ঘূর্ণিঝড় মোখা সুপার সাইক্লোন হবে আশঙ্কা করা হচ্ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত তা কক্সবাজার উপকূল ছুঁয়ে গেছে। মোখার মূল ঝাপটাটি গেছে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের উপর দিয়ে। বাংলাদেশের উপকূল ছুঁয়ে যাওয়ার সময় এটি প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনকে তছনছ করে দিয়ে গেছে।
কক্সবাজার, রামু ও টেকনাফ প্রতিনিধি জানান, ঘূর্ণিঝড় মোখা তার গতিপথ পরিবর্তন করে মিয়ানমারের উপকূল হয়ে স্থলভাগে আঘাত হানলেও শেষ রক্ষা হয়নি সেন্টমার্টিনের। গতকাল দুপুর ২টা ২০ মিনিট থেকে সেন্টমার্টিনে ১২১ কিলোমিটার ও টেকনাফে ১১৫ কিলোমিটার বেগে অতিক্রম করছে মোখা। সেখানে গাছ চাপায় এক নারী আহত হলেও আর কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। ঘূর্ণিঝড়ে কক্সবাজারে ১২ হাজার বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জেলা প্রশাসন জানিয়েছে। এর মধ্যে ১০ হাজার আংশিক, ২ হাজার ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। সেন্টমার্টিনে ১২০০ কাঁচাঘর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। বেশকিছু গাছপালা ভেঙে গেছে। সবার সহযোগিতার কারণে লোকজন ব্যাপক হারে আশ্রয় কেন্দ্রে চলে আসায় হতাহত হয়নি বলে জানান কক্সবাজার জেলা প্রশাসক। সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান জানান, গতকাল রোববার সকাল থেকে শুরু হওয়া ঝড়ো হওয়া দুপুর ১টার পর থেকে তীব্র হতে থাকে। বিকাল ৪টার পর থেকে বাতাসের তীব্রতা কমে বৃষ্টিপাতের মাত্রা বাড়তে থাকে। এই পুরো সময়ে দ্বীপের ১২ শতাধিক আধাপাকা টিনশেড ঘর, ছোট্ট মানের কটেজ বাতাসে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। দ্বীপের ৭৫ শতাংশ গাছ ভেঙে ক্ষত–বিক্ষত হয়ে গেছে। সাগরের পানি স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে একটু বেশি হলেও কোথাও প্লাবিত হয়নি।
সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের সদস্য খোরশেদ আলম জানান, দ্বীপের পূর্ব পাশে অবস্থিত বাজারের অধিকাংশ দোকান বাতাসে উড়ে গেছে। গাছ চাপায় এক নারী আহত হলেও আর কেউ হতাহত হয়নি। তবে বেশ কয়েকজন আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ডের সদস্য ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আলম।
সেন্টমার্টিনের বাসিন্দা ট্রলার মালিক সমিতির সাবেক নেতা আবু তালেব জানিয়েছেন, আগে থেকে আঘাতের যে তথ্য প্রচার হয়েছে তার মতো আঘাত না হলেও দ্বীপকে ক্ষত–বিক্ষত করে দিয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে দ্বীপের দক্ষিণ–পূর্ব অংশে। যেখানে ব্যাপক সংখ্যক গাছ ছাড়াও আধা পাকা, টিনশেড সব ঘর ভেঙে গেছে। উড়ে গেছে ছাউনি। মোখার আঘাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি সেন্টমার্টিন দ্বীপে হয়েছে বলে স্বীকার করে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, সেন্টমার্টিনের চেয়ারম্যান ও সেখান থেকে পাওয়া প্রাথমিক তথ্যমতে দ্বীপের ৭৫ শতাংশ গাছ ছাড়াও ১২ শতাধিক ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। এ পর্যন্ত কোনো হতাহতের তথ্য পাওয়া যায়নি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর দ্বীপে গিয়ে ক্ষতির সার্বিক চিত্র বা পরিমাণ জানা যাবে।
তিনি জানান, দ্বীপে আশ্রয় কেন্দ্রে থাকা মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান নিতে বলা হয়েছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় আশ্রয় কেন্দ্র ত্যাগের অনুমতি দেয়া হবে। আশ্রয় কেন্দ্রে খাবার, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহে সংশ্লিষ্টরা কাজ করছেন।
জানা যায়, সেন্টমার্টিন দ্বীপের গলাচিপা এলাকায় পরিবেশ অধিদপ্তরের গবেষণা প্রতিষ্ঠান মেরিন পার্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উড়ে গেছে স্থাপনার ছাউনি। ভেঙে গেছে সোলার প্যানেলগুলো।
বঙ্গোপসাগরের মধ্যে ৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের দ্বীপ সেন্টমার্টিনের লোকসংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। এর মধ্যে গত শুক্রবার দুপুরের মধ্যে প্রায় হাজারখানেক মানুষ দ্বীপ ছেড়ে টেকনাফে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য চলে যান। বাকিদের মধ্যে ৫ হাজারের মতো মানুষ দুটি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রসহ দ্বীপের ৩৭টি হোটেল রিসোর্ট–কটেজে ঠাঁই নেন।
উপকূলজুড়ে তাণ্ডব : কক্সবাজার জেলার উপকূলজুড়ে ঘূর্ণিঝড় মোখা তাণ্ডব চালিয়েছে। এই তাণ্ডবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে সেন্টমার্টিন দ্বীপে। তবে আঘাতের কবলে পড়েছে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, সাবরাং, টেকনাফ পৌরসভা, সদর ইউনিয়ন, বাহারছড়া ইউনিয়ন, উখিয়ার জালিয়াপালং ইউনিয়নের ইনানী, পাটুয়ারটেক, সোনাপাড়া এলাকা। ব্যাপক সংখ্যক ঘর ও গাছ ভেঙে গেছে।
টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান নুরুল আলম জানান, টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, সাবরাং, টেকনাফ পৌরসভা, সদর ইউনিয়ন, বাহারছড়া ইউনিয়নের গাছের উপর তাণ্ডব চালিয়েছে মোখা। এসব এলাকার ৩০ শতাংশ গাছ ভেঙে গেছে। এছাড়া বহু ঘর ভেঙে গেছে। এর সংখ্যা নির্ধারণে কাজ চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, সেন্টমার্টিন বাদ দিলে টেকনাফ উপজেলায় কম হলেও এক হাজার ঘর ভেঙে গেছে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান জানান, প্রাথমিক তথ্যমতে ব্যাপক সংখ্যক গাছ ভেঙে গেছে। জেলায় ১২ হাজার ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে, যার মধ্যে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত ঘর ২ হাজারের বেশি। এর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন মিলে ক্ষতির পরিসংখ্যা নির্ধারণে কাজ শুরু হয়েছে। তবে এর সঠিক চিত্র পেতে সময় লাগবে। একই সঙ্গে জোয়ারের পানিতে নতুন করে বেড়িবাঁধের কিছু এলাকাও ভেঙে গেছে বলে জানা গেছে। তা নির্ধারণেও পানি উন্নয়ন বোর্ড কাজ শুরু করেছে।
কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ড. তানজির সাইফ আহমেদ জানান, কক্সবাজারে ৫৯৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ৩২ কিলোমিটার অরক্ষিত ছিল আগে থেকেই। এই ৩২ কিলোমিটারের বাইরে কোনো অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিনা দেখা হচ্ছে। তিনি জানান, মোখা যতটুকু আঘাত আনার কথা তা হয়নি। তার কারণ আঘাত আনার সময়টি ভাটা এবং পূর্ণিমা–অমাবস্যার মধ্যে সময়কাল। তার সাথে ঢেউয়ের বিপরীত দিকে বাতাসের দিক হওয়া ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা কমেছে।
কক্সবাজার আঞ্চলিক আবহাওয়া কার্যালয়ের প্রধান (ভারপ্রাপ্ত) আবহাওয়াবিদ আব্দুর রহমান জানান, রোববার বিকাল ৩টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় কক্সবাজারে ১৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রের্কড করা হয়েছে। এরপর বৃষ্টির তীব্রতা বেড়েছে।
টেকনাফ উপজেলার শাহপরীর দ্বীপ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া কয়েকজন অভিযোগ করেন, তারা ঠিকভাবে খাবার পাননি। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট আশ্রয় কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ও একাডেমিক সুপারভাইজার নুরুল আবছার বলেন, দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে ওই সময়ে খাবার পৌঁছানো সম্ভব হয়নি।
এদিকে কক্সবাজারের বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়া তিন লাখ মানুষ বিকাল ৫টা থেকে আশ্রয় কেন্দ্র ছেড়ে ফিরে যেতে শুরু করেছেন।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ও ঘূর্ণিঝড় নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের প্রধান বিভীষণ কান্তি দাশ জানিয়েছেন, এত দ্রুত আশ্রয় কেন্দ্র না ছাড়ার জন্য বলা হয়েছে। পরিস্থিতি আরও উন্নত হলে এদের ঘরে পৌঁছে দেয়া হবে।