দাবদাহ আর তাপদাহ সমান তালে চলছে।
তাই বন্ধের দিনগুলোতেও হুটহাট করে বেড়ানোর জন্য বেরিয়ে পড়া যায় না। এদিকে বাচ্চাদের লম্বা ছুটি শেষ হতে চললো। ভাবলাম, সবাই মিলে কাছাকাছি কোথাও ঘুরে আসা দরকার। আমরা ১২ জনের ছোট একটি গ্রুপ বেরোনোর সিদ্ধান্ত নিলাম। গন্তব্য-‘কাপ্তাই লেক, প্যানোরমা জুম রেস্তোরাঁ’, আর সময় করতে পারলে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ঘুরে দেখা‘। বৈশাখ মাসের দুপুরে এই কাঠফাটা রোদে চোখ খোলা দায়। তাই আমরা ধীরে সুস্থে রেডি হচ্ছিলাম। আমাদের প্রস্তুতি নেয়ার ধরন দেখে প্রকৃতি মুচকি হেসে সায় দিলো। মুহূর্তের মধ্যে আকাশের রং পাল্টে যেতে শুরু করলো। রৌদ্র ঝলমল পৃথিবী মেঘাচ্ছন্ন হয়ে গেলো। বৃষ্টি আসবে কিনা জানি না তবে আবহাওয়ার পরিস্থিতি অনেকটাই শীতল হলো।
আনন্দের সাথেই আমাদের যাত্রা শুরু হলো। অক্সিজেনের মোড় থেকে অনন্যার রাস্তা ধরে অত্যাধুনিক হসপিটাল এভারকেয়ারের পাশ ঘেঁষে ফ্রোবেল একাডেমিকে পেছনে ফেলে পৌঁছে গেলাম কাপ্তাই রাস্তার মাথায়। সুন্দর পিচ ঢালা রাস্তায় দ্রুত গতিতে গাড়ি এগিয়ে চললো।
নজুমিয়াহাট, হাটহাজারী, রাউজান, রাঙ্গুনিয়া জায়গাগুলো পার হয়ে যাচ্ছিলাম। সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা এই আমাদের বাংলাদেশের রূপ গুণের শেষ নেই। পথের ধারে ফুটে আছে হাজার রকমের ফুল। শিরিষ, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, জারুল, সোনালু এই সময়ের ফুলগুলোতো আছেই, আরো আছে অনেক অবহেলিত কিন্তু সবচেয়ে সুন্দর কচুরিপানার ফুল, যেগুলো ফুটে আছে প্রকৃতির অপরূপ রূপ নিয়ে। যাত্রাপথের সবচেয়ে সুন্দরতম দৃশ্য হলো ধান কেটে নিয়ে চাষীদের ঘরে ফেরার দৃশ্য। এদিকে এতো সুন্দর চাষাবাদ হয়েছে দেখেই মন জুড়িয়ে গেলো। কৃষকদের ব্যস্ততা চোখে পড়ার মতো। কেউ ধান কাটছেন, কেউ ধানের আঁটি বাঁধছেন, কেউ মাথায় বোঝা করে ধানের আঁটি নিয়ে বাড়ি ফিরছেন, কেউ এক জায়গায় খড়সহ ধানগুলোকে রেখে বড় তেরপল দিয়ে ঢেকে রাখছেন। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, যে কোনো মুহূর্তেই বৃষ্টি হতে পারে, তাই যত দ্রুত সম্ভব এগুলোকে নিরাপদে গুছিয়ে রাখতে হবে। আমাদের দেশের এই কৃষিই আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখে। মন থেকে আমরা কৃষকদের জন্য দোয়া করি আল্লাহ তাদেরকে সুস্থ রাখুন….। এদিকে স্থাপিত মদুনাঘাট ব্রিজ, চুয়েট, রাঙ্গুনিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র– ঐতিহ্যবাহী এই স্থাপনা আর প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের দেশের অনেক বড় বড় সম্পদ। …ধীরে ধীরে আমরা পাহাড়ের কাছাকাছি আসতে শুরু করেছি। মেঘের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে এখনই সন্ধ্যা হয়ে যাবে কিন্তু না, সন্ধ্যা হতে ঘড়িতে এখনো অনেক সময় বাকি। কাপ্তাই এর কাছাকাছি আসতে আসতেই অনেক সুন্দর সুন্দর স্মৃতি চোখে ভেসে উঠলো। স্কুল কলেজে পড়াকালীন সময়ে শিক্ষা সফরের অংশ হিসেবে আমি আরো চার বার কাপ্তাই এসেছিলাম। তখন চন্দ্রঘোনা, কর্ণফুলী পেপার মিল, কর্ণফুলী ভিউ ক্লাব, জুম রেস্তোরাঁ এ জায়গাগুলো দেখা হয়েছে। নৌকায় করে তখন লেক পার হয়ে ওপারেও গিয়েছিলাম। এই জায়গাগুলো দেখে সেসব দিনের সুন্দর স্মৃতিগুলো শেয়ার করছিলাম পরিবারের সবার সাথে। প্যানোরামা জুম রেস্তোরাঁর সামনে আমরা নামলাম। টিকেট করে রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করলাম। এখানে আকর্ষণ তো রেস্তোরাঁ নয়। মূল আকর্ষণ হলো লেকের স্বচ্ছ শীতল ঘনকালো পানির সাথে সবুজের সমারোহে মিশে থাকা পাহাড়ের অদৃশ্য মিলন। এ–এক অপরূপ দৃশ্য। বিকেলের এই সময়টা অনেক মায়াবী। সবদিকে একটা শান্তি শান্তি ভাব। সবুজ পাহাড়গুলোতে, সবুজের বুক চিরে থোকায় থোকায় ফুটে আছে লাল কৃষ্ণচূড়া, শিরিষ ফুল, উজ্জ্বল বেগুনী রংয়ের জারুল ফুল আর হলুদ রঙের সোনালু ফুল। যেনো পটে আঁকা ছবি, এ–রং এ–রূপ যেকোনো পর্যটককে আকৃষ্ট করবেই। লেকের পানির কাছাকাছি নামার লোভ সামলাতে পারছিলাম না। ধীরে ধীরে আমরা একেবারে পানির নিকটে চলে গেলাম। আমরা লেকের পানিতে ছুটে চলা সুন্দর সুন্দর নৌকা, আনন্দে আপ্লুত পর্যটকদের আনাগোনা আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। নিজেরা সাবধানে থেকে বাচ্চাদেরকেও নিরাপদে রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করলাম, যাতে আমরা কেউই পা পিছলে পানিতে পড়ে না যাই। লেকের ওপারে আছে অসাধারণ সুন্দর উয়াজ্ঞাছড়া চা বাগান। চা বাগান যে কোনো পর্যটকের কাছেই মূল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। আরেকটু সময় নিয়ে আসতে পারলে আমরা চা বাগানেও ঘুরে আসতে পারতাম। আসরের নামাজের পর রেস্তোরাঁয় বসে এই গরম আবহাওয়ায় ঠান্ডা ঠান্ডা চকবার, কোণ আর মাচো যার যার পছন্দসই আইসক্রিম তৃপ্তি সহকারে অত্যন্ত আনন্দের সাথে শেষ করলাম। এরপর আমরা প্রস্তুতি নিলাম কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের দিকে যাত্রা শুরু করার। সন্ধ্যা পেরিয়ে ততক্ষণে অন্ধকার হয়ে গেলো সবদিক। পাহাড়ের প্রতি যতোই টান আর ভালোবাসা থাকুক না কেনো সন্ধ্যার পর হলেই অন্ধকারে যে কোনো পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চললেও আমার কেমন যেনো ভয় লাগে। লেকের পানির দিকে তাকাতেও গা ছমছম করে ওঠে। আজও একই ভীতিকর, রোমাঞ্চকর অনুভূতি। কিভাবে যে পাহাড়ে জনগণ বসবাস করে ভাবতেই অবাক লাগে। বড় বড় অট্টালিকায় থাকার পরেও যেখানে ছোট একটা পোকা দেখলে আমাদের সবার মধ্যে হৈচৈ পড়ে যায় সেখানে কিভাবে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে পাহাড়ের ঢালুতে লেকের ধারে পাহাড়ি জনপদের লোকেদের বসবাস করতে হয় তা মনে আসলে আশ্চর্য হতে হয়! পরক্ষণে আবার এটা বুঝে নিই পরিস্থিতি মানুষকে সাহসী করে তোলে, বাঁচার প্রেরণা যোগায়, স্বপ্ন দেখায়। এভাবে মানুষ সাহস নিয়ে স্বপ্ন নিয়ে এগোতে থাকে।
…সন্ধ্যার পর এখানে পর্যটক একেবারেই কমে আসে, জাতীয় উদ্যান ফেলে, দুইটা বেইলি ব্রিজ পার হয়ে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে খুব কম সময়ের মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে। প্রকল্পে প্রবেশের অনুমতি নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম। সুন্দর পিচ ঢালা রাস্তায় নিরবে গাড়ি এগিয়ে চললো। দু‘পাশে অনেক স্থাপনা, মসজিদ, আবাসিক ভবন সবকিছু পেছনে ফেলে বেরি বাঁধের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় ডানে গভীর খাদ, কিছু স্থাপনা, বামে গভীর ঘন জমানো জল। হিল টপ রিসোর্ট এর সামনে এসে আমরা থামলাম। ‘আপনি আসার পূর্বে এই জায়গা পরিষ্কার ছিল‘- এমন লেখাযুক্ত বোর্ড লাগানো আছে কিছুক্ষণ পরপর! এ কেমন ধরনের সতর্কবার্তা! কোনো পর্যটকের জন্যই এমন লিখা সুখকর হতে পারে না, ভালো অনুভূতি জাগাতে পারে না। আমরা আসার পরে তো আর অপরিষ্কার করিনি। যে জায়গাগুলোতে সর্বসাধারণের প্রবেশের সুযোগ থাকে না, যেখানে বিশেষ অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করতে হয় এবং যে জায়গাগুলো পরিষ্কার থাকে ওখানে সাধারণত সচেতন পর্যটকেরা অপরিষ্কার করা থেকে বিরত থাকে…! আমরা দেশের সম্পদ নিয়ে আলাপ করছিলাম। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর আমাদের দেশ। এই সম্পদকে কাজে লাগিয়ে পর্যটন এরিয়া হিসেবে গড়ে তোলা এবং দেশি–বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করা শুধুমাত্র সময়ের ব্যাপার। একটু মানসিকতার পরিবর্তন করলে আমাদের এই দেশ পর্যটনে আপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিবে…। এখানে দিনের বেলায় সময় নিয়ে আসাটা খুব জরুরী। রাতে আসাতে আমরা অনেক কিছুই মিস করলাম। তবুও যতটুকু সম্ভব হেঁটে বাচ্চাদেরকে স্লুইসগেট, কিভাবে পানি বাঁধা আছে, কিভাবে পানি ছাড়া হয়, কিভাবে নেট দিয়েপানি সেঁকে নেয়া হয় তা দেখালাম। এতো আনন্দের মাঝেও যে জিনিসটা আমাকে অন্য জগতে নিয়ে গেলো তা হলো ফুলের সুগন্ধি। চাঁদনী রাতে আকাশের গায়ে যেমন তারাগুলো জ্বল জ্বল করে জ্বলে থাকে, তার চেয়েও বেশি উজ্জ্বল হয়ে ফুটে আছে অসাধারণ সুগন্ধি যুক্ত জুঁই ফুল। কিছুক্ষণের জন্য আমি কিভাবে ফুল নেয়া যায় ওই চিন্তায় মত্ত হলাম। আম্মুর নিষেধের কারণে ফুল নিতে পারলাম না। অসাধারণ সুন্দর স্মৃতি নিয়ে ফিরে আসছিলাম। আসার পথে উজ্জ্বল আলোকিত সাজানো সুন্দর একটি রেস্টুরেন্টে থামলাম। নামটাও সুন্দর ‘নিসর্গ‘। এই রেস্টুরেন্টের মালিকের প্রশংসা করতেই হয়। চিকন বাঁশ, রঙ্গিন কাপড়ের ফুল দিয়ে তৈরি পরিপাটি মনোমুগ্ধকর সাজানো এই রেস্টুরেন্ট। আমরা ফ্রেশ হয়ে সবাই মিলে খাবার খেলাম। রেস্টুরেন্ট এর পক্ষ থেকে সুন্দর একটি ফুল উপহার পেলাম। জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জুঁই ফুল নিতে না পারলেও পাহাড় থেকে ফিরে আসার পথে রেস্টুরেন্ট এর পক্ষ থেকে এই ফুল পেয়ে অনেক খুশি হলাম। অসাধারণ সুন্দর বিকেল আর সুন্দর সন্ধ্যা কাটিয়ে দারুন রোমাঞ্চকর স্মৃতি নিয়ে আল্লাহর রহমতে নিরাপদে বাসায় ফিরে এলাম। সৌন্দর্যের লীলাভূমি সবুজ পাহাড় ঘেরা কাপ্তাই লেক চট্টগ্রাম শহর থেকে বেশি দূরে নয়। সপরিবারে কিংবা সদলবলে সকালে গিয়ে সারাদিন আনন্দঘন সময় কাটিয়ে অনায়াসে সন্ধ্যায় ফিরে আসা যায়। অসাধারণ সুন্দর এই প্রাকৃতিক লেক প্রত্যেক পর্যটকের ভালো লাগবেই– এ আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি।