চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ: মুক্তির স্বপ্নে এই বাংলায় প্রথম সশস্ত্র বিপ্লব

তপন ভট্টাচার্য্য | মঙ্গলবার , ১৮ এপ্রিল, ২০২৩ at ৫:৩৫ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহই ছিলো মুক্তির স্বপ্নে এই বাংলায় প্রথম সশস্ত্র বিপ্লব। যুব বিদ্রোহের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ এ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলার বুকে রক্তগঙ্গায় জেগে উঠেছিলো স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ে অবিভক্ত ভারতের স্বাধীন তেজদ্বীপ্ত সূর্য ইংরেজরা পরাধীনতার চাদরে ঢেকে দিয়েছিলো। প্রায় ১৬৫ বছর নানা প্রতিবাদ ও প্রতিঘাতেও ব্রিটিশরা শাসন ও শোষণ বজায় রাখার জন্য দিন দিন হিংস্র হয়ে উঠেছিলো। ব্রিটিশদের অত্যাচার, সিপাহী বিদ্রোহ, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের হিংস্রতায় সারা ভারতের মতো বাংলাও ফুঁসে উঠেছিল। ১৯২৯ সালে চট্টগ্রামের জেলা কংগ্রেসের সম্মেলনে সভাপতি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। এতে মাস্টারদা সূর্যসেন সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। সহিংস আন্দোলনের জন্য ১৯১৮২৯ সাল পর্যন্ত বিট্রিশ বিরোধী বিভিন্ন কর্মসূচিতে আলোচিত মাস্টারদা সূর্যসেন’কে মনোনীত করেন।

আসকারদিঘির পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত কংগ্রেস অফিসে সূর্যসেন এবং অম্বিকা চক্রবর্তী সশস্ত্র বিপ্লবের পরিকল্পনা করেন। শুরু করলেন, আক্রমণের ছক তৈরী, তথ্য সংগ্রহ ও মহড়া। বিপ্লবীদেরকে ৫টি প্রধান আক্রমণকারী দল এবং ৬টি সহায়ক দলে বিভক্ত করা হয়েছিল।

১৯৩০ সালের ১৮ই এপ্রিল, বাংলার মুক্তি পিয়াসী কিশোর ও যুবক বিপ্লবী প্রস্তুত। রামকৃষ্ণ, তারকেশ্বর, অর্ধেন্দু দগ্ধ হওয়ায় তাদেরকে আগেই নিরাপদ স্থানে রাখা হয়েছিলো। সন্ধ্যায় শুরু হলো বিদ্রোহ।

রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্নকরণ: ১৮ই এপ্রিল, ১৯৩০, সন্ধ্যায় আট জন বিপ্লবী দুটি দল অন্ধকারে ধুম রেলস্টেশনে মালবাহী ট্রেন লাইনচ্যুত করেন। বিপ্লবীরাই খুলে রেখেছিল লাইনের ফিসপ্লেট। ধ্বংস হয়ে গেল যোগাযোগ ব্যবস্থা। নাঙ্গলকোট রেলস্টেশনের কাছেও রেললাইনে উড়িয়ে দেওয়া হল। চট্টগ্রামের সাথে বাইরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হলো।

টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ বিচ্ছিন্নকরণ: অম্বিকা চক্রবর্তীর নেতৃত্বে সাত জন বিপ্লবী অংশ নিয়েছিল। নতুন শেভ্রোলে গাড়ি চালিয়ে নিয়েছিলেন কিশোর বিপ্লবী আনন্দ গুপ্ত। চট্টগ্রাম শহরের টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ অফিসের যন্ত্রাংশে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হল। ফলে চট্টগ্রামের সাথে বাইরের টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে গিয়েছিলো। তাই সহসাই চট্টগ্রামে অবস্থানরত বিট্রিশরা বাইরে বার্তা পাঠাতে যেন না পারে তা নিশ্চিত করা হয়েছিলো।

ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ: রাত প্রায় দশটায় নরেশ রায়ের নেতৃত্বে ছয়জন বিপ্লবী বেবী অস্টিন মোটর গাড়িতে করে ক্লাব আক্রমণের উদ্দেশ্যে ক্লাবে পৌঁছান। গুড ফ্রাইডে এর কারণে ইউরোপীয়ানরা রাত নয়’টা ক্লাব বন্ধ করে বাসায় চলে গিয়েছিলেন। তাই পরিকল্পনা সফল হল না।

অক্সিলারী অস্ত্রাগার দখল: লোকনাথ বল এবং নির্মল সেন এর নেতৃত্বে মোট ছয় জনের আক্রমণকারী দল। তাঁরা অক্সিলারী ফৌজের ঘাঁটির পূর্ব দক্ষিণ গেটের সামনে হাজির হল। গাড়ি থেকে নেমে হৃষ্টপুষ্ট সাহেবী চেহারার সামরিক পোশাকে সজ্জিত লোকনাথ বল এবং তাঁর পিছনে ছিলেন রিভলভার হাতে অন্যরা। পাহারারত সৈন্যদের দুজন রাইফেল নামিয়ে মিলিটারি কায়দায় অভিবাদন জানালো। সাথে সাথে লোকনাথ বল এর গুলিতে দুজনই মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। অন্যরা ভয়ে পালালো। মোটর গাড়ির পেছনে হাতল বেঁধে হেঁচকা টান দিয়ে দরজা খুললেন। অস্ত্রাগার ইনচার্জ মেজর ফ্যারেল ‘বাঙালি কুত্তা’ বলে এগিয়ে এলে গুলিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। অস্ত্রাগারে বিপ্লবীরা অস্ত্রের সন্ধান পেলেও গোলাবারুদ ও কারর্তুজের সন্ধান পেলেন না। বেশকিছু অস্ত্র তাদের গাড়িতে নিয়ে অন্যগুলো ভেঙ্গে চুরে পেট্রোল ঢেলে আগুন জালিয়ে দিলেন। সংগত কারণে অস্ত্র ও গোলাবারুদ আলাদা রুমে রাখতে হয়। তাই আগুন লাগানোর সাথে সাথে প্রচণ্ড তাপে পাশের কক্ষে থাকা গোলা বারুদগুলো প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরিত হয়।

চট্টগ্রাম পুলিশ লাইন অস্ত্রাগার দখল: গণেশ ঘোষ ও অনন্ত সিং এর নেতৃত্বে দলটি পুলিশ লাইন অস্ত্রাগার আক্রমণ পরিচালনা করেছিলেন। ছিনতাই করা গাড়িটি চালাচ্ছিলেন বিপ্লবী অনন্ত সিং। সাথে ছিলেন দেব প্রসাদ গুপ্ত, হরিপদ মহাজন, হিমাংশু সেন আর সরোজ গুহ। ত্রিশ (৩০) জন বিপ্লবী পুলিশ লাইন অস্ত্রাগারের পাশের জংগলে আগে থেকে আত্মগোপন করেছিল। টর্চ লাইটের সংকেতে শ্লোগান দিয়ে যোগ দেওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন তাঁরা। পুলিশ লাইনের দিকে এগিয়ে যেতে বেয়নেট সহ বন্দুক হাতে প্রহরীর দেখা মিললো। গাড়ি গার্ডরুমের সামনে গিয়ে থামলো। সামরিক উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার ভেবে প্রহরীরা সামরিক কায়দায় বন্দুক নামিয়ে নিলো। অনন্ত সিং ও গণেশ ঘোষের পিস্তল গর্জে উঠলো। একজন প্রহরী নিহত হলো। অন্যরা ভয়ে দৌড়ঝাঁপ করে পালিয়ে গেলো। অনন্ত সিং চিৎকার করে বললো, ‘হটো, ভাগো, জান বাঁচাও, গান্ধীজীকা রাজ হো গেয়া’। অন্যদের ভয় দেখানোর জন্য ফায়ার করছিলেন। শ্লোগান শুনে আশেপাশে থাকা দল গুলো নিস্তব্ধতা ভেঙে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ শ্লোগান গগনবিদারী রূপ ধারণ করলো। শ্লোগান আর ফায়ার করার শব্দে পুরো পুলিশ ব্যারাক ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলো। পুলিশ সদস্যরা পাশের জংগলে পালিয়ে গেলো। ম্যাপ ও পরিকল্পনা অনুযায়ী অস্ত্রাগার ও ম্যাগাজিন ঘরের দরজা ভেঙে ফেলা হলো। গণেশ ঘোষের কমান্ড ‘কোম্পানিফলইন’ সবাই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে মাস্কেট্রী ও রিভলভার নিয়ে নিলো। গণেশ ঘোষ সবাইকে রিভলভার, মাস্কেট্রী ও টোটা বন্দুকের ব্যবহার শিখিয়ে দিলো। বাকি অস্ত্রগুলো পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগানো হলো। আগুনে হিমাংশু সেন গুরুতর আহত হলে তাঁকে নিয়ে অনন্ত সিংহ, গণেশ ঘোষ, জীবন ঘোষাল এবং আনন্দ প্রসাদ গুপ্ত প্রস্তাবিত হেড কোয়াটার এর উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে গেলেন। মাস্টারদা’র হুকুমে, ব্রিটিশ ইউনিয়ক জ্যাকগুলো নামিয়ে ভারতীয় জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হলো। বিউগল বাজানো হলো। তিনবার পঞ্চাশটি বন্দুক একসাথে গর্জে উঠলো। বিপ্লবীরা সবাই একসাথে তিনবার রণধ্বনি দিলেন ‘বন্দেমাতরম্‌’, ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’, ‘সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক’। রাতেই অন্য সব আক্রমণকারী দলগুলো এখানে এসে সমবেত হয়েছিলো।

ফিল্ড মার্শাল গণেশ ঘোষ হুকুম দিলেন, ‘চারিদিকে পজিশন নাও, বাইরের দিকে লক্ষ্য রাখো, সবাই গার্ডরুম, ম্যাগাজিন ও অস্ত্রাগার ঘিরে শুয়ে পজিশন নিয়েছিলো। আর এই সব ঘটনাই ঘটলো ৯/১০ মিনিটের মধ্যে। কিছুক্ষণের মধ্যে বিপ্লবীরা পুলিশ লাইন অস্ত্রাগার নিরাপদে নিজেদের কব্জায় নেওয়া গেছে ধরে নিলেন। মাস্টারদা সূর্যসেন লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন।

২২শে এপ্রিল কাটুরিয়া মারফত বিপ্লবীদের অবস্থান পুলিশরা জেনে যায়। ট্রেনে করে আনয়ন করা হয় কয়েক হাজার সৈন্য। মাস্টারদা’র আদেশে লোকনাথ বলের নেতৃত্বে দু’ঘণ্টা প্রচণ্ড সম্মুখ যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীর ৮২ জন সৈন্য নিহত এবং বিপ্লবী বাহিনীর ১২ জন বিপ্লবী শহীদ হন। বিপ্লবী শহীদরা হলেন নরেশ রায়, ত্রিপুরা সেনগুপ্ত, বিধুভূষণ ভট্টাচার্য, হরিগোপাল বল, মতিলাল কানুনগো, প্রভাস চন্দ্র বল, শশাঙ্ক শেখর দত্ত, নির্মল লালা, জিতেন দাসগুপ্ত, মধুসূদন দত্ত, পুলিন চন্দ্র ঘোষ এবং অর্ধেন্দু দস্তিদার। ২৩শে এপ্রিল ভোরবেলা মাস্টারদা সূর্যসেন ছোট ছোট দলে বিভক্ত করে বিপ্লবীদেরকে পার্শ্ববর্তী গ্রামে লুকিয়ে রাখেন এবং পরে স্থান ত্যাগ সক্ষম হয়। এটাই ইতিহাসে জালালাবাদ যুদ্ধ নামে পরিচিত।

বিট্রিশরা মাস্টারদা সূর্যসেনকে ধরিয়ে দিতে ১০,০০০ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। মাস্টারদা সূর্যসেন ১৯৩৩ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি রাতে পটিয়া উপজেলার গৈরলা গ্রামে এক বৈঠকে ছিলেন। পুরস্কারের লোভে আশ্রয়দাতার ভাই নেত্র সেন পুলিশকে খবরটি জানায়। বিশাল পুলিশ বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন মাস্টারদা সূর্যসেন ও ব্রজেন সেন। মাস্টারদা সূর্যসেন গ্রেফতার হবার পর তারকেশ্বর দস্তিদার দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। আনোয়ারা থানার গহিরা গ্রামে পুলিশ আর মিলিটারীর সাথে ১৯৩০ সালের ১৮ই মে সংঘর্ষের পর তারকেশ্বর দস্তিদার এবং কল্পনা দত্ত গ্রেপ্তার হন। বিচারে মাস্টারদা সূর্যসেন ও তারকেশ্বর দস্তিদার’কে ফাঁসি এবং কল্পনা দত্তকে যাবজ্জীবন দণ্ডাদেশ প্রদান করা হয়।

মাস্টারদা সূর্যসেন ও অসুস্থ তারকেশ্বর দস্তিদার’কে ফাঁসির আগে ব্রিটিশ সৈন্য ও জেল পুলিশ নির্মম ভাবে পিটিয়ে তাদের দাঁত, হাড় ভেঙে, মুখ থেতলে অর্ধমৃতদেহ করে ফেলেন। তারপর ১৯৩৪ সালের ১২ই জানুয়ারি মধ্যরাতে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ফাঁসির পর মৃতদেহ দুটি ট্রাকে করে আগে থেকে নোঙর করে রাখা ব্রিটিশ জাহাজে করে শরীরের সাথে লোহা বেঁধে ভারত মহাসাগরের কাছাকাছি কোনো স্থানে পানিতে ফেলে দিয়েছিল। চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের মামলায় মোট পাঁচজন এর ফাঁসি হয়েছিলো। তাঁরা হলেন মাস্টারদা সূর্যসেন, তারকেশ্বর দস্তিদার, কৃষ্ণ কুমার চেীধুরী, রামকৃষ্ণ বিশ্বাস, রোহিনী রঞ্জন বড়ুয়া।

লেখক: অর্থসম্পাদক, বিপ্লবী তারকেশ্বর দস্তিদার স্মৃতি পরিষদ, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধগ্রামীণ সড়ক উন্নয়ন ও গ্রামীণ বাস্তবতা
পরবর্তী নিবন্ধলাইলাতুল কদর সম্মানিত ও মহিমান্বিত রজনী