জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য : একটি সমীক্ষা

ড. আজিজ আহমদ ভূঞা | শুক্রবার , ২৮ এপ্রিল, ২০২৩ at ৫:৪৩ পূর্বাহ্ণ

আজ ২৮ এপ্রিল জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস। প্রতিবছরের ন্যায় এবছরও এ দিবসটি সারা দেশব্যাপী যথেষ্ট উৎসাহ ও উদ্দীপনার মাধ্যমে পালিত হচ্ছে।

আর্থিকভাবে অসচ্ছল, সহায়সম্বলহীন এবং নানাবিধ আর্থসামাজিক কারণে বিচার প্রাপ্তিতে অসমর্থ বিচারপ্রার্থী জনগণকে আইনগত সহায়তা প্রদান কল্পে সরকার ২০০০ সালের ২৬ জানুয়ারী আইনগত সহায়তা প্রদান আইন প্রণয়ন করে। একটি আদর্শ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার মূল দর্শন হলো জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকলেরই অধিকার সমান। ধর্ম, বর্ণ কিংবা আর্থিক অসঙ্গতির কারণে কাউকে তার বিচার পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবেনা। কিন্তু আর্থিক সঙ্গতি সকলের সমান থাকেনা। ফলে দরিদ্র মানুষ যখন আইনের আশ্রয় নিতে পারেনা তখন তাকে অর্থাৎ অসহায় ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের আইনি সহায়তা দেওয়া হয়। বিচার প্রক্রিয়ার যেকোন স্তরে কিংবা বিচার প্রক্রিয়ার আগে বা পরে কাউকে আইনি বিষয়ে প্রয়োজনীয় যেকোন সহায়তা দেওয়াকে আইনগত সহায়তা বলা যায়। আইনগত সহায়তার মূল বিষয় হলো অসহায়, দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে আইনগতভাবে সহায়তা দেওয়ার মাধ্যমে বিচার লাভের সুযোগ করে দেওয়া।

নাগরিকদের মৌলিক চাহিদাগুলো মেটানো রাষ্ট্রের দায়িত্ব। অর্থের অভাবে কেউ যদি তার বৈধ অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় অথবা আইনের আশ্রয় না পায় তবে তার অন্য সব মৌলিক চাহিদা গুলোও দুর্বল হয়ে পড়ে। কাজেই আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার হলো অন্যান্য মৌলিক চাহিদার সম্পূরক একটি অধিকার। আইনগত সহায়তা সামাজিক ন্যায়বিচারের পথকে সুগম করে দেয়। গরিব ও নিঃস্ব মানুষ যাতে আইনের আশ্রয় লাভের জন্য আদালত পর্যন্ত এসে পৌছাতে পারে তার ব্যবস্থা রাষ্ট্রকে করতে হয়। মূলত এজন্যই আইনগত সহায়তার সৃষ্টি। গরিব, নিঃস্ব, অসহায় ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী যারা আর্থিক কিংবা অন্যান্য আর্থসামাজিক কারণে আইনের আশ্রয় নিতে অক্ষম, তাদের সরকারী আইনী সহায়তা দেওয়ার মাধ্যমে আইনের আশ্রয় লাভের সুযোগ করে দেয়।

জনহিতকর কাজের মধ্য দিয়ে সমাজের কল্যাণ সাধন করা রাষ্ট্রের একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আইনগত সহায়তা কার্যক্রম একটি জনকল্যাণমূলক সামাজিক কর্মসূচি। আইন কখনো মানুষে মানুষে বৈষম্যকে সমর্থন করেনা। পৃথিবীর সব মানবাধিকার দলিলে আইনগত সহায়তা পাওয়ার অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ১২১৫ সনে রচিত ম্যাগনা কার্টার ৩৯ এবং ৪০ অনুচ্ছেদে, ১৯৪৮ সনে প্রণীত মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণার ৭, ৮ ও ১০নং অনুচ্ছেদে, ১৯৬৬ সনে গৃহীত নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তির ১৪নং অনুচ্ছেদে, ১৯৮৬ সনে গৃহীত মানবাধিকার বিষয়ক আফ্রিকান সনদের ৩ এবং ৭নং অনুচ্ছেদে, ১৯৫০ সনে গৃহীত ইউরোপীয় মানবাধিকার কনভেনশনের ৬নং অনুচ্ছেদে আইনগত সহায়তা, সমতা ও সুবিচারকে মানবাধিকার হিসেবে স্পষ্টভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

বর্তমান সময়ে পৃথিবীর প্রায় সব দেশের সংবিধানেই সমতা ও বিচার প্রাপ্তির অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।”

আর্থিক অভাবের কারণে কোনো নাগরিক আইনের আশ্রয় নিতে পারবেননাএটি কোনভাবেই একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চরিত্র হতে পারেনা। প্রকৃতপক্ষে, আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে রাষ্ট্রের কোনো নাগরিক যদি আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়, তবে সংবিধানে বর্ণিত আইনের শাসন, সমতা, মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকারের বিধান অর্থহীন হয়ে পড়বে। সেজন্যই গরিব, অসহায় ও নিঃস্ব মানুষ যেন আইনি প্রতিকার পেতে পারে ও আইনজীবী নিয়োগ করতে পারে, মামলা পরিচালনার খরচ নামমাত্র মূল্যে বা বিনামূল্যে পেতে পারে সেজন্যই রয়েছে আইনগত সহায়তা।

স্বাধীনতার এক বছরের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের যে অভিনব শাসনতন্ত্র অর্থাৎ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করা হয় তার প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে– “রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।”

সংবিধানে বর্ণিত রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতেও উচ্চারিত হয়েছে মানবাধিকার ও সাম্যের শ্লোগান। রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম মূলনীতি হিসেবে সংবিধানের ১১নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে।”

রাষ্ট্র পরিচালনার অপরিহার্য একটি মূলনীতি হিসেবে ১৯() নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবে।” সকল নাগরিককে নীতিগতভাবে আইনের দৃষ্টিতে সমান বলা হলেও সামাজিক বৈষম্য ও আর্থিক অসঙ্গতি মানুষে মানুষে ভেদাভেদ তৈরী করে। ধনী ও স্বচ্ছল মানুষের পক্ষে আইনের আশ্রয় লাভ করা যতোটা সহজ, দরিদ্র মানুষের পক্ষে ততটাই কঠিন। সমাজের দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষ আইনের সমতা প্রতিষ্ঠা করার জন্য এবং জনগনকে ন্যায়বিচার তথা আদালতে প্রবেশে সক্ষম করার জন্য দরকার আইনগত সহায়তা ব্যবস্থা।

সংবিধানের ২৮() নং অনুচ্ছেদে ‘মৌলিক অধিকার’ অংশে আরো পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী, পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।’

সংবিধানের ৩১ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহার লাভ যেকোন স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষতঃ আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবেনা, যাহাতে কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।”

সংবিধানের ৩৩() নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “গ্রেফতারকৃত কোন ব্যক্তিকে যথাসম্ভব শীঘ্র গ্রেফতারের কারণ জ্ঞাপন না করিয়া প্রহরায় আটক রাখা যাইবেনা এবং উক্ত ব্যক্তিকে তাঁহার মনোনীত আইনজীবীর সহিত পরামর্শের ও তাঁহার দ্বারা আত্নপক্ষ সমর্থনের অধিকার হইতে বঞ্চিত করা যাইবেনা।”

আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০” এর আওতায় সরকারি আইন সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সরকার একই বছর “জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা” নামে একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে। উক্ত সংস্থার অধীনে ইতোমধ্যে দেশের ৬৪টি জেলায় জেলা ও দায়রা জজের নেতৃত্বে জেলা লিগ্যাল এইড কমিটি গঠন করা হয়েছে। জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির পাশাপাশি সারাদেশের উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়েও লিগ্যাল এইড কমিটি গঠন করা হয়েছে। বর্তমানে উক্ত সংস্থার তত্ত্বাবধানে সুপ্রীম কোর্ট কমিটি, জেলা কমিটি, উপজেলা কমিটি এবং ইউনিয়ন কমিটি আইনগত সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এছাড়া বিভিন্ন শ্রম আদালত ও চৌকি আদালতগুলোতেও সরকারি আইন সহায়তা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। প্রত্যেক জেলা জজ আদালত প্রাঙ্গণে ‘জেলা লিগ্যাল এইড অফিস’ স্থাপন করা হয়েছে। ‘লিগ্যাল এইড অফিস’ কে আরো কার্যকর, গতিশীল ও সেবাবান্ধব করার লক্ষ্যে প্রত্যেক জেলায় জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার (সিনিয়র সহকারী জজ/ সহকারী জজ পদমর্যাদার বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাগণকে প্রেষণে) পদায়ন করা হয়েছে। জেলা লিগ্যাল এইড অফিসারগণ আইনগত সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি বিনামূল্যে আইনগত পরামর্শ প্রদান করেন এবং পক্ষগণের মধ্যকার বিরোধ বা মামলা বিকল্প পদ্ধতিতে নিষ্পত্তি করে থাকেন।

সরকারি আইন সহায়তা কার্যক্রমের সফল বাস্তবায়নের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন জনসচেতনতা। সরকারি আইন সহায়তা কার্যক্রমের সাফল্য নির্ভর করছে ব্যাপক প্রচারপ্রচারণা ও জনমত সৃষ্টির উপর। এখনও এদেশের জনগণের একটি অংশ দরিদ্র ও নিরক্ষর। এই দরিদ্র ও নিরক্ষর জনগণ তাদের আইনগত অধিকার সম্পর্কে ততটা সচেতন নয়। এসব মানুষের অধিকার লঙ্ঘিত হলে অথবা কোনো আইনী জটিলতায় পতিত হলে আর্থিক দৈন্যতা কিংবা সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে তারা আইন আদালতের আশ্রয় নিতে পারে না। এভাবে নানাবিধ আর্থসামাজিক প্রতিবন্ধকতা কিংবা দারিদ্রতা বা অপ্রাচুর্যের কারণে অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষ ন্যায় বিচারে প্রবেশাধিকার থেকে প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছে। এজন্য দেশের আপামর জনসাধারণের আইনি অধিকার নিশ্চিত করার সাথে সাথে তাদেরকে সরকারি আইন সহায়তা কার্যক্রম সম্পর্কে সচেতন করার লক্ষ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে গত ২৯.০১.২০১৩ খ্রিঃ তারিখে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে সরকার “আইনগত সহায়তা প্রদান আইন ২০০০” কার্যকরের তারিখ অর্থাৎ ২৮ এপ্রিল কে ‘জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস’ ঘোষণা করে।

উল্লেখ্য, আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০ এর ৭() ধারা অনুসারে আইনগত সহায়তা প্রদান নীতিমালা, ২০০১ এর ২৪ ধারা অনুসারে আইনগত সহায়তা প্রদান প্রবিধান মালা, ২০০১ প্রণয়ন করা হয়। ২০১১ সালে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা (উপজেলা ও ইউনিয়ন কমিটি গঠন, দায়িত্ব, কার্যাবলী ইত্যাদি) প্রবিধান মালা, ২০১১ প্রণয়ন করা হয়। ২০১৪ সালে ২০০১ সালের নীতিমালা বাতিল করে আইনগত সহায়তা প্রদান নীতিমালা, ২০১৪ এবং ২০১৫ সালে ২০০১ সালের প্রবিধানমালা বাতিল করে আইনগত সহায়তা প্রদান প্রবিধানমালা, ২০১৫ প্রণয়ন করা হয়। এছাড়া ২০১৫ সালে আইনগত সহায়তা প্রদান (আইনী পরামর্শ ও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি) বিধিমালা, ২০১৫ প্রণয়ন করা হয়।

ইতোপূর্বে সরকার আইনী সহায়তা কর্মসূচীর আওতায় দরিদ্র বিচার প্রার্থীদের প্যানেল আইনজীবীর মাধ্যমে শুধু মামলা মোকদ্দমা দায়ের ও পরিচালনায় সহায়তা দেওয়া হতো এবং সরকারি তহবিল থেকে প্যানেল আইনজীবীদের ফি পরিশোধ করা হতো। এ আইনের আওতায় আর্থিকভাবে অসচ্ছল ব্যক্তি বলতে যার বার্ষিক গড় আয় ১,০০,০০০/- টাকার অধিক নয়, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টে কোন মোকদ্দমার কোন পক্ষ যার বার্ষিক গড় আয় ১,৫০,০০০/- টাকার অধিক নয়, মুক্তিযোদ্ধার ক্ষেত্রে যার বার্ষিক গড় আয় ১,৫০,০০০/- টাকার অধিক নয় এমন ব্যক্তি। আর্থিকভাবে অসচ্ছল ব্যক্তি ছাড়াও কর্মক্ষম নয় বা আংশিক কর্মক্ষম বা কর্মহীন ব্যক্তি, অসহায় বৃদ্ধ, কোন শিশু, বিধবা বা স্বামী পরিত্যক্তা নারী, এসিডদগ্ধ নারী ও শিশু, মানবপাচারের শিকার ব্যক্তি, ভিজিডি কার্ডধারী দুস্থ মাতা, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, বিনা বিচারে কারাগারে আটক ব্যক্তিসহ নানা আর্থ সামাজিক কারণে বিচার পেতে অক্ষম ব্যক্তি এই কার্যক্রমের অধীনে আইনগত সহায়তা পাবেন। অর্থাৎ আইনগত খরচে আইনি সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্র অত্যন্ত বিস্তৃত রাখা হয়েছে যাতে অধিক সংখ্যক ব্যক্তি এর আওতায় আসতে পারেন।সীমিত পরিধির আইনী সেবা থেকে বেরিয়ে বর্তমানে আইনগত সহায়তার ক্ষেত্র ও পরিধি অনেকটাই বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে যেসব আইনগত সহায়তা দেওয়া হয় তা হলো :

আইনগত সহায়তা প্রদান, বিনামূল্যে ওকালতনামা সরবরাহ, আইনজীবী নিয়োগের মাধ্যমে মামলা মোকদ্দমা পরিচালনা, আইনজীবীদের ফি পরিশোধ, মধ্যস্থতাকারী বা সালিশকারীর সম্মানী পরিশোধ, ফিক্সড কোর্ট ফি পরিশোধ, বিনামূল্যে রায় কিংবা আদেশের অনুলিপি সরবরাহ, ডিএনএ টেষ্টের যাবতীয় ব্যয় পরিশোধ, ফৌজদারী মামলায় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের ব্যয় পরিশোধ, মামলার সঙ্গে সম্পর্কিত প্রাসঙ্গিক সকল ব্যয় পরিশোধ এবং হটলাইনের মাধ্যমে তথ্য সেবা প্রদান।

লিগ্যাল এইড অফিসের প্রধান নির্বাহী একজন বিচারক হওয়ায় আইন ও বিচার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এবং বিচারকদের সঙ্গে এ অফিসের যোগাযোগ ও সমন্বয়ের একটি ক্ষেত্র তৈরী হয়েছে। এর ফলে লিগ্যাল এইড কমিটিগুলোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া যেমন সহজতর হয়েছে, বিচারপ্রার্থী মানুষের পক্ষেও আইনগত সহায়তা পাওয়ার সুযোগ তৈরী হয়েছে। এছাড়া লিগ্যাল এইড অফিসার পদে বিচারক নিয়োগের ফলে সাধারণ মানুষের কাছে এ অফিসের আস্থা ও গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

উল্লেখ্য, শুধুমাত্র সরকারি খরচে আইনজীবী নিয়োগের মধ্যে লিগ্যাল এইডের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ না রেখে দেশের আপামর জনসাধারণের আইনি সমস্যা সহজে নিরসনের লক্ষ্যে ২০১৫ সালে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসারের আইনী পরামর্শ প্রদান ও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) বা মধ্যস্থতার মাধ্যমে আপোষযোগ্য বিরোধ নিরসনের ক্ষমতা দেওয়া হয়। ফলে যে কোন আয়সীমার মানুষ আইনি পরামর্শ নিতে এবং আপোষযোগ্য বিরোধ মধ্যস্থতার মাধ্যমে সমাধানের জন্য জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের শরণাপন্ন হতে পারে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মীমাংসা বা এডিআর ছাড়া সফলভাবে লিগ্যাল এইড এর সেবা দেওয়া সম্ভব নয়। একারণে লিগ্যাল এইড অফিসকে ঘিরে এডিআর একটি নতুন সম্ভাবনা তৈরী হয়েছে। লিগ্যাল এইড অফিসের মাধ্যমে এডিআর বা মীমাংসা পদ্ধতি প্রয়োগ করে বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০ সংশোধন করে ২০১৩ সালে লিগ্যাল এইড অফিসারকে আইনি কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং একই সংগে লিগ্যাল এইড অফিসারকে বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষমতা প্রদান করা হয়।

উল্লেখ্য, আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০ এর ২১() ২ ধারা অনুযায়ী লিগ্যাল এইড অফিসার আইনগত সহায়তা প্রার্থীকে আইনি পরামর্শ প্রদান করতে পারবে এবং প্রচলিত আইনের অধীন কোন আদালত বা ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক উহার স্থানীয় অধিক্ষেত্রের আওতাধীন এলাকায় কর্মরত লিগ্যাল এইড অফিসারের নিকট বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য কোন বিষয় প্রেরণ করা হলে তা নিষ্পত্তির ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট লিগ্যাল এইড অফিসারের থাকবে।

এছাড়া উপরে বর্ণিত আইনের ধারা ২১() এর উদ্দেশ্য পূরণের জন্য লিগ্যাল এইড অফিসার কর্তৃক পরিচালিত বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তি তথা মধ্যস্থতা বা মীমাংসার কার্যপদ্ধতি নির্ধারণকল্পে আইনগত সহায়তা প্রদান (আইনি পরামর্শ ও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি) বিধিমালা, ২০১৪ প্রণয়ন করা হয়েছে।

এডিআর এর ফলে সম্পাদিত মীমাংসা চুক্তি একটি বৈধ আইনগত দলিল এবং যেকোন আইনগত কার্যধারায় তা সাক্ষ্য হিসাবে গৃহীত হবে। এই পদক্ষেপের ফলে মানুষ যেমন আপোষযোগ্য বিরোধসমূহ বিনা খরচে ও বিনা হয়রানিতে নিরসনের সুযোগ পেয়েছে তেমনি প্রিকেস মেডিয়েশনও পোস্টকেস মেডিয়েশন মামলা জট নিরসনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। একটি বিরোধ নিষ্পত্তি কমপক্ষে ৩৪ টি মামলার দায়ের আটকাচ্ছে বা দায়ের হয়ে গেলে তা নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করছে। এছাড়া জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা এবং জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের আইনি তথ্য প্রদান, আইনি শিক্ষা প্রদান কার্যক্রম, উঠান বৈঠক, বিতর্ক প্রতিযোগিতা ও লোকগান ইত্যাদি কর্মসূচি সাধারণ মানুষকে আইনগত অধিকার সম্পর্কে সচেতন করছে।

জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা’ বিনামূল্যে ক্ষতিগ্রস্ত বিচার প্রার্থীদের ১৩৪ কোটি ৯০ লাখ ৬ হাজার ৪৯৮ টাকা আদায় করে দিয়েছে। প্রতিবেদনে আরোও বলা হয়, সরকারি আইনি সহায়তা কার্যক্রমে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত ৬৪টি জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের মাধ্যমে প্রি ও পোস্ট কেস স্টেজে ক্ষতিগ্রস্ত বিচার প্রার্থীদের ১২৮ কোটি ৪১ লাখ ৯৩ হাজার ৯৩৬ টাকা আদায় করে দিয়েছে। এছাড়া ঢাকা ও চট্টগ্রাম শ্রমিক আইনগত সহায়তা সেলের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের ৬ কোটি ৪৮ লাখ ১২ হাজার ৫৬২ টাকা আদায় করা হয়েছে। চলতি বছর “বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণ বিনামূল্যে আইনী সেবার দ্বার উন্মোচন” এই স্লোগানকে সামনে রেখে জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস২০২৩ প্রতিপালিত হচ্ছে। লিগ্যাল এইড কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত সংশ্লিষ্ট সকলে আন্তরিকভাবে সরকারের এই মহতি উদ্যোগকে সর্বাত্নকভাবে সহায়তা করলে এই কার্যক্রম তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে বলে আশা করা যায়।

লেখক : সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ এবং চেয়ারম্যান,

জেলা লিগ্যাল এইড কমিটি, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমোহাম্মদ নাসির: চাটগাঁইয়া গানের প্রথম বিশ্বায়ন যাঁর কণ্ঠে
পরবর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা