নৃত্যের সংস্কৃতি শরীরের অভিব্যক্তি

খন রঞ্জন রায় | শনিবার , ২৯ এপ্রিল, ২০২৩ at ৫:৫৬ পূর্বাহ্ণ

মানুষের অতীন্দ্রিয় চেতনার বিভিন্ন কুপ্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করার কুশলি প্রয়োগ নৃত্য বা নৃত্যকলা। এই কলাকৌশলের মর্মগত অবস্থান সুদূর বিস্তৃত। প্রকৃতি ও সমাজের দ্বান্দ্বিকতা মোকাবিলা করে ইতিহাসের বিচিত্রবিধ গতি নিয়ে চলমান থাকে এই নৃত্যকলা। অবজ্ঞার দৃষ্টিতে নয়, বুদ্ধি ও চিন্তার সমন্বয়ে। মৌলিক চিন্তাসম্পন্ন সংহতরূপে। সৃষ্টিকর্মের সার্থকতার সাহসী প্রয়াস নিয়ে ইতালীফ্রান্স নৃত্যের জারকরসে সমৃদ্ধ হয়। ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সংমিশ্রণ ঘটাতে থাকে।

ভোগবাদের রমরমা যুগ শুরু হয়। নৃত্যকে রাজ্যসভায় প্রবেশ ঘটানো হয়। রাজা চতুর্দশ লুই এর রাজত্বকালে নৃত্য বিধিবদ্ধ নিয়মে আসতে শুরু করে। নৃত্য রচনাশৈলীর আনুষ্ঠানিকতা লাভ করে। ১৬৬১ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে নৃত্যকলা শিক্ষার প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা হয়। নাচের সাথে সঙ্গীত কাব্য, নাট্য, গান, পোশাক সমন্বয় করে লৌকিক সংস্কৃতির নতুন এক ধারার প্রবর্তন করা হয়। নতুন এই ধারার সম্ভাবনা ও বিকাশ চিন্তা করে নাম দেওয়া হয় ‘ব্যালে’।

পশ্চিমা ব্যালে, আধুনিক নৃত্য ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যের মধ্যে ভরতনাট্যমের অনুশীলনজাত ভাগ বিভাগে ধ্রুপদী অন্যতম লোকজ সংস্কৃতি। ভারতের বিভিন্ন অংশ থেকে উদ্ভূত ঐতিহ্য, মহাকাব্য, পুরাণ থেকে মননদীপ্ত আনন্দময় এই নৃত্যের উদ্ভব হয়েছে। প্রতিটি অঞ্চলের তত্ত্ব ও সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব বিবেচনা করে মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয়। তীব্র ইতিহাসবোধের পরিচয় দিয়ে ভারতীয় অভিনয়শিল্প ব্যাখ্যা করে ৮টি অঞ্চলের নাচকে ধ্রুপদী হিসাবে স্বীকৃতি দেয়।

তামিল নাড়ুর ভরতনাট্যম, উত্তর, পশ্চিম ও মধ্য ভারতের কত্থক, কেরালার মোহিনী অট্টম কথাকলি, অন্ধ্র প্রদেশের কুচিপুডি, ওড়িশা অঞ্চলের ওড়িশি, মণিপুরের মণিপুরি, আসামীয় এলাকার সত্রীয়া নৃত্যকে নাট্যশাস্ত্রের বিধিবদ্ধ নীতিতে সুসঙ্গত প্রয়োগ ঘটাচ্ছে। নিষ্ঠা ও সর্বজনবিদিত এই সমস্ত লোকনৃত্যের তাৎপর্যপূর্ণ কারণ গ্রাম সম্প্রদায়ের দৈনন্দিন অভিব্যক্তি। লোকসংস্কৃতিকে অবজ্ঞা করে নয়, মননগত উৎকর্ষ ও মূল্যবোধের আলোকে। মহৎ মানবিক লক্ষ্যকে সামনে রেখে ধর্মীয় ভাব প্রকাশ করার একান্ত মূর্ত ও স্পষ্ট প্রকাশ উদ্দেশ্যে।

কল্পিত উপাখ্যানের সাথে জ্ঞানানুসন্ধান করে বাস্তবজীবনের ঘাতপ্রতিঘাত, আনন্দবেদনা, জন্মমৃত্যু, স্বপ্নপ্রত্যাশা নিয়ে দীর্ঘ এক সমগ্রসন্ধানী হয় নৃত্য। সমসাময়িক কালে শক্তিমান কিছু অনুসন্ধানী প্রয়াসী কলাকৌশল সংযুক্ত হয়। সঙ্গীতশাস্ত্রের প্রধান তিনটি অঙ্গের অন্যতম একটি অঙ্গতে পরিণত হয় নৃত্য।

গতিছন্দপ্রকাশভঙ্গীর দেহ ভঙ্গিমায় ব্যক্তি মানুষের আকুল আর্তি প্রকাশ পায়। প্রাগৈতিহাসিককালের যৌক্তিকভাবে প্রযুক্ত এই কলা মানুষের নান্দনিকতা ও অনুভূতি প্রকাশের স্বচ্ছ ছবি হয়ে দাঁড়ায় ‘নৃত্য’। আদিমকাল থেকে পৃথিবীর প্রতিটি জনগোষ্ঠীর পৃথক ও স্বতন্ত্র পূর্ণ এক অখণ্ড সত্তা হয়ে আত্মপ্রকাশ করে নৃত্যকলা। লোকায়িত জীবনোপলব্ধির প্রবল ভাবোম্মাদ নিয়ে নাট্যকলার চুলচেরা বিশ্লেষণ করে বর্তমান নাট্যধারাকে প্রধানত ৪টি ভাগে বিভক্ত করা যায়।

ধ্রুপদী, আদিবাসী, লোক এবং আধুনিক। নৃত্যশিল্পের আঁধার কক্ষ থেকে দর্শক শ্রোতার মানসভুবনকে আলোকিত করে সৃষ্টি হয় আধুনিক নৃত্য। উনিশ ও বিশ শতকের শুরুতে জার্মানি ও মার্কিনিরা মিলে অসামান্য নিষ্ঠায় নৃত্যধারার ঐতিহ্য পুনরাবর্তন ঘটান। সৃজনশীল এই নৃত্যধারাটি পরবর্তীতে রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর তৎপরে বহু বর্ণবিভঙ্গে নতুন রূপ দান করেন উদয়ন শংকর। বিভিন্ন অঙ্গিকের নৃত্যরীতিকে ভেঙে সংগীত, নৃত্য চারু ও কারুশিল্পের সমন্বয় ঘটান। বিলাস ও প্রমোদ এবং উপকরণসামগ্রী থেকে গণমানুষের জীবনধারায় সাঁকো বাঁধেন।

১৯৩১৩২ সালে নৃত্যকে দ্বন্দ্ব সংকটের বৃত্ত থেকে বের করে ইউরোপআমেরিকায় সৃজিত আধুনিক নৃত্যকলা প্রদর্শন শুরু করেন। নেপথ্যে সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন শচীন দেববর্মণ, আলাউদ্দিন খাঁ, আলি আকবর খাঁ প্রমুখ খ্যাতিমান শিল্প বোদ্ধারা। কল্পনাজগতের স্রষ্টা নতুন এই নৃত্যধারা পশ্চাদপদতার মূল উপড়ে ফেলতে সক্ষম হয়। ১৯৬১৭০ সালে সিনেমাতে সংযোজন ঘটান নতুন এই ‘শঙ্কর স্কোপ’।

উদয় শঙ্করের দূরদর্শিতা আর বিশ্বব্যাপী নতুন এই রীতির প্রদর্শন কারণে নৃত্যের এই আধুনিক ধারা ভারতীয় শাখা হিসাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৯৮০ এর পরে নৃত্যের এই ধারা বিশাল ব্যাপক প্রবলভাবে জনপ্রিয় হয়ে, অনেকের জীবন ও জীবিকার সন্ধান দেয়। নৃত্য অভিভাবকসুলভ দায়িত্ব পালন করতে থাকে। ভ্রান্তিবহুল শিল্পমাধ্যমের খোলনলচে থেকে বেড়িয়ে অনবদ্য উদ্ভব ঘটায়।

বাংলাদেশ অঞ্চলের প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী বুলবুল চৌধুরী এ দেশের নৃত্যশিল্পকে অন্ধকার থেকে আলোর সীমানায় পৌঁছে দেন। রক্ষণশীল সামাজিক মনোভাবকে চ্যালেঞ্জ করে নাচকে জনপ্রিয় শিল্পমাধ্যমে উন্নীত করেছিলেন। ছবি ও রঙের মতো অত্যন্ত জটিল নৃত্যরূপকে সহজসরল অভিব্যক্তির প্রকাশভঙ্গিতে দর্শকের আকর্ষণবোধের স্থানে নিয়ে গিয়েছিলেন। দেহের ছন্দকে সৃজনশীল নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে গতিশীল আলোড়ন ফুটিয়ে তোলার দেহআত্মাভাষা একসূত্রে গাঁথা বলে আবিষ্কার করেন। নৃত্য যে মানুষের মনোজাগতিক প্রকাশভঙ্গি তা প্রমাণ করতে সামর্থ্য হন।

দুমর কুসংস্কার আচ্ছন্ন আমাদের সমাজব্যবস্থায় নৃত্য এখন অন্যতম প্রধান একটি শিল্পমাধ্যম। মানস প্রতিবন্ধের বিপরীতে মানুষের শিল্পরুচিতে সৃষ্টিশীল প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে। এখন সংস্কৃতির প্রতিটি অধ্যায়ে নৃত্যের মানবিক উপস্থাপন অবশ্যঅবধারিত হয়ে লক্ষ্যবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

নৃত্য নিয়ে ব্যক্তিমানুষের চিন্তা তত্ত্ব ও বোধের সামষ্ঠিক ফলাফল ‘বিশ্ব নৃত্য দিবস’। অবশ্য দিবসটি উদযাপন করা হয় আধুনিক ব্যালে নৃত্যের স্রষ্টা ফরাসি নাগরিক জ্যাঁ জর্জ নোভেরে’র জন্মদিনকে স্মরণ করে। ১৭২৭ সালে প্যারিসে জন্ম নেওয়া এই স্রষ্টা ১৭৫৪ সালে নতুন নৃত্যধারা ‘ব্যালে’ আবিষ্কার করেছিলেন।

নৃত্য অরিবাম পড়াশোনা নিরীক্ষা আর কর্মতৎপরতার ফসল বলে প্রথম তিনিই শিল্প সমালোচকদের বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর এই ভাবনা থেকেই ১৭৬০ সালে রচনা করেন ‘লেটারস অন দ্য ড্যান্স’ নামক প্রথম পূর্ণাঙ্গ ব্যাকরণ ভিত্তিক নৃত্যগ্রন্থ।

ব্যালের শেক্সপিয়ার হিসাবে আলোড়িত এই গ্রন্থের জনক ক্ষণজমা শিল্পী জর্জ নোভের ১৮১০ সালের ১৮ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন। তার অবদানকে স্বীকৃতি দিতে ইউনেস্কো ১৯৮০ সালে আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস পালনের ঘোষণা দেয়। যথারীতি তারিখ হিসাবে বেছে নেয় জর্জ নোভের জন্ম দিন ২৯ এপ্রিলকে। শুরু থেকেই পৃথিবীব্যাপী এই দিবস আন্তর্জাতিক মর্যাদা পায়।

১৯৯১ সাল থেকে রাজনৈতিক আদর্শ, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ, পেশাগত পরিচয় বাদ দিয়ে বিশেষভাবে পালন শুরু হয়। ইউনেস্কোর প্রধান সহযোগী সংস্থ্যা পারফর্মিং আর্টসএর নিয়ন্ত্রণে আইআইটি, ইন্টারন্যাশনাল ড্যান্স কমিটি বাংলাদেশ, বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থাসহ সামাজিকসাংস্কৃতিক কিছু সংগঠন যথাযজ্ঞ মর্যাদায় ১৯৯৫ সাল থেকে এই দিবস পালন করে আসছে বাংলাদেশে। আজকের দিনে প্রাকবৈদিক যুগে আবির্ভাব ঘটে বৈদিককোত্তর যুগ হয়ে বর্তমান আধুনিক যুগের জনপ্রিয় নৃত্যধারা সাধনায় জড়িত সকল কলাকৌশল, নৃত্যশিল্পীপ্রজন্মকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন।

লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক.

পূর্ববর্তী নিবন্ধ২৯শে এপ্রিল : স্মরণীয় একটি দিন
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে