বাঙালিদের কাছে রবিঠাকুর এক চিরন্তন বাঙালি চেতনার স্তম্ভ। সমস্ত রবীন্দ্র অনুরাগীদের কাছে বৈশাখ মাস, কবিগুরুর মাস, রবি মাস বলে স্বীকৃত। রবি মানে সুর্য। এক সূর্য যেমন পৃথিবীর আকাশ, বাতাস, পানি, মাটি, সহ সবকিছুকে তার রবি রশ্মি তথা সূর্য কিরণ দিয়ে বন্ধনহীন গ্রন্থিতে আবদ্ধ করে রেখেছে, তেমনি বাঙালি জীবনে, বাঙলা ভাষার অলংকরণে, প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা, গান, উপন্যাস, নাটক ইত্যাদি সৃষ্টির মাধ্যমে রবিঠাকুরের রবিরশ্মি সূর্য কিরণের মতো বাঙাল জাতিকে, বাঙলা ভাষার মাধুর্যায়নে, বাঙলা সংস্কৃতি চর্চার সমৃদ্ধিকরণে, বাঙালির যাপিত জীবন ধারাকে ঋদ্ধ করে বিশ্বের কাছে মর্যাদার আসনে পৌঁছে দিয়েছেন।
কোলকাতার জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত বনেদি ব্রাহ্মণ পরিবারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বাবার নাম মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, মা সারদা সুন্দরী দেবী। মা– বাবার চৌদ্দ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন অষ্টম। পারিবারিক পরিচয়ের বাইরে তাঁর পরিচিতি ছিল বিশ্বজনীন, তিনি অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। বিখ্যাত ভারতীয় রবীন্দ্র গবেষক রঞ্জন বন্ধোপধ্যায় কবিগুরুর জ্ঞানের পরিধির ব্যাপকতা বিবেচনা করে রবিঠাকুরকে উপনিষদের পুত্র বলে অভিহিত করেছেন। তাঁকে বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক মনে করা হয়। রবীন্দ্রনাথকে গুরুদেব, কবিগুরু, বিশ্বকবি প্রভৃতি অভীধায় ভূষিত করা হয়।
রবীন্দ্রনাথ বিরামহীন লেখনী দিয়ে মানুষের জীবনযাত্রা, ধার্মিকতা, রাজনীতি, আধ্যাত্মিকপ্রেম, ভালোবাসা, মোহ, দ্রোহ, মান, অভিমান, বিরহ, বিচ্ছেদ, প্রতিবাদ প্রতিরোধ, মৃত্যু, পূজা, প্রার্থনা, প্রকৃতি, শিক্ষা, আচরণ, কৌতুক ইত্যাদি নানা বিষয়ে মানবজীবন এর সুক্ষ সুক্ষ অনুভূতির প্রকাশ সম্পর্কিত চেতনার জাগরণ, সংস্কৃতি ধারণ ও লালন চর্চার কথা অসম্ভব সুন্দর মার্জিত, প্রাঞ্জল ভাষার ব্যবহারে রচনা করেছেন তাঁর সৃষ্টিসমূহ। তাঁর সৃষ্টির মধ্যে উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে, ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ, ও অন্যান্য গদ্যসংকলন তাঁর জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই প্রকাশিত হয়। তাঁর সর্বমোট ৯৫টি ছোটগল্প নিয়ে গল্পগুচ্ছ, এবং ১৯১৫টি গান নিয়ে গীতবিতান রচিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় প্রকাশিত ও গ্রন্থকারে অপ্রকাশিত রচনা ৩২ খণ্ডে রবীন্দ্র রচনাবলী নামে প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় পত্রসাহিত্য ১৯ খণ্ডে চিঠিপত্র ও ৪টি পৃথক গ্রন্থে প্রকাশিত। এছাড়া তিনি প্রায় দু, হাজার ছবি এঁকেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের রচনা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের পর তিনি এশিয়দের মধ্যে সাহিত্যে প্রথম নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার হাতে খড়ি হওয়া থেকেই অর্থাৎ স্কুল কলেজে বাংলা বিষয়ে রবিঠাকুরের লেখা কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, ইত্যাদি প্রায় প্রতিটি শ্রেণির সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাই পরীক্ষার জন্য আন্তরিক প্রস্তুতি নিতে গিয়ে রবি ঠাকুরের সাথেও আন্তরিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র সংগীত, রবীন্দ্র নৃত্যনাঠ্য তো মোহনীয় আবেশে মুগ্ধতা ছড়াতো। এভাবেই রবীন্দ্রনাথকে জানার আগ্রহ তৈরি হয়। ক্রমে ক্রমে পদে পদে রবীন্দ্রনাথ অপরিহার্য হয়ে উঠে।
রবীন্দ্রনাথের লেখা পাঠ্যবই অন্তর্ভুক্ত ছোটগল্পগুলোর মধ্যে কাবুলিওয়ালার মিনি, ছুটির ফটিক, পোস্টমাস্টারের রতন, হৈমন্তীর হৈমন্তী চরিত্র সমূহ পড়তে গিয়ে কত মূল্যবোধকে যে চিনতে পেরেছি, তার মধ্যেই নিহিত ছিল মনুষ্যত্বের শিক্ষা। ছোটগল্প রবীন্দ্রনাথের স্বার্থক সৃষ্টি। এই ছোটগল্পকে চিনতে গিয়ে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে হয়েছে ছোটগল্প কী? ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য কী? ছোটগল্পের সংজ্ঞা তো তিনি নিজেই দিয়ে গেছেন। ‘—- ছোটো প্রাণ, ছোটো ব্যথা, /ছোটো ছোটো দু:খ কথা/ নিতান্তই সহজ সরল-/সহস্র বিস্মৃত রাশি/প্রত্যহ যেতেছে ভাসি/ তারি দু, চারিটি অশ্রুজল। /নাহি বর্ণনার ছটা/ঘটনার ঘনঘটা, /নাহি তত্ত্ব, নাহি উপদেশ -,/অন্তরে অতৃপ্তি রবে/সাঙ্গ করি মনে হবে/ শেষ হয়ে হইল না শেষ। এই সংজ্ঞা পরীক্ষা প্রস্তুতি হিসেবে আয়ত্ত করতে হয়েছে। আয়ত্ত করতে গিয়ে রবি ঠাকুরের প্রতি গভীর ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার সুযোগ হয়েছে। বর্তমানে পাঠ্যসূচিতে কবিগুরুর দু,একটা গল্প, কবিতা আছে, কিন্তু এত মন প্রাণ দিয়ে আয়ত্ত করার প্রয়োজন পরে না, ভাসা ভাসা শেখায় পরীক্ষা দিয়েও এ প্লাস পাওয়া যায়। শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাংলা বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রেও ফাঁক থেকে যায়, তাই সিলেবাসভুক্ত প্রবন্ধ, গল্প, বা কবিতার লেখক ও কবির প্রতি তেমন ভালোবাসা বা জানার আগ্রহ খুব কমই পরিলক্ষিত হয়। আবার কিছুটা সময় রবীন্দ্র বর্জন নীতির কারণে সাধারণ জনগণ এর কাছে রবি ঠাকুরের সৃষ্টি কর্ম পৌঁছানোর ক্ষেত্রে কালো আস্তরণের বাধা পড়েছে। তাতে কী! কেউ যদি বলে, সুর্য থেকে আলো গ্রহণ করবো না, তাতে সুর্যের আলো ছড়ানোতে কি কোনো বাধা আসবে! না সূর্যের কোনো রকম অসুবিধা হবে! ঠিক তেমনি যারা রবীন্দ্র রচনাবলী নিষিদ্ধ করেছিল তারাই বরং রবির সৃষ্টিজনিত আলো থেকে বাদ পড়েছে। আলোর প্রয়োজন যাদের দরকার নেই তারা তো অন্ধকারেই থাকে।
বর্তমান বিশ্বের আনাচে কানাচে রবিঠাকুরের সৃষ্টিকর্মের আধিপত্য দিন দিন বেড়েই চলেছে। বিশ্বের তিনটি দেশের তথা ভারত, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার, জাতীয় সংগীত কবিগুরুর লেখা গান।
রবি ঠাকুরের সৃষ্টিকর্ম এর সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ ছোটো বেলায় বাবার আদেশে বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার শিলাইদহে জমিদারী দেখাশোনা করার জন্য দীর্ঘদিন অবস্থান কালে বাংলাদেশের প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে বহু কবিতা, গান, প্রবন্ধ বিশেষ করে ছোটো গল্পের প্লট খুঁজে পেয়েছিলেন বলে তিনি বিভিন্ন লেখায় বর্ণনা করেছেন।
ছোটোগল্পের সৃষ্টির সাথে বাংলাদেশের সম্পৃক্ততার কথা জিতেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায় এর লেখা ‘শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ’ বই তে দেওয়া আছে। ‘ছোটোগল্প রচনার প্রসঙ্গে রবিবাবু বলিলেন, ‘আমি প্রথমে কেবল কবিতাই লিখতুম, গল্পে টল্পে বড়ো হাত দিইনি, মাঝে একদিন বাবা ঢেকে বললেন, তোমাকে জমিদারির বিষয়কর্ম দেখতে হবে। আমি তো অবাক, আমি কবি মানুষ, পদ্য–টদ্য লিখি, আমি এসবের কী বুঝি? কিন্তু বাবা বললেন, তা হবে না; তোমাকে এ কাজ করতে হবে। কী করি? বাবার হুকুম, কাজেই বেরোতে হলো। বাংলাদেশে এই জমিদারি দেখা উপলক্ষে অল্প বয়সে নানা রকমের লোকের সঙ্গে মেশার সুযোগ হয় এবং এই থেকেই আমার গল্প লেখারও শুরু হয়।
রবি ঠাকুরের লেখা ‘চিঠিপত্র–৯’ এ আছে– ‘অল্প বয়সে বাংলাদেশের পল্লী প্রকৃতির সঙ্গে যখন আমার চোখে চোখে পরিচয় হয়েছিল তখন প্রতিদিন আমার মনে যে আনন্দের ধারা উদবারিত হয়েছিল তাই সহজে প্রবাহিত হয়েছিল ঐ নিরলংকৃত সরল গল্পগুলির ভিতর দিয়ে। আমার নিজের বিশ্বাস এই আনন্দবিস্মিত দৃষ্টির ভিতর দিয়ে বাংলাদেশকে দেখা আমাদের সাহিত্যে আর কোথাও নেই। ‘মানবসত্য’ নামক বইতে রবি ঠাকুরের লেখায় আছে– ‘পদ্মায় আমার জীবনযাত্রা ছিল জনতা থেকে দূরে। নদীর চর– ধূ ধূ বালি, স্থানে স্থানে জলকুণ্ড ঘিরে জলচর পাখি। সেখানে যে সব ছোটোগল্প লিখেছি তার মধ্যে আছে–পদ্মাতীরের আভাস। সাজাদপুরে যখন আসতুম চোখে পড়তো গ্রাম্য জীবনের চিত্র, পল্লীর বিচিত্র কর্মোদ্যম। তারই প্রকাশ পোস্টমাস্টার, সমাপ্তি, ছুটি প্রভৃতি গল্প। তাতে লোকালয়ের খণ্ড খণ্ড চলতি দৃশ্যগুলি কল্পনার দ্বারা ভরাট করা হয়েছে।’ এভাবে কবিগুরু তাঁর সৃষ্টিতে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও মানুষের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত হয়ে আছে, থাকবে যুগ যুগ ধরে।
লেখক : প্রাবন্ধিক; অধ্যক্ষ, হুলাইন ছালেহ নূর কলেজ।










