বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকের গৌরবোজ্জ্বল ছাত্র রাজনীতির এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, চট্টগ্রামের সুসন্তান, বিগত ছয় দশকের বাম প্রগতিশীল ছাত্র ও জাতীয় রাজনীতির শুদ্ধতম ধারার অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি, বাম রাজনীতির বিভ্রান্তি ও ডান রাজনীতির বিরুদ্ধে আপসহীন যোদ্ধা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে উঠে আসার কারণে ডান–বাম উভয় পক্ষের বিকৃত মনের কিছু লোকের নানা কটূক্তি, জীবনের ভীতি উপেক্ষা করে, এমনকি নিজের ভিটে মাটি হারিয়েও দেশমাতৃকার বেদীমূলে পুরো জীবন উৎসর্গকারী, ত্যাগের মহিমায় উত্তীর্ণ ও জাতীয় রাজনীতির পাদ প্রদীপের আলোয় উদ্ভাসিত, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান সংগঠক জননেতা পংকজ ভট্টাচার্য গত ২৩ এপ্রিল দিবাগত রাতে প্রিয় স্বদেশের মাটিতে বলতে গেলে সাম্প্রদায়িক ও লুটেরা রাজনৈতিক অর্থনীতির দূর্বৃত্তদের সাথে সংগ্রামরত অবস্থায় শহীদের মৃত্যুবরণ করলেন। আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক, আমৃত্যু প্রত্যয়ী সমাজ পরিবর্তনের অসম ও চরম প্রতিকূল লড়াইয়ের এই নির্ভীক সেনানী নীতির প্রশ্নে কারো সাথে, কোন শক্তির সাথে কোনদিন আপস করেননি। ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন আদ্যন্ত সৎ, জীবনাচারের ও রাজনৈতিক বিশ্বাসের প্রতিকূলে এই বিপ্লবী নিভৃতে বা প্রকাশ্যে অনৈতিক পথে কখনো চলেননি। রাজনৈতিক সহকর্মীদের প্রতি আন্তরিক সৌহার্দ্যে ঋদ্ধ ছিল তাঁর হৃদয়–মন। এক সময়ের এই নিষ্ঠাবান সিপিবি নেতা বাস্তবের নিরিখে তত্ত্বানুসন্ধান করতেন–ঘৃণা করতেন তাত্ত্বিক ছুৎমার্গকে। প্রথমা প্রকাশনী থেকে সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর আত্মজীবনী “আমার সেই সব দিন” যেমন তাঁর জীবন ও কর্মের প্রোজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি, তেমনি এদেশের বিগত প্রায় সত্তর বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক প্রামাণ্য ও অনন্য দলিল। রাজনৈতিক কর্মী নির্বিশেষে প্রত্যেক সচেতন মানুষের অবশ্য পাঠ্য এই গ্রন্থ। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড ও এর পরবর্তী সামরিক শাসনামল এবং সর্বশেষ বিগত ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন, পর্বান্তরের সাম্প্রদায়িক ও সামাজিক সহিংসতা সহ প্রায় সবকিছু এবং এসব ঘটনার ঘনঘটায় নিজের ব্যক্তিগত ও দলীয় দায়, বাম রাজনীতির বিভ্রান্তির দায় এমন সহজ ভাষায় ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করেছেন যা পাঠ করলেই বুঝা যাবে যে দেশ ও জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ ও বিপক্ষ উভয়ের ইতিহাস বিকৃতির কুজ্ঝটিকা থেকে মুক্ত করার মহৎ প্রত্যয়ে সর্বোপরি রাজনৈতিক প্রয়োজনে তিনি যেন কলম ধরেছেন। ইতিহাসের সত্যটুকুকে, বাস্তব রংটুকুকে আপন তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলেছেন।
মনিসিং, পংকজ ভট্টাচার্য প্রমুখ নেতারা কোনদিন নিজেদের কোন ধর্মীয় সম্প্রদায়ভুক্ত রাজনৈতিক কর্মী বা নেতা মনে করেননি– ধর্ম সম্প্রদায়ের উর্ধ্বে মাতৃভূমির প্রতি দায় থেকে ,মানবতার সেবায়, গণমানুষের প্রয়োজনে নিজেদের সমস্তটুকু উজাড় করে দিয়েছেন দেশ ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণে। কিন্তু প্রতিপক্ষ তাঁদের চিহ্নিত করেছে “হিন্দু” হিসাবে, এমনকি হিন্দু তকমা লাগিয়ে সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানি রাষ্ট্রশক্তি এই দুজনের বাস্তুভিটা পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত করেছে। শুধু তাই নয় তাঁর এক সময়ের বাম সহকর্মীরা রাতারাতি বিপ্লবী বনে যাওয়া রণো–মেনন পন্থী ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীরা ১৯৬৫ সালের ভারত–পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তাঁর ভাষায় “তাদের কয়েকজন আমাকে বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবন চত্বরে আক্রমণ করে বসে। দৈহিক আঘাতের কষ্ট ছিল যৎসামান্য, বেশি লেগেছিল মনের গভীরে লাগা আঘাতটা। আমার একদার আদর্শিক সহকর্মীদের একাংশ সেদিন আমাকে “ভারতের চর,” “ভারতের দালাল” ইত্যাদি বলে আক্রমণ করেছিল। ভাবতে অবাক লাগে আইয়ুব–মোনায়েম চক্রের উচ্চারিত এই সাম্প্রদায়িক বাক্যগুলো সেদিন এই প্রগতিশীলদেরও প্রায় নিত্য ব্যবহার্য হয়ে উঠেছিল। (“আমার সেই সব দিন গুলো পৃ:৬০–৬১।) ছাত্র ইউনিয়ন ভাঙ্গাঁর পর পরই রনো–মেনন গ্রুপের কেন্দ্রীয় নেতা সদ্য প্রয়াত বহু নন্দিত, কথিত স্পষ্টভাষী ডা: জাফর উল্লাহ চৌধুরী তাঁকে “ঘড়ি চুরির” মামলায় আসামী করে মাসাধিক কাল জেল খাটান। এভাবে আত্মজীবনীতে সেদিনের কথিত চীনাপন্থীদের “বিপ্লবী” রাজনীতির স্বরূপ তিনি তুলে ধরেন। বাম রাজনীতির সর্বনাশা বিভক্তি নিয়ে তিনি লিখেছেন যে জনগণের শোষণ মুক্তির সংগ্রামে নিবেদিত শত শত কর্মীদের যাঁরা নিছক ব্যক্তিগত নেতৃত্ব ও উচ্চাশা থেকে বিশুদ্ধবাদিতার নামে বিভক্তি ও বিভাজনের গর্তে নিক্ষেপ করেছেন তারা অমার্জনীয় অপরাধ করেছেন। যুগ যুগ ধরে এই ভুলের মাশুল গুনতে হবে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে। কথাগুলো এখনো কতই না প্রাসঙ্গিক। অনুন্নত দেশের বাম নেতাদের অনুন্নত মানসিকতার অধিকারী হওয়া দেখে বাম রাজনীতির কর্মী হিসেবে নিজেই নিজেকে ধিক্কার দিয়েছেন।
১৯৭১ থেকে ’৭৫ পর্যন্ত এবং এর পরবর্তী সময়ের ঘটনাবলীর বিস্তৃত বর্ণনা আমরা তাঁর আত্মজীবনীতে দেখতে পাই। ’৬৭ সালে জেলখানাতে থাকতেই বঙ্গবন্ধুর সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠে। পরে ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর কাছে তাঁর গুরুত্ব বেড়ে যায়। ত্রিদলীয় গণ ঐক্যজোট কার্যকর না হওয়ায় ন্যাপ–সিপিবি বাকশাল বা একদল করার পক্ষে যে ছিলনা তা তিনি স্পষ্ট করেছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন নাকি তিনি নতুন দলে আওয়ামী লীগকে লেজে রাখবেন অর্থাৎ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ করবেন। কিন্তু হয়েছিল উল্টো। দলের বিশাল কেন্দ্রীয় কমিটিতে ন্যাপ সিপিবির সদস্য ছিল মাত্র ৩ জন। ১৫ আগষ্টের চক্রান্তের নির্ভরযোগ্য খবর পেয়ে তিনি ছুটে যান বঙ্গবন্ধুর কাছে। তাঁকে যথাসাধ্য বুঝিয়েছিলেন অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার হলো তিনি সম্ভাব্য খুনিদের নাম পর্যন্ত উল্লেখ করেও ওদের বিরুদ্ধে বা নিজের নিরাপত্তার জন্য কোন ব্যবস্থা নিলেন না।
পংকজ ভট্টাচার্য দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য অর্জনের ব্যর্থতা বা আজকের বাংলাদেশের সামাজিক রাজনৈতিক বিপর্যয়ের বিশেষত বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ড পরবর্তী দেশের অধ:পতিত বাস্তবতা সৃষ্টির ৫টি কারণের কথা উল্লেখ করেছেন। সেগুলো হল প্রথমত, তাজউদ্দিনের আন্তরিকতা সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধের সময় অটুট জাতীয় ও রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তুলতে না পারা, দ্বিতীয়ত, মোশতাক চক্রের অপতৎপরতা যা নির্বিঘ্নে ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট পর্যন্ত অব্যাহত থাকে, তৃতীয়ত, ছাত্রলীগের ভাঙ্গন ও জাসদ গঠনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির জাসদের মাধ্যমে অপরাজনীতির সুযোগ পাওয়া, চতুর্থত, বিজয়ের পূর্বাপর সময়ে জাতীয় সরকার গঠনের দাবী উপেক্ষা করে পরে অনুপযুক্ত সময়ে একদল করা ও পঞ্চমত এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল মোশতাককে সরকারে রেখে প্রাজ্ঞ ও পরীক্ষিত তাজউদ্দিনকে বের করে দেয়া। আমার মনে হয় বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসে বিশ্বাসে যে কেউ এ বিষয়গুলো নিয়ে দ্বিমত করবেন না।
পংকজ ভট্টাচার্য পুরো জীবন সার্বক্ষণিকভাবে মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে কাজ করেছেন। ১৯৬৪ সালে বাড়ী ভিটে হারিয়ে তাঁর মেধাবী শিক্ষক পিতা যখন অশ্রু সজল কন্ঠে তাঁর দেশ ত্যাগের সিদ্ধান্ত পংকজ বাবুকে জানান এবং তাঁকে ভারতে নিয়ে যেতে চান তিনি তখন বেদনার্ত হৃদয়ে নিজ পিতাকে তাঁর পূর্ব পুরুষের জন্মভূমি এই দেশের জন্য তাঁর একজন ছেলেকে উৎসর্গ করে দিতে অনুরোধ করেন। এই কথাবার্তার পরদিন চট্টগ্রামের বাসা থেকে পুলিশের হাতে তিনি গ্রেপ্তার হন। চট্টগ্রাম জেল থেকে যেদিন তাঁকে পুলিশ পাহারায় কুমিল্লা জেলে ট্রেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কাকতলীয়ভাবে তখন তিনি দেখতে পান যে, তাঁর বৃদ্ধ মা–বাবা সহ পরিবারের সদস্যরা দেশত্যাগ করার জন্য কলকাতার উদ্দেশ্যে চাঁদপুর গামী ট্রেনের জন্য প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছেন। কেউ কারে সাথে কথা বলতে পারছেন না। দেশের জন্য এই যে সকরুন আত্মাহুতি এটা তো বাস্তবে মহৎ মানবিক প্রতিশ্রুতি ছাড়া সম্ভব না। ক্ষমতা ও প্রতিষ্ঠা নয় সাধ্যমত সঠিক পথে দৃঢ় প্রত্যয়ে সমস্ত বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে চলার একজন বিপ্লবীর আমৃত্যু লক্ষ্য হওয়া উচিত। আত্মজীবনীতে তিনি উল্লেখ করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সদিচ্ছা থেকে তাঁকে প্রদত্ত মন্ত্রীত্ব গ্রহণের প্রস্তাব নিজ বিবেচনায় তিনি সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছেন। অথচ এক সময়ে নিজেদের বিপ্লবী জাহির করে যারা তাঁকে অপমান ও অপদস্থ করেছেন, বাম রাজনীতির ক্ষতি করেছেন, ন্যাপ–সিপিবি কে আওয়ামী লীগের বি টিম বলেছেন সেই মেনন–দিলীপ বড়ুয়ারা আওয়ামী লীগের মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করে বাম রাজনৈতিক বিকল্প গড়ে তোলার পথে সমূহ সর্বনাশ করেছেন।
সিপিবি’র সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৭২ সালে তাঁদের কয়েকজনকে ন্যাপে রেখে অধিকাংশ ত্যাগী সংগঠক ও নেতাদের ন্যাপ থেকে সিপিবিতে নিয়ে যাওয়াকে তিনি মেনে নিতে পারেননি যার কারণে সেদিনের বৃহৎ জনপ্রিয় দল ন্যাপ দুর্বল হয়ে পড়ে। সর্বোপরি বঙ্গঁবন্ধুর মৃত্যুর পর জাতীয় নেতা হিসেবে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারেননি বলে তিনি সমালোচনা করেছেন। পরবর্তীতে ন্যাপের ভাঙ্গন, মতিয়া–সুরঞ্জিতদের আওয়ামী লীগে যোগদান তিনি মানতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির মধ্য থেকে আওয়ামী লীগের একটি শক্তিশালী বিকল্প গড়ে তুলতে তিনি আমৃত্যু সচেষ্ট ছিলেন। কখনো গণফোরাম, কখনো সামাজিক আন্দোলন এবং শেষ পর্যন্ত ঐক্য ন্যাপ গঠন করে সবাইকে বিশেষ করে সিপিবি পরিবারকে এক জায়গায় নিয়ে আসতে চেয়েছেন। নীতিহীন সুবিধাবাদিতা নয় বিপ্লবী প্রয়োজনের তাগিদে তিনি আজীবন পথ চলেছেন। বয়সের ভারে দুর্বল হয়ে পড়া ও এক সময়ের সার্বক্ষণিক নারী কর্মী, তুখোড় সাবেক ছাত্র ইউনিয়নের নেত্রী স্ত্রী রাখী দাশ পুরকায়স্থের ২০২০ সালে মৃত্যু তাঁকে নিঃসঙ্গ ও হতোদ্যম করে দেয়। গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হিসাবে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে শেষ পর্যন্ত তিনি সক্রিয় ছিলেন। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের অনাগ্রহ ও নিষ্ক্রিয়তায় তিনি ক্ষুব্ধ ছিলেন। চিন্তা মনন ও মানব মুক্তির কাজ থেকে মৃত্যুই শেষ পর্যন্ত তাঁকে বিরত করতে পারল। এ মৃত্যু গৌরবের। মানুষ নয়, মানুষের ধর্মীয় পরিচয় প্রধান হয়ে উঠার এই দু:সময়ে তিনি এদেশের মাটিতে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে, জননেতা হিসাবে মানুষের শ্রদ্ধায় ভালোবাসায় চিরবিদায় নিলেন। লাল সালাম পংকজ ভট্টাচার্য।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক।