ঊনবিংশ শতাব্দীর যুগান্তকারী ঘটনাগুলোর মধ্যে মে দিবস অন্যতম। পুঁজিবাদ দ্রুত বিকশিত হচ্ছিল ইউরোপ এবং আমেরিকায়। পুঁজিবাদ বিকশিত হওয়া মানে দ্রুত শিল্পপতিরা মিলিয়নিয়র থেকে বিলিয়নিয়র হচ্ছিল। ধরুন ১ টি শাড়ি। পণ্যটির উৎপাদন খরচ ৫০ টাকা। ১০০ টাকা বিক্রি করে লাভের ৪০ টাকা মালিক নিজের পকেটে ঢুকাচ্ছিল। তাঁতী বা শ্রমিককে দিচ্ছিল মাত্র ১০ টাকা। অথচ তাঁতীকে দেয়া উচিত ছিল ৪০ টাকা বেতন। মালিক বড় জোর ১০ টাকা পকেটস্থ করলেই হতো যুক্তিযুক্ত। শোষণের এই প্রক্রিয়ায় প্রথমে বাধা দিল শ্রমিকরা। এতোদিন দিনে কয়ঘণ্টা কাজ করতে হবে তার পরিমাণ সুনির্দিষ্ট ছিল না। শিকাগোতে শ্রমিক নেতৃত্ব ১ মে ১৮৮৬ ধর্মঘটের ডাক দিল ৮ ঘণ্টা কাজের সময়সীমা বাস্তবায়নের দাবীতে। শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণে হে মার্কেট এলাকায় প্রাণ দিল ৬ জন শ্রমিক।
সভ্যতার অন্য বড় দুটো ঘটনা মে দিবসের ভিত্তি দিয়েছিল। ১৭৮৯ সালের ৫ মে, ফরাসী রাজতন্ত্র উৎখাতে শ্রমিক কৃষক চাকরিজীবীরা নেমে পড়ল রাজপথে। শেষ পর্যন্ত জনতা ১৪ জুলাই ঘেরাও করল প্যারিসের বাস্তিল দুর্গ। বাস্তিল দুর্গে আশ্রয় নেয়া রাজা ষোড়শ লুই আত্মসমর্পণে বাধ্য হলো, মধ্যবিত্ত শ্রেণির নেতৃত্বাধীন বিপ্লবীদের কাছে। এই বিপ্লব মাত্র ১০ বৎসর স্থায়ীত্ব পেয়েছিল। ২০১৯ সালে প্যারিসের রাজবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে স্মরণ করতে চেষ্টা করেছি ইতিহাসের সেই দিনগুলি।
ফরাসী বিপ্লব গোটা পৃথিবীকে ঝাঁকুনি দিয়েছিল। পৃথিবীর যেখানেই জুলুম শোষণ একনায়কতন্ত্র আর রাজতন্ত্র সহ্যের সীমা অতিক্রম করেছে, সেখানেই সংগ্রাম আন্দোলন ও বিপ্লবের ঐতিহ্য নির্যাতীত মানুষের সামনে এসেছে। প্রায় শত বৎসর পর শিকাগোর শ্রমিক ধর্মঘটের প্রেরণার উৎস ছিল ফরাসী বিপ্লব।
ফরাসী বিপ্লবের প্রায় আট দশক পর কার্ল মার্ক্স ১৮৬৭ সালে প্রকাশ করলেন তাঁর পৃথিবী বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ক্যাপিটাল’। এই বইতে তিনি সোজাসুজি মালিক কিভাবে শ্রমিকদের শোষণ প্রতারণা এবং শাসন করে তা দেখালেন। শ্রমিকরা সংঘবদ্ধ হয়ে শ্রমিক আন্দোলনের মাধ্যমে মালিকদের উচ্ছেদ করে নিজেরাই একদিন রাষ্ট্র ও শিল্প কারখানার মালিক হবেই। মার্ক্সের এই শ্রেণি সংগ্রামের তত্ত্ব গোটা পৃথিবীকে ঝাঁকুনি দিতে সক্ষম হয়। ধারণা করা হয়, পৃথিবীতে এমন কোনও দেশ নেই, যেখানে এক বা একাধিক ভাষায় ‘পুঁজি’ গ্রন্থটি অনুদিত হয়নি। শিকাগো এমনিতে একটি শিল্প সমৃদ্ধ শহর ছিল। মার্ক্সবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ততোদিনে শিকাগোতে শক্তিশালী শ্রমিক সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে। দিবারাত্রি অমানুষিক পরিশ্রমের বদলে শ্রমিকরা দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের সময়সীমার দাবী তুলল। ১ মে ধর্মঘটের ডাক দেয়া হল। কার্লমার্ক্সের সোজা বক্তব্য ছিল বুর্জোয়া দেশগুলোতে গণতন্ত্র মানে ধনীক শ্রেণির ক্ষমতা ভোগের একটি ব্যবস্থা মাত্র। বুর্জোয়া রাষ্ট্র ব্যবস্থা আসলে পুঁজিপতিদের শাসন। এই পুঁজিপতিরা রাষ্ট্রের সামরিক, বেসামরিক ও বিচার ব্যবস্থাকে এমনভাবে ব্যবহার করে, যেন শ্রমিক কৃষকের উপর শোষণ অব্যাহত রাখা যায় এবং শ্রমিক কৃষকের যে কোনও প্রতিবাদ সংগ্রাম বিক্ষোভ দমন করা যায়। শিকাগোতে ঠিক তাই’ই হয়েছিল। পুঁজিপতিদের সরকার পুলিশকে নির্দেশ দিল ধর্মঘটীদের থামাও। পুলিশ গুলি করল। লুটিয়ে পড়ল ৬ জন শ্রমিক। হাতে কলমে প্রমাণ হলো পুঁজিপতিদের প্রতিভূ হলো শাসক শ্রেণি। শ্রমিক শ্রেণি হলো নিতান্তই শোষিত এবং শাসিত।
বিংশ শতককে বলা হয় সমাজতন্ত্রের শতাব্দী। ফরাসী বিপ্লবের অনুকরণে ১৯০৫ সালে রাশিয়ায় বিপ্লবীরা ‘জারের’ রাজতন্ত্রকে অনেকগুলো সাংবিধানিক সংস্কার সাধনে বাধ্য করে। নড়বড়ে এই রাজতন্ত্রকে লেনিনের বলশেভিক পার্টি আবার আঘাত হানে ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ‘জার’ রাজ পরিবারকে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করা হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় মধ্যবিত্ত ‘কেরনস্কি সরকার’। এটিই বিখ্যাত ফেব্রুয়ারি বিপ্লব। শেষ পর্যন্ত শ্রমিক ও সামরিক কমিউনিস্ট বলশেভিকদের সশস্ত্র আক্রমণের মুখে ২৫ অক্টোবর ১৯১৭ (পরিবর্তিত ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৭ নভেম্বর ১৯১৭) কেরেনস্কি দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। রাশিয়ার রাজনৈতিক ক্ষমতা গ্রহণ করলেন রুশ বলশেভিক (কম্যুনিস্ট) নেতা লেনিন। ১৯৪৯ সালে কৃষকদের বন্দুকের গুতোয় চীনের বুর্জোয়া সরকারকে উৎঘাত করে মাও সে তুং চীনে প্রতিষ্ঠা করলেন সমাজতন্ত্র। ১৯৫৯ সালের ১ জানুয়ারি ফিদেল ক্যাস্ট্রো আর চে গুয়েভারার নেতৃত্বে কিউবায় সফল হয় সমাজতন্ত্র। এটি আজো টিকে আছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তিতে একের পর এক দেশ ব্রিটিশ ফ্রান্স ও স্পেন থেকে স্বাধীনতা লাভ করছিল। এক সময় মনে হচ্ছিল গোটা পৃথিবীতেই শ্রমিক শ্রেণির রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে। সার্থক হতে চলেছে মে দিবসের আত্মত্যাগ। বিংশ শতকের ১ মে তারিখে গোটা পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে লাল পতাকার মিছিল ছিল সব’চে উদ্দীপক রাজনৈতিক প্রতিবাদ। আজ এর অনেকটুকুই শুধু স্মৃতি এবং ইতিহাস। শ্রমিক শ্রেণির সংগ্রামে, সমাজতন্ত্রের এই আপাতঃ ব্যর্থতার দায়ভার মিথাইল গর্বাচেভ ও সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির।
তবে আজকের বাস্তবতা শেষ কথা নয়। ধারণা করা হয় একবিংশ শতকের দ্বিতীয় পর্বে পুঁজিবাদের ব্যর্থতা, বিশৃঙ্খলা ও পতন অবধারিত। আবার পৃথিবীর দেশে দেশে জেগে উঠবে সমাজবদলের সংগ্রাম। আবার পৃথিবীর দেশে দেশে একটি বিশেষ দিনে শোভা পাবে লাল পতাকার মিছিল। ১ মে বা মে দিবস বা শ্রমিক দিবস নামের দিনটি মুক্তির স্বপ্ন রং এ রাঙিয়ে দেবে পৃথিবীব্যাপী শোষিত, বঞ্চিত, মেহনতি মানুষকে।
লেখক: আইনজীবী, প্রাবন্ধিক।