পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে গ্রেপ্তার এবং তার দল পাকিস্তান তেহরিক–ই–ইনসাফ (পিটিআই) থেকে দেশজুড়ে বিক্ষোভের ডাক দেশটির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এক মামলার শুনানিতে অংশ নিতে যাওয়ার সময় ইসলামাবাদ হাই কোর্টের সামনে থেকে গতকাল ইমরান খান গ্রেপ্তার হন। এরপরই রাজধানীতে জারি করা হয় ১৪৪ ধারা। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ না পেলে পাকিস্তান দেউলিয়া হয়ে পড়ার আশঙ্কার মধ্যেই দেশটিতে নতুন করে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দিল। পাকিস্তানে ২২ কোটি মানুষ ডলারের সংকটে আছে। মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে ৩৬ শতাংশের ওপরে চলে গেছে। আইএমএফের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার প্যাকেজ পেতেও মাসের পর মাস দেরি হচ্ছে। খবর বিডিনিউজের।
অর্থনৈতিক মন্দা : মুদ্রাস্ফীতি সামাল দিতে পাকিস্তানের সেন্ট্রাল ব্যাংক সুদের হার রেকর্ড ২১ শতাংশ বাড়ানোয় শিল্প উৎপাদন প্রায় থমকে গেছে। খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রগুলোতে নারী ও শিশুরা পদদলিত হয়ে মারা যাচ্ছে। এমন ঘটনা অন্য যে কোনও সময়ের চেয়ে এখন ৪০ শতাংশ বেশি।
বেইলআউট থমকে আছে : অর্থনৈতিকভাবে দেশ ধুঁকছে। এর জেরেই আইএমএফের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য চেয়েছিল পাকিস্তান। আইএমএফের এই সাহায্য (বেইলআউট) প্যাকেজের মেয়াদ শেষ হবে জুনে। কিন্তু সেই নভেম্বর থেকেই এ সাহায্য থমকে আছে।
আর্থিক সংকট থেকে বের হতে আইএমএফের দ্বারস্থ হওয়া পাকিস্তানকে বেশ কিছু শর্ত দেওয়া হয়েছিল। তার মধ্যে বেশ কিছু শর্ত মেনে নিয়েছিল ইসলামাবাদ। তবে কিছু শর্ত নিয়ে সমস্যা থাকায় সংকটের সুরাহা হয়নি। পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার যে রিজার্ভ আছে তা দিয়ে মাত্র এক মাস আমদানি চালানো যেতে পারে।
বন্ধুপ্রতীম অন্যান্য দেশ চীন, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছ থেকে ঋণ মওকুফ হওয়ার বিষয়টিও এখনও পুরোপুরি বাস্তব রূপ পায়নি।
রাজস্ব ঘাটতি : পাকিস্তানে রাজস্ব ঘাটতি অর্থনীতির জন্য বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কর রাজস্বে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারের অংশগ্রহণ মাত্র ৪৬ শতাংশ, যেখানে ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৬৭ শতাংশ। সুদ, ভর্তুকি এবং বেতন–ভাতা সরকারের ওপর এখন একটি বড় বোঝা হয়ে আছে। রূপি দুর্বল হওয়ায় জুন পর্যন্ত এই আর্থিক বছরে রাজস্ব ঘাটতি পূর্বানুমানকেও ছড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
নির্বাচন : পাকিস্তান সাংবিধানিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। গত এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সরকার পাঞ্জাব প্রদেশে মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে স্থানীয় নির্বাচন করার সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করায় এ সংকট দেখা দেয়। নির্দেশ না মানলে শেষ পর্যন্ত সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে আদালত। এর আগে আদালত দুজন প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করেছিল।
রাজনৈতিক চাপ : দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া এবং গত বছর প্রধানমন্ত্রীত্ব থেকে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া ইমরান খান অনবরতই সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে আসছেন। ক্ষমতায় ফেরার লক্ষ্য নিয়ে তিনি রাজনৈতিক প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন।
কর্তৃপক্ষ এর আগে গত মার্চ থেকে কয়েক দফায় ইমরানকে গ্রেপ্তার করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছিল। লাহোরে তার জামান পার্ক বাসভবনে দফায় দফায় অভিযানে গিয়েও তাকে গ্রেপ্তার না করেই ফিরতে হয় পুলিশকে। ইমরান সমর্থক এবং পুলিশের মধ্যে তখন সংঘাতও হয়। এখন ইমরান গ্রেপ্তার হওয়ায় পরিস্থিতি আরও বিগড়ে যাওয়ার পট প্রস্তুত হলো।
প্রভাবশালী সামরিক বাহিনী : পাকিস্তানের সরকার সাধারণত প্রভাবশালী সেনাবাহিনীর সমর্থন খোঁজে। সেনাবাহিনী ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশটি শাসন করেছে। দেশটিতে তিনবার রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা থেকে সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে। একজন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ইমরানের অভিযোগের নিন্দা জানিয়ে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এক বিরল বিবৃতি ইস্যু করার পরই ইমরান খান গ্রেপ্তার হলেন। ইমরান গ্রেপ্তার হওয়ার আগে দায়িত্বে থাকা এক ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুই দফায় অভিযোগ করেন। ইমরান খানের অভিযোগ, কয়েকবার তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিলেন ওই সেনা কর্মকর্তা।
জঙ্গি তৎপরতা বৃদ্ধি : সরকার বলেছে, সমপ্রতি একের পর এক হামলার মুখে জঙ্গি নির্মূল করতে তারা দেশজুড়ে অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করেছে। এ ধরনের সর্বশেষ অভিযান হয়েছিল ২০১৪ সালে। এতে দেশের কোটি কোটি ডলার খরচ হয়েছিল। মানুষ মারা গিয়েছিল শত শত এবং উদ্বাস্তু হয়েছিল প্রায় ১০ লাখ মানুষ।