্রভৃতি। এছাড়া আরও কিছু উপাদান নগরীর বাতাসকে ভারী করে। যেমন : আবর্জনা পোড়ানোর ধোঁয়া, সময়মতো বর্জ্য অপসারণ না করা, অব্যবস্থাপনার কারণে কঠিন বর্জ্য ফেলার স্থাপনাগুলোতে আবর্জনা খোলা অবস্থায় পচতে থাকা, অপরিকল্পিতভাবে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি এবং তা থেকে ধুলো ময়লা কাদা সৃষ্টি, খোলা জায়গায় নির্মাণসামগ্রী ফেলে রাখা, খোলা পয়ঃপ্রণালী ও নর্দমা, খোলা জায়গায় মলমূত্র ত্যাগ, কাঁচা বাজারের পচনশীল বর্জ্য এবং উন্মুক্ত জায়গায় গরু–ছাগল জবাই–তার থেকে রক্ত যত্রতত্র ছিটিয়ে পড়া।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবেশ দূষণের কারণে হৃদরোগ, স্ট্রোক ও ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায়। দূষণ জনিত মৃত্যুতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা বায়ু দূষণের, যা মোট মৃত্যুর প্রায় দুই– তৃতীয়াংশ। তাই ধুলাবালি থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আমরা বারবার বলেছি, যেখানে উন্নয়ন কাজ চলছে, সেখানে হয়তো ধূলাবালির প্রকোপ থাকা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু পুরো শহর ধুলায় আক্রান্ত হওয়ার কথা নয়। শব্দ ও বায়ু দূষণ কমানোর জন্য প্রথমেই প্রশাসনকে উদ্যোগ নিতে হবে। আমরা মনে করি, নগরীকে অবশ্যই পরিবেশবান্ধব, স্বাস্থ্যসম্মত ও বাসযোগ্য করা জরুরি। তার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ মুহূর্তে ধুলার দুর্ভোগ থেকে নগরবাসীকে রক্ষা করতে হবে।