রোজার মাসের দ্বিতীয় দশক মাগফেরাতের দিনগুলো আমরা পার করে এসেছি। এখন চলছে নাজাতের দশক। এই দশকে এসে সিয়াম সাধনাসহ নানাবিধ ইবাদত বন্দেগির মাধ্যমে আমাদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের সুযোগ লুফে নিতে হবে। রোজার মাস আত্মশুদ্ধির বড় সুযোগ। লাগামহীন জীবনাচারে অভ্যস্ত মানুষকে আত্মকেন্দ্রিকতা ও ভোগাচার থেকে বেরিয়ে আনতেই রোজার ঐশী বিধান দেওয়া হয়েছে। জীবনযাত্রায় নানা অনিয়ম, সীমালংঘন ও বল্গাহীন চলাফেরায় আপাদমস্তক নিমজ্জিত আমজনতাকে সঠিক পথে শুদ্ধবাদী জীবনধারায় পরিচালনার পথ নির্দেশনা রয়েছে মাহে রমজানের সিয়াম দর্শনে। স্বার্থনিষ্ঠ পংকিল ক্লেদাক্ত মানবিক অবক্ষয়পুষ্ট যে জীবনধারায় মানুষের অভ্যস্ততা– রোজা হচ্ছে এমন ভোগবাদিতার বিরুদ্ধে ফলপ্রসূ প্রতিষেধক। নিজেকে জানা, পরিপূর্ণভাবে চেনা এবং সমাজের পীড়িতদের দুঃসহ জীবনধারাকে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করা যায় রোজার মাধ্যমে।
পবিত্র সিয়াম পালনের মাধ্যমে আল্লাহর অনুগ্রহ ও ক্ষমা লাভের সুযোগ নেন একনিষ্ঠ রোজাদাররা। মাহে রমজানে রোজা রাখা মুসলমান মাত্রই ফরজ। বুদ্ধিদীপ্ত, প্রাপ্ত বয়স্ক যে কোনো মানুষের ওপর রোজার আদেশ বর্তায়। তাই শরিয়ত নির্ধারিত অক্ষমতার কারণ ছাড়া ঠুনকো অজুহাতে রোজা না রাখার কোনোই সুযোগ নেই। মুমূর্ষু রোগী ও ভ্রমণে থাকা লোকের পক্ষে রোজার বিধান কিছুটা শিথিল করা হয়েছে। মুসাফির অবস্থায় রোজা রাখা কষ্টকর হলে না রাখার অনুমতি রয়েছে। তবে সফর বা ভ্রমণ শেষ করেই পেছনের অনাদায়কৃত রোজা অবশ্যই কাযা (পুনরায় পূরণ) আদায় করে দিতে হবে। রোজার বিধান মানুষের কল্যাণ এবং আত্মিক ও শারীরিক সুস্থতার জন্যই ঐশী প্রদত্ত করুণা। মনের পবিত্রতা ও শারীরিক সুস্থতা অটুট রাখতেই রোজা কার্যকরী ব্যবস্থা। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে রোজার বহুবিধ উপকারিতা বিশেষত একে স্বাস্থ্যবান্ধব হিসেবেই পরীক্ষা–নিরীক্ষার পর সর্বসম্মত রায় দিয়েছেন চিকিৎসকরা। তাই অসুস্থতার অজুহাতে রোজা না রাখা এবং রোগ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করে লাগাতার রোজা বর্জন অবশ্যই আপত্তিকর। ঐশী বিধানের সরাসরি লঙ্ঘন। ইরশাদ হয়েছে ‘সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এ মাস পাবে তারা যেন এ মাসে সিয়াম পালন করে।’ [কোরআন মজিদ ২ : ১৮৫] এ আয়াতে রোজার সর্বজনীন বিধান ঘোষিত হয়েছে। কোনো কোনো প্রাচীন ধর্মমতে, রোজা এক বিশেষ শ্রেণীর জন্য পালনীয় ছিল, কিন্তু ইসলাম রোজাকে সকল শ্রেণীবিভক্তি ও সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত করে একে সর্বজনীন রূপদান করেছে। তাই ইসলামী বিধানে প্রত্যেক সক্ষম মুসলমানের জন্য রোজা রাখা ফরজ। প্রাচীন ধর্মসমূহে শ্রেণীবিভক্তি ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বিশেষ কোনো কারণবশত কাউকে রোজা থেকে অব্যাহতি দেয়ার কোনো নিয়ম ছিল না। কিন্তু ইসলাম এ ক্ষেত্রে উদারনীতি গ্রহণ করেছে। অক্ষম ব্যক্তিদের রোজার বিষয়টি বিবেচনায় এনে ওজর দূর না হওয়া পর্যন্ত তাদেরকে রোজা না রাখার অনুমতি প্রদান করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে ‘তোমাদের কেউ পীড়িত থাকলে কিংবা সফরে থাকলে অন্য সময় এ সংখ্যা পূরণ করতে হবে’। [২ : ১৮৫] রোজার ক্ষেত্রে কোনো কোনো ধর্মাবলম্বীর মধ্যে এতো বাড়াবাড়ি ছিল যে, তারা ৪০ দিন পর্যন্ত খাদ্য গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতো। আবার কেউ কেউ কেবল গোশত জাতীয় খাদ্য বর্জনকেই রোজার জন্য যথেষ্ট মনে করতো। কিন্তু ইসলাম মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি এবং ধর্মাচার পালনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনাতিরিক্ত উদারতা উভয়কেই প্রত্যাখ্যান করেছে। বস্তুত ইসলামী রোজা হলো ভারসাম্যপূর্ণ ও সাধ্যের আওতাভুক্ত একটি ঐশী বিধান। ইয়াহুদিরা শুধু ইফতারের সময় খাদ্য গ্রহণ করতো। এরপর খাদ্য–পানীয় কিছুই গ্রহণ করা তাদের ধর্মে বৈধ ছিল না। ফলে সারা রাত তাদের পানাহারসহ যাবতীয় বৈধকাজ থেকে বিরত থাকতে হতো। কিন্তু কোরআন মজিদে মানুষের পক্ষে কষ্টকর মনগড়া যাবতীয় নিয়ম–কানুন ও বিধিনিষেধ শিথিল করে সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছে ‘আর তোমরা পানাহার কর যতোক্ষণ রাতের কৃষ্ণরেখা হতে ঊষার শুভ্ররেখা সুস্পষ্টরূপে তোমাদের কাছে প্রতিভাত না হয়’ [২ : ১৮৭]। মাহে রমজানে পুণ্য লাভের মুহূর্ত পেয়েও যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে রোজা রাখলো না তার সম্পর্কে আল্লাহ ও রাসুলের পক্ষ থেকে সাবধান বাণী উচ্চারণ করা হয়েছে। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (দ.) বলেছেন, কেউ যদি শরিয়ত অনুমোদিত কোনো ওজর বা অসুস্থতা না থাকা সত্ত্বেও রমজানের কোনো একটি রোজা না রাখে তবে জীবনভর রোজা রাখলেও এর বদলা বা ক্ষতিপূরণ হবে না। (মিশকাত ১ম খণ্ড)। মাহে রমজানে পুণ্যকর্মের আমলের ফজিলত যেমন বেশি তেমনি এ মাসে আল্লাহর পালনীয় নির্দেশ লঙ্ঘন করে পাপকর্মে জড়ালে এর শাস্তি বেশ ভয়াবহ। আত্মিক উন্নতি, শারীরিক সুস্থতা ও সংযমের শিক্ষাকে আত্মস্থ করার জন্য রোজার বিধান আরোপিত হয়েছে। যথেচ্ছাচার ও ভোগমত্ততা থেকে মানুষকে দূরে রাখার বাস্তব অনুশীলন রোজার মাধ্যমে হয়ে থাকে।