কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে সাইবার অপরাধ কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ সম্ভব

| মঙ্গলবার , ৯ মে, ২০২৩ at ৫:৫৮ পূর্বাহ্ণ

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক এখন হয়রানি ও অপরাধের আখড়া হয়ে গেছে। ফেসবুকে আপত্তিকর স্ট্যাটাস, বিদ্বেষমূলক কথা দিয়ে, ছবি বিকৃত করে, ভুয়া পেজ ও আইডি খুলে আজকাল হরহামেশা অনেককে হয়রানি করা হচ্ছে। অনেকে এসবের কারণে নিপীড়নের শিকারও হচ্ছেন। নিগৃহীত হচ্ছেন সামাজিকভাবে। অনেকের জীবন হুমকির মধ্যে পড়েছে। কারও সম্পর্ক ভাঙছে, ভাঙছে সংসারও। কেবল প্রতিকার পাওয়ার উপায় জানা না থাকায় দিনদিন এসব বেড়েই চলেছে। গত ৫ই মে দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত হয়েছে ‘ফেসবুক এখন অপরাধের আখড়া’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন। এতে বলা হয়েছে, নাম সর্বস্ব পেইজ খুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ইতোপূর্বে শোভা পেত বিভিন্ন পণ্যের চটকদার বিজ্ঞাপন। আর তাতে অর্ডার করলেই প্রতারিত হতেন গ্রাহক। প্রতিদিন এমন বিজ্ঞাপনের ফাঁদে লোপাট গ্রাহকের কোটি কোটি টাকা। হয়রানির হাতিয়ার ফেসবুক এখন আরও একধাপ এগিয়ে হয়ে উঠেছে অপরাধের অন্যতম হাতিয়ার। তাদের ধরতে অভিযানে নেমেছে গোয়েন্দা পুলিশ ও র‌্যাব। এ ধরনের অপরাধ বন্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ অপরাধ বিশেষজ্ঞদের।

কিডনি ডোনেট সেন্টারের নামে ফেসবুকে পেইজ খুলে গ্রামের সহজ সরল মানুষকে কিডনি বিক্রিতে উদ্বুদ্ধ করে ভারতে পাচার করা হয়এমন একটি চক্রের মূলহোতা ধরা পড়ে র‌্যাবের হাতে। ৩০ ডিসেম্বর নগরীর খুলশী এলাকা থেকে চক্রের তিনজনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব, চট্টগ্রাম। ফেসবুকে পেইজ খুলে ডোনারদের নানাভাবে কিডনি ও লিভার ডোনেশনের ব্যাপারে প্রলোভন দেখানো হয়। এরপর ঢাকার একটি হাসপাতালে তাদের রক্ত, কিডনি ও লিভার পরীক্ষা করানো হয়। রিপোর্ট ঠিক থাকলে ঐ লোকদের তারা ইন্ডিয়াতে পাচার করে। র‌্যাবের দেওয়া তথ্য মতে, ভারতে ডোনারদের সাথে রোগীদের রক্ত, কিডনি ও লিভার ক্রস ম্যাচ করিয়ে থাকে তারা। শুধু কিডনি ও লিভারের জন্য চক্রটি রোগীদের কাছ থেকে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। কিন্তু কিডনি দাতা বা লিভার দাতাকে দেন মাত্র ৪ থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা। ভারতে অবস্থানরত এ চক্রের অন্যতম মাথা শাহিন ওই দেশের হাসপাতালে ভিকটিমদের বিভিন্ন অঙ্গের পুনরায় পরীক্ষা করানোর পর তাদের কাছ থেকে কিডনি ও লিভার সংগ্রহের ব্যবস্থা করে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে সাইবার অপরাধগুলোর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভুক্তভোগীই নারী। ইন্টারনেটের দুনিয়ায় যৌন হয়রানি, বিকৃত যৌনাচার, আর যৌন নিপীড়নের মতো অসংখ্য ঘটনা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ যৌন হয়রানির জন্য অপরাধীরা এখন হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে প্রযুক্তি তথা ইন্টারনেট, সামাজিক মাধ্যমকে। সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের ‘বাংলাদেশে প্রযুক্তির অপব্যবহারের মাধ্যমে যৌননিপীড়ন’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রযুক্তির অপপ্রয়োগের মাধ্যমে সাইবার স্পেসে যৌন হয়রানি, যৌন নির্যাতনের ঘটনা বেড়েইচলেছে।

গবেষণায় দেখা যায় যে, যৌন নিপীড়নের ক্ষেত্রে মোট ১৫৪ জন ভুক্তভোগীর মধ্যে ৯২ দশমিক ২০ শতাংশ ভুক্তভোগীই নারী। এর মধ্যে ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী ভুক্তভোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি (৫৬ দশমিক ৪৯ শতাংশ)। এদের মধ্যে ৩২ দশমিক ৪৭ শতাংশের বয়সই ১৮ বছরের নিচে। প্রাপ্ত তথ্যে, সবচেয়ে বেশি যৌন নিপীড়নের সংবাদ পাওয়া গেছে ঢাকা বিভাগে (৩৩ দশমিক ১২ শতাংশ)। এরপরেই অবস্থান চট্টগ্রাম বিভাগের (১৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ)। আর অধিকাংশ যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে বিভাগীয় শহরে। দেখা যায় যে, অনলাইনে ৬২ দশমিক ৯৯ শতাংশই যৌন হয়রানির শিকার হন। ভুক্তভোগীদের মধ্যে ১৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ ধর্ষণের শিকার। ১৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ যৌনপণ, ৩ দশমিক ২৫ শতাংশ আত্মহত্যা, ১ দশমিক ৯৫ শতাংশ আত্মহত্যার চেষ্টা, শূন্য দশমিক ৬৫ শতাংশ খুনের চেষ্টা এবং অন্যান্য যৌন হয়রানি করা হয় ১ দশমিক ৯৫ শতাংশকে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয় যে, সাইবার স্পেসে যৌন নিপীড়নমূলক অপরাধ ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে এবং ভুক্তভোগীকে হয়রানিমূলক পরিস্থিতিতে ফেলতে নিপীড়নকারী গোপনে চাপ প্রয়োগ করে কিংবা প্রতারণাপ্রলোভনের আশ্রয় নিয়ে বিভিন্ন আপত্তিকর বিকৃত কনটেন্ট সংগ্রহ করে।

ফেসবুক তথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ধরনের কিছু ঘটলে, তা থেকে প্রতিকারের উপায় রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেন। ভুক্তভোগী চাইলে যিনি হয়রানি করছেন তার বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থায় অভিযোগ করতে পারেন, আইসিটি অ্যাক্টে তার বা তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন। আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারা তাকে সুরক্ষা দেবে। অন্যদিকে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসিতে অভিযোগ করা যাবে, সমাধান মিলবে। যদি একান্তই এসব কিছু করা না যায় তাহলে (ফেসবুকের মাধ্যমে কোনও কিছু ঘটলে) ফেসবুকে সরাসরি রিপোর্ট করারও ব্যবস্থা রয়েছে। উপযুক্ত তথ্যাদি দিতে পারলে ফেসবুক অভিযোগকারীর নিজের পাশে এসে দাঁড়াবে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব থেকে রক্ষা পেলে চাইলে সচেতন থাকার কোনও বিকল্প নেই। ব্যক্তি নিজে যদি এসব থেকে সরে না আসেন তাহলে কখনও এসব বন্ধ করা যাবে না। কঠোর আইন করেও বিপথগামীদের ফেরানো যাবে না। তারা অন্যের অনিষ্ট করবেই। এক্ষেত্রে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের যে ধারা আছে সেগুলো পর্যালোচনা করে যদি কঠোর শাস্তির বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়, তাহলে অপরাধ কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে