আল–কাদির ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তান তেহরিক–ই–ইনসাফ (পিটিআই) চেয়ারম্যান ইমরান খানের আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। গত মঙ্গলবার ইসলামাবাদ হাইকোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ইমরানকে নাটকীয়ভাবে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানের ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টেবিলিটি ব্যুরো–এনএবি। তাকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় দেশজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে পেশোয়ারে চারজন নিহত হয়েছে। গ্রেপ্তার হয়েছে হাজারেরও অধিক পিটিআই নেতাকর্মী। এদিকে দুদিন ধরে দেশজুড়ে চলা দলটির প্রতিবাদ–বিক্ষোভকে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ বলে কড়া সমালোচনা করেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ। প্রায় একই কথা বলে কঠোর হুঁশিয়ারি করেছে দেশটির সেনাবাহিনীও। পিটিআই কর্মীদের সেনা সম্পত্তি ও সেনা স্থাপনায় হামলার ঘটনাকে দেশটির ইতিহাসের কালো অধ্যায় বলে বর্ণনা করেছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। খবর বিডিনিউজের।
গ্রেপ্তারের পরদিন গতকাল বুধবার তেহরিক–ই–ইনসাফ নেতাকে ইসলামাবাদের পুলিশ লাইনসে স্থাপন করা একটি অস্থায়ী আদালতে তোলা হয়। আদালতে এনএবি ইমরানকে ১৪ দিনের জন্য রিমান্ডে চেয়েছিল। পরে আদালত আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে বলে জানায় পাকিস্তানের ইংরেজি ভাষার সংবাদ মাধ্যম ডন। আল–কাদির ট্রাস্ট মামলায় এনএবির ১৪ দিনের রিমান্ড আবেদনের বিরোধিতা করে পিটিআই চেয়ারম্যানের আইনজীবী খওয়াজা হারিস বলেন, যে মামলায় ইমরানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সেটি ব্যুরোর আওতার মধ্যে পড়ে না। তিনি বলেন, এনএবি এমনকি তাদের তদন্ত প্রতিবেদনও দেখায়নি। প্রত্যেকেরই ন্যায় বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। তিনি উন্মুক্ত আদালতে শুনানির আবেদনও করেন। এনএবির কৌঁসুলি আদালতে বলেন, গ্রেপ্তার করার সময় ইমরানকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দেখানো হয়েছিল। প্রয়োজনীয় নথিপত্র দেওয়া হবে বলেও তিনি ইমরানের আইনজীবীকে আস্বস্ত করেন। তিনি বলেন, এটি দুর্নীতির মামলা এবং যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি এর তদন্ত করেছে।
দেশজুড়ে তুমুল বিক্ষোভ–সংঘর্ষ : ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় দেশজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে পেশোয়ারে চারজন নিহত হয়েছে। পেশোয়ারের লেডি রিডিং হাসপাতালের মুখপাত্র মুহাম্মদ অসীম পাকিস্তানের দৈনিক ডন কে এ খবর জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আহত ৮৪ জনের বেশি মানুষকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাদেরকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় পাঞ্জাবে সেনা মোতায়েন হয়েছে। সেখানে এক হাজারের বেশি পিটিআই সমর্থককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
রাজধানী ইসলামাবাদেও ব্যাপক বিক্ষোভ–সংঘর্ষ হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা পুলিশ সদরদপ্তরের বাইরে বিক্ষোভ করেছে, যেখানে ইমরানকে পুলিশ হেফাজতে রাখা হয়েছে। বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছুড়েছে। সদরদপ্তরের বাইরে জড়ো হওয়া বিক্ষোভকারীদের গ্রেপ্তারও করেছে পুলিশ। করাচিতে পুলিশ কর্মকর্তাদের ওপর চড়াও হওয়া বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিন্ধু সরকারের মুখপাত্র। তিনি জানান, পিটিআই সমর্থকরা রাষ্ট্রের সম্পত্তি ভাঙচুর করেছে, পুলিশ ভ্যানে আগুন দিয়েছে এবং খালি একটি রেঞ্জার্স ফাঁড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দিতে রাজধানী ইসলামাবাদেও সেনা মোতায়েন করা হচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় সেনা মোতায়েনের অনুমতি দেওয়ার পর ইসলামাবাদের কয়েকটি জায়গায় সেনা উপস্থিত হচ্ছে বলে জানিয়েছে রাজধানী পুলিশ। পুলিশের এক টুইটে বলা হয়েছে, আইন–শৃঙ্খলা রক্ষায় ঘটনাস্থলে রয়েছে রেঞ্জার এবং সশস্ত্র বাহিনী।
কঠোর বার্তা প্রধানমন্ত্রী ও সেনাবাহিনীর : পাকিস্তানের দৈনিক ডন জানায়, দেশজুড়ে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্যে শাহবাজ বুধবার জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। এ ভাষণেই তিনি পিটিআইকে এক হাত নিয়েছেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাস খুবই তিক্ত। আর রাজনীতিতে প্রতিশোধ প্রবণতা কখনোই ভাল ফল বয়ে আনেনি। রাজনৈতিন নেতৃত্বের আসল ভূমিকা এবং দায়িত্ব হচ্ছে কোনোরকম গ্রেপ্তারের সময় দলের কর্মীদের আইনি সীমা পেরুতে না দেওয়া। রাজনৈতিক একজন কর্মী হিসাবে আমরা কোনও গ্রেপ্তারের ঘটনায় আনন্দ প্রকাশ করতে পারি না। এটি জীবনের একটি তিক্ত অধ্যায় যার মধ্য দিয়ে আমাদের পার হতে হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী গ্রেপ্তার হওয়ার পর পিটিআই এবং দলের চেয়ারম্যান ইমরান খান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে শত্রুতায় নেমে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছে বলে শাহবাজ অভিযোগ করেন। সরকারি সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত করাকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং দেশের বিরুদ্ধে শত্রুতা আখ্যা দেন তিনি। সন্ত্রাসী এবং রাষ্ট্রের শত্রুদের দৃষ্টান্তমূল শাস্তি দেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ার করে দেন শাহবাজ।
অন্যদিকে গতকাল আইএসপিআর এক বিবৃতিতে বলে, ইমরান খানকে ইসলামাবাদ হাই কোর্ট থেকে এনএবি নিজস্ব আইন অনুসারে গ্রেপ্তার করে। তার পরপরই সেনাবাহিনীর সম্পত্তি ও স্থাপনায় হামলা চালানো হয় এবং সেনাবাহিনী বিরোধী স্লোগান দেওয়া হয়। রাজনৈতিক পোশাক পরে ক্ষমতার লালসায় ওই দলটি সেনাবাহিনীর যে ক্ষতি করছে সেটা ৭৫ বছরে শত্রুরাও করতে পারেনি বলেও ওই বিবৃতিতে ক্ষোভ ঝাড়া হয়।
বলা হয়, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে সেনাবাহিনী ধৈর্য ও সংযম দেখিয়েছে এবং চরম সহনশীলতা প্রদর্শন করেছে, এমনকি নিজেদের সুনামের পরোয়াও করেনি। দেশের চলমান পরিস্থিতিকে ঘৃণ্য পরিকল্পনা বলে বর্ণনা করে একে সেনাবাহিনীকে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানাতে উসকানোর জঘন্য প্রচেষ্টা বলা হয়েছে। সেনাবাহিনীর পরিপক্ক প্রতিক্রিয়া ওই ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দিয়েছে। আমরা ভালো করেই জানি, এর পেছনে কিছু অশুভ দলীয় নেতৃত্বের নির্দেশ রয়েছে এবং সম্পূর্ণ পূর্ব পরিকল্পিত। এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের হুঁশিয়ারিও উচ্চারণ করেছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। জনগণকে আইন হাতে তুলে নেওয়ার উস্কানি দেওয়ার সুযোগ কাউকে দেওয়া হবে না।