কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার অন্তত ১০টি ইউনিয়নে চলছে তামাক শোধনের কাজ। লোকালয় থেকে দূরে কোনো খোলা জায়গায় তামাক শোধনের জন্য চুল্লি স্থাপনের কথা বলা হলেও তা একেবারেই মানা হয়নি এখানে। মূলত বাড়ির উঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঘেঁষেও তামাক চুল্লি স্থাপন করা হয়েছে। এতে তামাক পোড়ানোর সময় নিকোটিনের উৎকট গন্ধে এলাকার পরিবেশ বিষিয়ে উঠেছে। ভালো করে শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে এখানকার মানুষের।
সরেজমিন তামাক চাষ প্রবণ একাধিক ইউনিয়নে ঘুরে দেখা গেছে, বাড়ির উঠানে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমনকি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পাশেই স্থাপিত চুল্লিতে বর্তমানে চলছে তামাক শোধনের প্রক্রিয়া। এতে এসব ইউনিয়নের মানুষ নিকোটিনের গন্ধে দুর্বিষহ জীবন–যাপন করছেন। এমনকি তামাক শোধনের প্রক্রিয়ায় নারী–পুরুষের পাশাপাশি শিশুরাও শ্রম দিচ্ছে। এই অবস্থায় এসব ইউনিয়নের মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে গেছে অনেকাংশে। শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, চর্ম রোগসহ নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে এখানকার মানুষের। এদিকে বেসরকারি হিসেব মতে, উপজেলার কাকারা, সুরাজপুর– মানিকপুর, বমুবিলছড়ি, চিরিঙ্গা, ফাঁসিয়াখালী, লক্ষ্যারচর, কৈয়ারবিল, বরইতলী, হারবাং, পৌরসভার একাংশসহ ১০টি ইউনিয়ন এবং মাতামুহুরী নদীর দুই তীরের খাস জমিসহ অন্তত ৮ হাজার একর জমিতে এবার তামাকের চাষ হয়েছে। বর্তমানে মাঠ থেকে ইতোমধ্যে ৭০ শতাংশ পরিপক্ক তামাক পাতা তোলা হয়েছে। এসব তামাক পাতা শোধনের জন্য তোড়জোড় চলছে প্রতিটি বাড়িতে।
কাকারা ইউনিয়নের প্রপার কাকারার বাসিন্দা ফাহিন নূর নোবেল, নকীবুল মওলাসহ বেশ কয়েকজন দৈনিক আজাদীকে বলেন, প্রশাসন থেকে বার বার বলা হয়, লোকালয়ের বাইরে গিয়ে তামাক শোধন করতে হবে, সেভাবেই চুল্লি স্থাপন নিশ্চিত করবে তামাক কোম্পানিগুলো। কিন্তু সেই নিয়ম বা বিধি কাগজে–কলমেই সীমাবদ্ধ। এমনকি তামাক চাষপ্রবণ এলাকায় এসব নজরদারি করতেও দেখা যায় না পরিবেশ রক্ষায় নিয়োজিত সরকারি কোনো সংস্থা বা দপ্তরকে। এতে করে তামাক কোম্পানি এবং চাষিরা যেখানে খুশি চাষ ও শোধন প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছেন।
এলাকার পরিবেশ সচেতন এসব ব্যক্তি আরো বলেন, যখন তামাক শোধনের জন্য চুল্লিগুলোতে আগুন দেওয়া হয়, তখন আর কেউ বাড়িতে থাকতে পারি না। দিনের বেলায় অন্যত্র আশ্রয় নিলেও রাতের বেলায় ঘুম হারাম হয়ে যায়। প্রচণ্ড ধোঁয়া আর তামাকের নিকোটিনের গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসে। ইতোমধ্যে গ্রামের অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। রমজানের মধ্যে দুর্বিষহ এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাছে লিখিতভাবে অভিযোগ দেওয়া হলেও কোনো কাজই হয়নি। এমনকি প্রশাসনের কেউই এই দুর্বিষহ অবস্থা দেখতেও আসেননি। এই অবস্থায় তামাক চাষ করেন না, গ্রামের এমন অনেকেই অন্যত্র বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছেন।
কাকারার কামার পাড়ার (বেপারী পাড়া) বাসিন্দা নাজেম উদ্দিন বলেন, তার বাড়ির পাশের এক নারী সন্তান সম্ভবা। কিন্তু তামাক পোড়ানোর গন্ধের উপদ্রবে ও গর্ভের সন্তানের কথা চিন্তা করে ওই নারীকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বাপের বাড়িতে। তামাক পোড়ানোর গন্ধে এলাকার বাতাস বিষিয়ে উঠায় স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নেওয়া, জীবন–যাপন করা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে।
তামাক চাষ প্রবণ ইউনিয়নগুলোর পরিবেশসচেতন একাধিক ব্যক্তি ও জনপ্রতিনিধিরা দৈনিক আজাদীকে বলেন, প্রতিবছর তামাক কোম্পানিগুলো নানা প্রলোভনে সাধারণ মানুষকে তামাক চাষে প্রলুব্ধ করে আসছে। এই কারণে দীর্ঘ দুই যুগের বেশি সময় ধরে নীল চাষের মতোই এখানে তামাকের আগ্রাসন চলছে। আর কোনো ধরনের নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়াই মানুষ কাজ করছে তামাক চাষ থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াকরণ পর্যন্ত। কোনো কাগজপত্র ছাড়াই আবাসিক এলাকায় চলছে তামাক প্রক্রিয়াজাতকরণ। তামাক প্রক্রিয়াকরণের ফলে অসুস্থ হচ্ছে মানুষজন। দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে সাধারণ মানুষ।
কাকারা ইউনিয়নের বটতলীস্থ হিন্দুপাড়ার ভোলা নাথ দে’র বাড়িতে গেলে দেখা যায়, একেবারে বাড়ির উঠানেই স্থাপন করা হয়েছে পাকা তামাক শোধন চুল্লি। চুল্লিতে বড় সাইজের গাছের গুঁড়ি ঢুকিয়ে আগুন দেওয়া হয়েছে। আর সেখানেই বসে আছেন এক নারী। এর পাশেই তামাক পাতার আঁটি বাঁধানোর কাজও চলছে। বড়দের সঙ্গে এক শিশুও কাজে সহায়তা দিচ্ছে। এ সময় ওই শিশুকে জিজ্ঞেস করা হলে সে জানায়, কাকারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ছে সে।
তামাক চাষে লাভ কেমন জানতে চাইলে বাড়ির কর্তা ভোলা নাথ দে বলেন, এবার তামাক পাতার পেছনে পাঁচ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছি। পরিপক্ক হওয়ার পর ক্ষেত থেকে তামাক পাতা তুলে শোধনের কাজ চালাচ্ছি। তবে এখনো বিক্রি করতে পারিনি। তিনি বলেন, গ্রেডিং ঠিক থাকলে হয়তো কিছুটা লাভ থাকবে। যদি গ্রেডিং প্রতারণার শিকার হই তাহলে এবার লাভের মুখ দেখবো বলে মনে হচ্ছে না।
তামাক চাষিরা জানান, সারাবছরের শ্রম তখনই সার্থক হয়, যখন তামাক কোম্পানিগুলো ঠিকমতো পাতার গ্রেডিং নির্ধারণ করেন। যদি গ্রেডিং প্রতারণা করা হয় তাহলে মাথায় হাত উঠবে চাষিদের। এক্ষেত্রে তামাক কোম্পানিগুলোর দয়ার ওপর নির্ভর করা ছাড়া কোনো উপায়ান্তর নেই। অভিজ্ঞ চাষিরা জানান, এক হেক্টর জমিতে উৎপাদিত তামাক পাতা শোধনের জন্য একটি চুল্লির প্রয়োজন হয়। একেকটা চুল্লিতে গড়ে ৫০০ মণ জ্বালানি কাঠের প্রয়োজন পড়ে। এসব জ্বালানি সংগ্রহ করা হয় সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও সামাজিক বনায়ন থেকে।
পরিবেশ অধিদপ্তর কঙবাজার কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, পুরো জেলাজুড়েই তামাকের আগ্রাসন চলছে। সেই তামাক শোধনে পরিবেশের ক্ষতি যাতে না হয় এবং লোকালয় এড়িয়ে যাতে তামাক চুল্লি স্থাপন করে সেজন্য সংশ্লিষ্টদের সাথে আলোচনা করা হবে আগামীতে। তিনি বলেন, তামাক চুল্লির বিষাক্ত ধোঁয়ায় এই অঞ্চলে জনস্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। বায়ুদূষণও বেড়েছে। চুল্লি মালিকদের তালিকা তৈরির কাজ করা হচ্ছে।
চকরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এস এম নাসিম হোসেন বলেন, তামাক চাষকে নিরুৎসাহিত করতে চাষি পর্যায়ে কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয় প্রতিবছর। কিন্তু কোম্পানিগুলো চাষিদের অধিক লাভের প্রলোভনে ফেলায় তামাক চাষ বন্ধ করা যাচ্ছে না।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. শোভন দত্ত বলেন, তামাক চাষের কারণে অধ্যুষিত এলাকায় মানুষের শ্বাসকষ্ট, হাঁপানিসহ শিশুদের শ্বাস–প্রশ্বাসের নানা রোগ দেখা দিতে পারে। এই ধরনের রোগীও হাসপাতালে ভিড় করছেন প্রতিনিয়ত।
এ ব্যাপারে চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেপি দেওয়ান দৈনিক আজাদীকে বলেন, তামাক চাষের ক্ষতিকর দিক নিয়ে আগামীতে চাষিদের সচেতন করা হবে। পাশাপাশি লোকালয় এড়িয়ে তামাক চুল্লি স্থাপনের ওপর জোর দেওয়া হবে। তবে সরকারিভাবে যদি তামাক চাষ নিষিদ্ধ করা হয় তাহলেই স্থায়ীভাবে এই সমস্যা দূরীভূত হবে।