ভূগোলের গোল

ঈদ আসে, ঈদ যায়

ডাঃ কিউ এম অহিদুল আলম | মঙ্গলবার , ৯ মে, ২০২৩ at ৬:০৩ পূর্বাহ্ণ

এবার ঈদরমজানের সেরা খবর ছিল ঢাকার শেরাটন হোটেলে সোনার প্রলেপের জিলাপি বিক্রি। গণমাধ্যমে এ খবর দেখে ঢাকার ধনীরা অর্ডার দিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। এক চোটে সব জিলাপি শেষ হয়ে যায়। প্রতি কেজি জিলাপি ২০ হাজার টাকা। ক্রেতাবিক্রেতা অবিশ্বাস আমাদের মত মুনাফা লোভী সমাজে একটা স্বাভাবিক ব্যাপার বলে ধরে নেয়া হয়। তাই এক ক্রেতা এই জিলাপিতে আসলে সোনার পরিমাণ দেখতে ল্যাব টেস্টে যায়। বিক্রেতারা জিলাপিতে বাইশ ক্যারেটের প্রলেপ বললেও এক ক্রেতা আঠার ক্যারেট শনাক্ত করে। জিলাপি, মিষ্টি অধিকাংশই অযোধ্যার নবাব ওয়াজেদ আলী শাহের বাবুর্চিদের আবিষ্কার। উল্লেখ্য রমজান মাসব্যাপী প্রচলিত হালিম ও নবাব ওয়াজেদ আলী শাহের বাবুর্চিদের কাণ্ড। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পরে ব্রিটিশরা নবাবকে কলকাতায় নির্বাসনে পাঠায়। নবাবের শর্ত ছিল উনার যত গায়ক, গায়িকা, নর্তকি, বাবুর্চি সবাইকে লক্ষ্মৌ থেকে কলকাতা নিয়ে যেতে দিতে হবে। ব্রিটিশরা রাজি হল। কেউ বলে ৩০০, কেউ বলে ৫০০ বজরা গঙ্গায় বয়ে চলল। কলকাতার মেটিয়া বুরুজ (বর্তমান গার্ডেন রিচ) এ গড়ে উঠল নবাবী সংস্কৃতির এক ‘মিনি লক্ষ্মৌ’। তবে সোনার প্রলেপের জিলাপি নবাবের বাবুর্চিদের নয়। একান্তভাবেই বৈষম্যে ভরা আমাদেরই স্বদেশের কোন বিপণন কর্মকর্তার আবিষ্কার।

রোজার মাসকে বলা হয় সংযম, সহমর্মিতার মাস। ইংরেজিতে Holy month of Fasting. কিন্তু বাহারি খানার দোকান দেখে মনে হয় এটা যেন month of Feasting বা ভুরিভোজের মাস। নিত্য নতুন খাবার মেনু। সাউথ ইন্ডিয়ান খাবার, তুর্কিআরব ডিশ সব এখন যেন সেকেলে। এখন নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে মেনুতে জাপানি, কোরিয়ান আর মেক্সিকান খাবার। চট্টগ্রাম অঞ্চলে গত পাঁচ বছরে নতুন শিল্প ইউনিট কেমন হয়েছে, না পুরাতনগুলো বন্ধ হয়েছে সে হিসেবে না গিয়ে বলতে হয় রকমারী ও দামি খাবারের দোকান অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। এখানেও অর্থনৈতিক বৈষম্য দৃষ্টিকটু পর্যায়ে। কিছু দোকানে উচ্চবিত্তের মানুষের ভিড়! আবার আমজনতার ইফতারির দোকান কিছু কমই বলতে হবে সংখ্যায়। মধ্যবিত্তের বাজারের বাজেট, ইফতারের বাজেট অবধারিতভাবে কমে গিয়েছে। ব্যবসার ট্রেন্ড আঁচ করতে পেরে অনেক নামি দোকান ও পরিমাণে কম আয়োজন করেছে।

পুরো রোজার মাস এবং বিশেষ করে ঈদ পূর্ব কয়েকদিন গ্রামশহর সর্বত্র অভাবী মানুষের যে কাফেলা তা শহুরে ভদ্রলোকদের বা জিডিপির মোহে মোহগ্রস্ত অর্থনীতিবিদদের বোঝা দুরূহ। দারিদ্র্যের পরিসংখ্যান, দারিদ্র্যের বিভিন্ন স্তর বোঝার দরকার নাই। আমাদের দেশে গার্মেন্টসকে বড় খাতের আয় ধরা হয়। তাতে ২৫৩০ লক্ষ মানুষ হয়তো কাজ করে। দেশের অর্থনীতির মূল স্তম্ভ এখনো নিজ উদ্যোগে কষ্টক্লেশ সহ্য করে বিদেশ যাওয়া এক কোটির মত প্রবাসী। তাদের পাঠানো টাকায় গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রাণ যোগায়। তা সত্ত্বেও বেকার মানুষের সংখ্যা বাড়ছে বই কমছে না। আর বেকারত্বের আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সংজ্ঞা হল কোন লোক সপ্তাহে ১ ঘণ্টা চাকরি করলে আপনি বেকার নন। এই সংজ্ঞায় পৃথিবীর অনেক দেশেই বেকার কম ধরা হয়। কেন আমাদের ঈদ পূর্ব সময় ও রোজার মাসে দরিদ্রের কাফেলা তার বাস্তব হিসেব মেলানো যাক। কোন লোক সপ্তাহে ১ দিন ১ ঘণ্টা কাজ করে সর্বোচ্চ গড়ে ৫০ টাকা পেতে পারে। ৫৬ জনের পরিবার ৫০ টাকায় ৬ দিন চলবে কীভাবে? তাই আন্তর্জাতিক বেকারত্বের সংজ্ঞাটা গরিবের প্রতি বিরাট প্রহসন। কয়েকদিন আগে চট্টগ্রামের সংবাদপত্রে খবর ছাপা হয় যে, দোকানিরা ২৫০ গ্রাম গরুর মাংস বিক্রি শুরু করেছে নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য। তাই ঈদ সবার জন্য সমান খুশি নিয়ে আসে না।

২০ রমজানের পর দরিদ্রের কাফেলা স্ফীত হয়ে যায় বিপুলভাবে। এরা আধুনিক শপিং মল, মসজিদ গলি ও দরগাহর সম্মুখে আশ্রয় নেয়। শেভরনের সামনে মক্কী মসজিদের গলিতে এক হৃদয় বিদারক দরিদ্র সমাবেশ চলতেই থাকে নামাজের শেষে। এই মসজিদে যোহরের নামাজ পড়তে আসেন রাজনৈতিক শীর্ষ নেতা ডা. শাহাদাত হোসেন সাহেব। স্বাভাবিক সময় এই গলিতে ৬৭ জন ভিক্ষুক থাকে। কিন্তু শাহাদাত সাহেব মসজিদে এসেছেন এই খবর খুব দ্রুত এলাকার ভিক্ষুকদের মাঝে কিভাবে ছড়িয়ে যায়। খুব দ্রুত ২৩ শ’ ভিক্ষুক জড়ো হয়ে যায়। বেচারা যা পারে সবার হাতে কিছু দেয়। এদেরও ঈদ হয়, এদেরও ইফতার হয়। এরাও আমাদের দেশের সন্তান। জন্মই কি এদের আজন্ম পাপ?

নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে পারেনি বলে অনেক নির্মাণ শ্রমিক, পাইপফিটার গ্রামে ঈদ করতে পারেনি। আবার অনেকে দেখলাম ভাড়া, বাচ্চাকাচ্চার ঈদ পোশাক ম্যানেজ করতে পারেনি বলে গ্রামে ঈদ করেনি। গ্রামে যাদের প্রবাস থেকে রেমিটেন্স কিছুটা আসে তারাও টাইট বাজেটে ঈদ করেছে। অর্থাৎ বাচ্চাদের জন্য কিছু কিনলেও পরিবারের বয়স্করা কৃচ্ছতা করেছেন। বাস্তব দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বেকারত্ব, প্রবাসী রেমিটেন্সের কম প্রবাহ ঈদআনন্দে কিছুটা ভাটা ফেলেছে। চির পরিচিত ঈদচাঁদের সেই গান

রমজানের ঐ রোজা শেষে এল খুশির ঈদকাজী নজরুল লিখেছিলেন। নিজেও কবি দারিদ্র্যকে প্রত্যক্ষ করেছেন নিবিড়ভাবে। কবি শ্রেণিবৈষম্যের রোজাঈদকে এভাবে দেখেছেন:

যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ মুমূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?

ফুল ফুটুক না ফুটুক! ক্যালেন্ডারে যেমন বসন্ত আসে তেমনি সোনার জিলাপি আর কবি নজরুলের দুই বিপরীত ছন্দের কবিতা নিয়েও ঈদ আসে, ঈদ যায়!

পূর্ববর্তী নিবন্ধরবীন্দ্র ভাবনায় বাংলাদেশ
পরবর্তী নিবন্ধহালদা থেকে দুই হাজার মিটার জাল জব্দ