প্রতিবছর ডিসেম্বর থেকে মে মাসের মাঝামাঝি সময়কে লবণ উৎপাদনের মোক্ষম সময় ধরা হয়। এই সাড়ে চার মাসেই উৎপাদিত লবণ দেশের ভোক্তা ও শিল্পখাতের চাহিদা মিটিয়ে থাকে। গত বছরও লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়ে উদ্বৃত্ত লবণ উৎপাদন হয়েছিল। তবে চলতি মৌসুমে গতবছরকে ছাড়িয়ে ৬২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পরিমাণ লবণ উৎপাদন হয়েছে। যা লবণ শিল্পের ইতিহাসে বিরল ঘটনা। এতে দেশের মধ্যসত্ত্বভোগী মিল মালিক সিন্ডিকেটের অপতৎপরতা মুখ থুবড়ে পড়েছে। গত দশ বছরের লবণ উৎপাদনের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতিবছরই নানারকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে চাষিদেরকে।
যেমন মধ্যসত্ত্বভোগী মিল মালিক কর্তৃক সিন্ডিকেট করে মাঠপর্যায়ে লবণের দাম কমিয়ে দেওয়া, দেদার উৎপাদন হলেও কম দেখিয়ে বিদেশ থেকে লবণ আমদানির কারণে অর্থনৈতিকভাবে প্রান্তিক চাষিদের বারবার মার খাওয়া ছাড়াও প্রকৃতির বৈরি আচরণ অন্যতম। কিন্তু অতিসম্প্রতি দেশের উপকূলে দুর্বল আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় মোখার কারণেও অনেকেই মনে করেছিলেন, লবণ চাষিরা বেশ ক্ষতির শিকার হয়েছেন। তবে সেই ধারণা একেবারেই ছিল অমূলক। কারণ ঘূর্ণিঝড় মোখার দুর্বল আঘাতে একেবারেই অক্ষত রয়েছে কক্সবাজার উপকূলের লবণ মাঠ। ঝড়ের কারণে উৎপাদিত লবণ এবং লবণের মাঠের ক্ষতির আশঙ্কা থাকলেও ভারি বর্ষণ না হওয়ায় লবণ এবং লবণের মাঠের তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। এমনকি ঘূর্ণিঝড়–পরবর্তী গত কয়েকদিনেও যথারীতি প্রচণ্ড তাপমাত্রার রোদে ফের লবণ উৎপাদনে মাঠে নামে চাষিরা। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প (বিসিক) কক্সবাজারের লবণ উৎপাদন প্রকল্পের উপ–মহাব্যবস্থাপক জাফর ইকবাল ভূঁইয়া জানান, বিগত ৬২ বছরের মধ্যে এবার সর্বোচ্চ পরিমাণে লবণ উৎপাদন হয়েছে। চলতি মৌসুমে ৬৬ হাজার একর জমিতে লবণ উৎপাদন হয়েছে প্রায় ২৩ লাখ মেট্রিক টন। বিপরীতে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল কাছাকাছি। ১৯৬১ সাল থেকে বিসিকের লবণশিল্পের আওতায় লবণ উৎপাদন শুরু হওয়ার পর থেকে এবার রেকর্ড পরিমাণ উৎপাদন হয়েছে। তিনি বলেন, দেশে এবার যে রেকর্ড পরিমাণ লবণ উৎপাদন হয়েছে, এতে লক্ষ্যমাত্রাও অর্জিত হয়েছে। তাই এবার বিদেশ থেকে লবণ আমদানির কোনো দরকার নেই।
তিনি আরো জানান, সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড়ে লবণ মাঠ এবং উৎপাদিত লবণের ক্ষতির আশঙ্কা করা হলেও বাস্তবে ভারী বর্ষণ এবং বাতাসের তীব্রতা না থাকার কারণে তেমন ক্ষতি হয়নি। তাই এবার লবণ চাষ নির্বিঘ্নভাবে চলেছে।
বিসিক জানিয়েছে, দেশের একমাত্র লবণ উৎপাদনকারী অঞ্চল কক্সবাজারের ৮ উপজেলা চকরিয়া, পেকুয়া, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, ঈদগাঁও, কক্সবাজার সদর, উখিয়া ও টেকনাফ এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও আনোয়ারা উপজেলার আংশিকসহ ৬৬ হাজার ২৯১ একর জমিতে এবার লবণ উৎপাদন শুরু করে চাষিরা। তবে গত মৌসুমের চেয়ে এবার বাড়তি তিন হাজার একর জমিতে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
বিসিকের ওই কর্মকর্তা দৈনিক আজাদীকে বলেন, বর্তমানে শতভাগ জমিতে আধুনিক পদ্ধতি (পলিথিন পদ্ধতি) অনুসরণ করে লবণ উৎপাদন হয়েছে। সনাতন পদ্ধতির চেয়ে পলিথিন পদ্ধতিতে উৎপাদন আড়াইগুণ বৃদ্ধি পায়। এমনকি সনাতনের চেয়ে পলিথিন পদ্ধতির উৎপাদিত লবণের গুণগত মানও বেশ ভাল। তাই দামও ভাল পেয়ে থাকেন চাষিরা। এবারও প্রান্তিক চাষিরা ভাল দাম পেয়েছেন। এতে তারা আর্থিকভাবে বেশ লাভের মুখ দেখেছেন।
কক্সবাজারের বৃহৎ লবণচাষি যথাক্রমে মকছুদ আহমদ, আবু তৈয়ব, নূরে হোছাইন আরিফ, শাহাব উদ্দিন, মৌলভী শহিদুল ইসলাম, জামিল ইব্রাহিম চৌধুরী, মিজানুর রহমান চৌধুরী, সরওয়ার আলম, দলিলুর রহমান, আনিছুর রহমান, মৌলভী সেলিম উদ্দিন, শোয়াইবুল ইসলাম সবুজ, হারুণুর রশিদ প্রমুখ।
এসব লবণ চাষিরা দৈনিক আজাদীকে বলেছেন, উৎপাদন মৌসুম শুরুর পর থেকে আবহাওয়া অনুকূলে পাওয়ায় দেদার লবণ উৎপাদন অব্যাহতভাবে চলেছে মাঠে মাঠে। এতে অর্ধ লক্ষাধিক প্রান্তিক চাষি, এক লাখ শ্রমিকসহ লবণের ওপর নির্ভরশীল অন্তত ১০ লাখ মানুষের মুখে হাসি ফুটেছে।