আর পাঁচটি বছর বাঁচলে নিজের জন্মশতবর্ষটি দেখে যেতে পারতেন। তিনি শতায়ু হবেন এটাই আশা ছিল আমাদের। বাঙালি শতায়ু হন কম। ৯৯ পর্যন্ত গেছেন অনেকে। অন্নদাশংকর রায়, লীলা মজুমদার, নীরদচন্দ্র চৌধুরী, বিজয়া রায়। সেঞ্চুরি ‘আর’ করা হয় না। সত্যজিৎ–ঋত্বিক চলে যাবার পর বাংলা চলচ্চিত্রের অভিভাবক ছিলেন মৃণাল। ঋত্বিক ঘটক চলে যান ৫১ বছর বয়সে। সত্যজিৎ রায় মাত্র ৭১। মৃণাল সেন দীর্ঘসময় ধরে ছায়া দিয়ে গেছেন উপমহাদেশের চলচ্চিত্রে।
বাংলা চলচ্চিত্রের ত্রয়ী প্রধান সত্যজিৎ–ঋত্বিক–মৃণাল। কেবল বাংলা চলচ্চিত্র নয়, সমগ্র উপমহাদেশের চলচ্চিত্র সাবালক হয়েছে, বিশ্ব পরিচিতি পেয়েছে এই তিনজনের চলচ্চিত্রের কল্যাণে। পশ্চিমা প্রচার মাধ্যম (আমাদের এতদঅঞ্চলেরও) কেবল সত্যজিৎ রায়কে ফোকাস করেছেন বেশি। কিন্তু সারা বিশ্বের প্রাগ্রসর চলচ্চিত্র অনুরাগীদের কাছে তিন জনেরই কদর।
স্বভাবতই তিন জনের নির্মাণ আঙ্গিক সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। বিশেষ করে মৃণাল সেনের ভূমিকা এক্ষেত্রে একটু অগ্রসর বিভিন্ন কারণে। একে তো তিনি অত্যন্ত রাজনীতি সচেতন ছিলেন, রাজনৈতিক বক্তব্য তাঁর সিনেমায় অত্যন্ত জোরালোভাবে প্রকাশিত হতো। দ্বিতীয়ত নিজেকে নির্দিষ্ট কোনো সীমারেখায় আবদ্ধ করে রাখতে চাইতেন না। বাংলা ছাড়া হিন্দি, ওড়িয়া, তেলুগু, মারাঠি ভাষায় ছবি করেছেন।
ছবিগুলি করেছেন স্ব স্ব জায়গায় গিয়ে। বহুভাষী ছবি করেছেন দু’টি। জেনেসিস (১৯৮৬) হিন্দি, ফরাসি ও ইংরেজি ভাষায়। ইচ্ছাপূরণ (১৯৬৯); বাংলা, হিন্দি ও মারাঠিতে।
যে ছবিটি হিন্দি সিনেমায় নবতরঙ্গ আন্দোলনের সূচনা করে, সেই ‘ভুবন সোম’ মৃণাল সেন নির্মাণ করেন ১৯৬৯ সালে। এ–ছবির মধ্য দিয়ে হিন্দি চলচ্চিত্রে নব জাগরণের সূত্রপাত ঘটে এবং অনেকে এ–ঘটনাকে প্যারালাল হিন্দি সিনেমার সূচনা বলেও উল্লেখ করেছেন। মৃণালের দেখানো পথ ধরে একে একে এগিয়ে আসেন শ্যাম বেনেগাল, এম এস সথ্যু, মনি কাউল, গোবিন্দ নিহালনি, কুমার সাহানি, কেতন মেহেতা, সৈয়দ আখতার মির্জা, রবীন্দ্র ধর্মরাজসহ আরো অনেকে। ভুবন সোম ছবির নেপথ্যের ধারাভাষ্যকার ছিলেন সে–সময়ের উঠতি অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন। মূল ভূমিকায় অভিনয় করেন উৎপল দত্ত ও সুহাসিনী মূলে। কোনো ধরনের রূপসজ্জা ছাড়া অত্যন্ত সাদামাটাভারে অভিনয় শিল্পীদের উপস্থাপন করেছিলেন মৃণাল তাঁর ‘ভুবন সোম’ ছবিতে যার প্রকৃষ্ট প্রভাব আমরা দেখি উপর্যুক্ত পরিচালকদের ছবিতে। আরও একটি বিষয় এঁদের ছবিতে লক্ষণীয় ছিল, গ্ল্যামারহীন অভিনয় শিল্পী নির্বাচন, যা মৃণাল সেনের বড় বৈশিষ্ট্য। চরিত্রানুগ অনেক অভিনয়শিল্পী তিনি আবিষ্কার করেছেন; যাঁদের মধ্যে মাধবী মুখোপাধ্যায়, রণজিৎ মল্লিক, মিঠুন চক্রবর্তী, মমতা শংকর, অঞ্জন দত্ত, শ্রীলা মজুমদার অন্যতম। তেমনিভাবে উপর্যুক্ত পরিচালকেরাও (বিশেষ করে শ্যাম বেনেগালই আবিষ্কার করেছেন; শাবানা আজমী, নাসিরুদ্দিন শাহ, অনন্ত নাগ, ওমপুরী, স্মিতা পাতিল, সাধু মেহের, দীপ্তি নাভাল, কুলভূষণ খারবান্দার মতো যুগন্ধর অভিনয়শিল্পীদের। সব মিলে হিন্দি সিনেমায় মৃণাল সেনের ভুবন সোমের পথ ধরে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ধারার প্রচলন ও বিকাশ ঘটে। এতে দুঃখজনকভাবে সত্যি, সে–ধারা আজ প্রায় রুদ্ধ।
মৃণাল সেন মধ্যবিত্ত, মানসিকতার মন্দ দিকের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছেন তাঁর চলচ্চিত্রে। ম্যধবিত্তের ঠুনকো মূল্যবোধের অসারতা, ভন্ডামি, পরস্পর বিরোধিতা, প্রপষ্ণকতা–শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিভিন্নভাবে এসেছে তাঁর ছবিতে। ১৯৫৫ সালে ‘রাতভোর’ পরিচালনার মধ্য দিয়ে যে যাত্রার শুরু ২০০২ সালে ‘আমার ভুবন’ নির্মাণের মধ্য দিয়ে সে যাত্রার শেষ। দীর্ঘ ৪৬ বছরের অভিযাত্রায় তৈরি করেছেন ২৭টি কাহিনীচিত্র, ১৪টি টেলিফিল্ম এবং ৩টি প্রামাণ্যচিত্র। ২টি চিত্রনাট্য লিখেছেন অন্য পরিচালকের ছবিতে। শেষ ১৭ বছরে আর সিনেমা তৈরি করেননি। লেখালিখি করেছেন কিছু। স্ত্রী গীতা সেনের মৃত্যু (১৬ জানুয়ারি ২০১৭) তাঁকে সঙ্গীহীন করে তোলে। গীতা ছিলেন একজন যশশ্বী অভিনেত্রী। তারও চেয়ে বড় কথা মৃণাল সেনকে মৃণাল সেন করে তোলার নেপথ্যে ছিল গীতা সেনের (সোম) ষোল আনা ত্যাগ, তিতিক্ষা এবং পরিচর্যা। গীতা ছিলেন মৃণালের প্রাণপ্রিয় প্রেমিকা এবং সর্বার্থেই সহধর্মিনী। গীতার প্রয়াণের প্রায় দুই বছর পর ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর মৃণাল চলে যান অনেকটা নিঃসঙ্গ অবস্থায়। বিজ্ঞানী পুত্র কুনাল সুদীর্ঘকাল ধরে মার্কিন প্রবাসী।
মৃণাল সেনের জন্ম ১৯২৩ সালের ১৪ মে বাংলাদেশের ফরিদপুর শহরে। ফরিদপুরে মাধ্যমিক পড়াশোনার শেষে কলকাতায় চলে যান দেশভাগের বেশ আগেই। সেখানে স্কটিশচার্চ কলেজ থেকে পদার্থ বিদ্যায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করে কিছুদিন মেডিকেল রিপ্রেজেটেটিভের কাজ করার পর চলচ্চিত্রকারের সংগ্রামী জীবন শুরু হয় তাঁর আক্ষরিক অর্থেই। পরিচালনার পূর্বে টেকনিশিয়ানের কাজও করেন তিনি। দ্বিতীয় ছবি নীল আকাশের নীচে (১৯৫৯) তাঁকে পায়ের তলার মাটি এনে দেয়। এসময় তাঁকে বড় সহযোগিতা করেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। নীল আকাশের নীচের প্রযোজক ও সংগীত পরিচালক ছিলেন হেমন্ত। ছবিটি যথেষ্ট বাণিজ্য সফলতা পেয়েছিল যার জের ধরে ধীরে ধীরে মৃণালের উত্থান। তবে তৃতীয় ছবি বাইশে শ্রাবণ (১৯৬০) মৃণাল সেনের প্রকৃত সত্তা উন্মোচিত করে। যার সমুজ্জ্বল ধারাবাহিকতা আমার ভুবন (২০০২) পর্যন্ত।
শেষ ছবি আমার ভুবন তিনি করেছিলেন ২০০২ সালে। এটি তাঁর অন্য ছবিগুলোর চাইতে সম্পূর্ণ আলাদা। বক্তব্যে, গড়নে, চরিত্র বুননে। মাত্র তিনটি মুখ্য চরিত্রের বিন্যাসে শেষের ছবিটি তিনি নির্মাণ করেছিলেন। আফসার আমেদের উপন্যাস অবলম্বনে ছবিটি গড়ে উঠেছিল পশ্চিম বাংলার গ্রামীণ মুসলমান সমাজের জীবনবৃত্তকে ঘিরে। মৃণাল সেনের পরিণত বয়সের জীবন দর্শন তুলে ধরে এ ছবি।
বাংলাদেশের ফরিদপুরে জন্ম ও বেড়ে ওঠা হলেও এটা নিয়ে খুব একটা নস্টালজিক ছিলেন না। আন্তর্জাতিকতায় বিশ্বাসী ছিলেন সারাজীবন। তাঁর কথায় ‘অত নস্টালজিকতা ভালো নয়। নস্টালজিয়া চলে যায় সেন্টামেন্টালিজমের দিকে। সেন্টামেন্টালিজম থেকে এসে যায় একটা মিথ্যাচরণ। মৃণাল সেন বলেছিলেন, ‘আমি অভিনেতা অভিনেত্রীদের ক্রিপ্ট দিই না, পড়ে শোনাই, কারণ আমি সব সময়ই বদলাতে থাকি’। পরিবতর্নশীলতা সৃষ্টিশীলতার অন্যতম একটি শর্ত। এটা মৃণাল সেনের মধ্যে বেশি পরিমাণেই ছিল।
আপাতদৃষ্টিতে মৃণাল সেনকে বেশ ডাকসাইটে মনে হলেও অত্যন্ত গোছানো ছিলেন ব্যক্তিজীবন ও শিল্পীজীবন উভয় ক্ষেত্রে। অনেকে বলেন এর নেপথ্যে গীতা সেনের বড়ো ভূমিকা ছিল। মৃণাল সেনও মজা করে বলতেন, ‘এক সোম জীবন দিয়েছে, অন্য সোম প্রতিষ্ঠা।’ প্রথম সোম হলেন গীতা সোম (সেন), অন্যজন ‘ভুবন সোম’। তাঁর জীবনে অসমাপ্ত কিংবা পরিত্যক্ত কোনো কাজ নেই, ‘ভুবনেশ্বরী’ নামের একটি ছবির কাজ তিনি প্রাথমিক পর্যায়ে শুরু করে অনিবার্য কারণে সুটিং শুরু করেননি। দিলীপকুমারকে মনোনীত করেছিলেন মুখ্য চরিত্রে। একমাত্র এটাকেই তাঁর না করা কাজ বলা যেতে পারে।
মৃণাল সেন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত চলচ্চিত্রের আখ্যান তৈরির জন্য গেছেন সাহিত্যের কাছে। বিভিন্ন ভাষার কথা সাহিত্য তাঁর চলচ্চিত্রে মূর্ত হয়ে উঠেছে। উর্দু, হিন্দি গলা নিয়ে ছবি করেছেন বাংলা, ভেলুগুতে। তেমনি বাংলা গল্প ছবি করেছেন হিন্দি, মারাঠি, ইংরেজি ও ফরাসিতে। বৈশ্বিকতায় বিশ্বাসী এই শিল্পী ঘর এবং বাহিরকে একাকার করতে চেয়েছেন তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে।
চলচ্চিত্র সাহিত্যেও মৃণাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে গেছেন। লিখেছেন চলচ্চিত্র বিষয়ক বেশ কয়েকটি গ্রন্থ। লিখেছেন আত্মজীবনী। অন্যদের জন্যে চিত্রনাট্য লিখেছেন। চলচ্চিত্র মাধ্যম ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে চর্চা করেননি। আপাদমস্তক একজন চলচ্চিত্রকার।
এই মহান শিল্পীর সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পেয়েছিলাম তিনবার। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সঞ্চয়।
১৪ মে ২০২৩, মৃণাল সেনের শতবর্ষ পূর্ণ হলো। স্মরণীয় এই দিনে তাঁকে জানাই সশ্রদ্ধ প্রণাম, সকৃতজ্ঞ ভালোবাসা।