(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
বাস চলছিল। জনবহুল শহর বেইজিং এর রাজপথ দাবড়িয়ে ছুটছে ট্যুরিস্ট বাস। প্রচুর গাড়ি রাস্তায়, কিন্তু ভয়াবহ রকমের কোন জটলা নেই। সব গাড়িই সামনে চলছে। আমার মনে হলো রিক্সা বা ঠেলাগাড়ীর মতো স্লো গাড়ি না থাকার একটি বাড়তি সুবিধা বেইজিং এর চালকেরা পাচ্ছে। রাস্তায় অনাহুত কোন জট না থাকার এটি অনেক বড় একটি কারন। তরতরিয়ে গাড়ি চলা বলতে যা বুঝায় ঠিক তেমনি করে চলছে আমাদের বাস এবং অন্যান্য সব গাড়ি। মোড়ে মোড়ে ট্রাফিক সিগন্যালে কিছুক্ষণ থামতে হলেও লালবাতি সবুজ হওয়ার সাথে সাথে চাকা ঘুরতে শুরু করে। আমি বসে আছি। মন ভালো কি খারাপ তা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। ইউনিভার্সেল স্টুডিও দেখাতে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের। সেটি আর কতদূর কে জানে!
বাসটি থামলো। আমাদের নামানো হলো। ওই তো ইউনিভার্সেল স্টুডিওর বিখ্যাত গ্লোব। পৃথিবীর বুকের উপর বড় বড় হরফে লেখা ‘ইউনিভার্সেল’। এটিই ওদের লোগো। খোলামেলা জায়গায় চমৎকার করে গ্লোবটি স্থাপন করা হয়েছে। ধারে কাছে বহু লোক গ্লোব নিয়ে ছবি তুলছে। আমাদের গাইড মিজ শিন চেন ‘সবাই এখানে থাকবেন, আমি আসছি’ বলে বেশ দ্রুত চলে গেলেন। আমি বুঝতে পারছিলাম যে, তিনি টিকেট আনতে চলে গেলেন। ইউনিভার্সেল স্টুডিওর টিকেটের দাম বেশ চড়া। নানা ধরনের প্যাকেজ থাকে তাদের। থাকে হোটেল রিসোর্টে থাকা খাওয়াসহ ঘোরাঘুরির নানা আয়োজন। তবে আমাদের জন্য দিনভর ঘোরাঘুরির টিকেট নেয়া হবে। এটির দামও কম নয়। বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ৫ হাজার টাকায় এক একটি টিকেট। এটি নিয়ে দিনভর ঘোরাঘুরি করা যাবে। পার্কের বিভিন্ন রাইডসে চড়া ও খেলা যাবে। বসে বসে গল্প করা যাবে, ইচ্ছে করলে শুয়ে শুয়ে আকাশও দেখা যাবে। অর্থাৎ সারাদিন যেভাবে ইচ্ছে সময় কাটানো যাবে। ব্যাপারটি ঠিক এভাবে ঘটবে কিনা আমি জানি না, তবে একেবারে হঠাৎ করে আমার মনে হলো যে, একদিনের টিকেট নিয়ে এখানে সারামাস থেকে গেলেও কেউ খুঁজে পাবে না, বেরও করে দেয়া হবে বলে মনে হয় না। ভিতরে শত সহস্র মানুষ। কার টিকেট কতদিনের তা খোলা চোখে ধরা কঠিন। তবে কোন রাইডে চড়তে গেলে বা সুযোগ নিতে গেলে অবশ্যই ধরা পড়বে। তবে এখানে একদিন কাটানো মানে অনেকগুলো টাকা খরচ করে ফেলা। পকেটে কাড়ি কাড়ি টাকা না থাকলে ইউনিভার্সেল স্টুডিওতে বেড়ানো কঠিন। ভিতরে জিনিসপত্রের দাম প্রচুর। খাওয়া দাওয়ার দামও অনেক চড়া। রাইডগুলোর টিকেটের দামও খুব একটা কম নয়। তবে একই সাথে সব রাইডে চড়ার প্যাকেজ কিনে নিলে তুলনামূলকভাবে কম পড়ে।
আমাদের গাইড টিকেট কিনতে গিয়েছেন। নিশ্চয় তিনি একদিনের টিকেট কিনবেন। তবে রাইডসহ প্যাকেজ নেবেন নাকি ভিতরে ঢুকে আমাদের গলাকাটা দামের কবলে পড়তে হবে কে জানে! সব রাইডে না চড়লেও কিছু কিছু বিষয়তো দেখতে হবে। ওগুলো যদি প্যাকেজে না থাকে তাহলে বেশ চড়া দামে টিকেট কিনতে হবে। ইউনিভার্সেল স্টুডিওর চারপাশ দারুণ করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। মন ভালো করে দেয়ার জন্য এমন একটি স্থানই যথেষ্ট। এখানে ঘোরাঘুরি করে কফি টফি খেয়ে চলে গেলেও খারাপ লাগবে না। তাই গাইড কি ধরনের টিকেট কিনছেন বা আমাদের প্যাকেজে কি কি আছে তা নিয়ে আমার খুব বেশি মাথাব্যথা ছিল না। আমাদেরকে কী কেবল ভিতরে ঢুকিয়ে একটু ঘুরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে, নাকি সবকিছু দেখিয়ে চড়িয়ে তারপর বের করা হবে কে জানে!
গাইড মিজ শিন চেন ছুটতে ছুটতে হাজির হলেন। যেনো সবকিছু দেরি হয়ে গেছে এমনভাবে তিনি তাড়াহুড়ো করছিলেন। তার হাতে অনেকগুলো টিকেট, ব্যান্ড। তিনি আমাদের প্রত্যেকের হাতে একটি করে ব্যান্ড পরিয়ে দিলেন। বাম হাতে ঘড়ির পাশে কাগজের রঙিন ব্যান্ডটি বেশ দেখাচ্ছিল।
গাইড শিন চেন যা বললেন তার সোজা বাংলা করলে এটুকু দাঁড়ায় যে, হাতের ব্যান্ডটি খুব যত্নে রাখতে হবে। এটিই যেনো ছিঁড়ে বা হারিয়ে না যায়। পানিতে ভিজলেও এটি নষ্ট হবে না। শুধু হাত থেকে যেনো পড়ে না যায় সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে। এই টিকেট নিয়ে আমরা শুধু গেট পার হয়ে ভিতরে ঢুকতে পারবো। কিন্তু কোন রাইডে চড়তে বা কোন কিছু দেখতে হলে আমাদেরকে ব্যান্ড দেখাতে হবে। এই ব্যান্ডে বিভিন্ন রাইডে চড়া এবং থ্রি ডি মুভি কিংবা জুরাসিক পার্কসহ নানা কিছু দেখা ও ঘোরার ব্যবস্থা রয়েছে। তাই ব্যান্ডটি বেশ মূল্যবান।
আমরা সবাই ভিতরে ঢুকলাম। এটি যেনো অন্য একটি জগত। আমেরিকার হলিউডের ইউনিভার্সেল স্টুডিও পুরোটা তুলে এনে যেনো এখানে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। পাম্প গাছটিও যেনো একইভাবে স্থাপন করা। আমি চমকিত হলাম, পুলকিত হলাম। আসলেই প্রযুক্তি বহুদূর চলে গেছে। প্রশান্ত মহাসাগরের ওপারের হলিউড চীনের বেইজিং এ!!!
গাইড আমাদের একটি সময় নির্দিষ্ট করে দিয়ে বললেন, আমরা একসাথে থাকার চেষ্টা করবো। তবুও কেউ যদি দলছুট হয়ে পড়ি তাহলে এই স্থানটিতে এসে অপেক্ষা করবো। ওই সময়ই আমাদের বাস যাত্রা করবে। সবাইকে ঠিকঠাকভাবে সময়কিছু এনজয় করার জন্য আহবান জানিয়ে সামনে হাঁটলেন তিনি।
আমি যেনো চেনা জায়গা ধরে হাঁটছিলাম। সবকিছু যেনো চিনি, জানি। রোলার কোস্টারের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আমার কলজে আচমকা মোচড় দিয়ে উঠলো। হলিউডে এই রোলার কোস্টারে চড়েছিলাম। জীবনে এমন ভয়ংকর অভিজ্ঞতা আর কখনো আমার হয়নি। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, আমাকে উলট পালট করে যেভাবে ঝড়ের বেগে ছুটানো হচ্ছিল তা যদি আর মাত্র মিনিট খানেক করা হতো তাহলে আমার হার্ট এ্যাটাক হয়ে যেতো! ওরে বাবরে, রোলার কোস্টারেও মানুষ চড়ে! অথচ এখানেও অসংখ্য মানুষ এই কোস্টারে চড়ে সমস্বরে চিৎকার করছে! কিশোরদের পাশাপাশি বহু তরুণ তরুণী রোলার কোস্টার এনজয় করছে। তবে বয়স্ক কাউকে তেমন একটা দেখা গেলো না। অবশ্য চীনে কে যে বয়স্ক আর কে যে তরুণ তা বুঝা বেশ কঠিন। স্বাস্থ্য সচেতন মানুষগুলো নিজেদের বয়সকে জাস্ট একটি সংখ্যায় পরিণত করেছেন। ৬০ বছরের বুড়ো কিংবা বুড়িকেও মনে হচ্ছে নবদম্পতি! (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।