বৈশাখ মাসের প্রথম দিন বাংলার নববর্ষ উৎসব। যা পহেলা বৈশাখ নামে সমাদৃত। এই দিনটি শুধু আনন্দ উচ্ছ্বাসই নয়, মানুষের কল্যাণ কামনারও দিন। মঙ্গল শোভাযাত্রা যার বহিঃপ্রকাশ। যার কারণে এই দিনে বলে থাকি ‘শুভ নববর্ষ’। একে অন্যকে এই শুভ নববর্ষ বলার মাঝেই তার শুভ কামনা করা।
ইতিহাসে জানা যায়, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়ী দলের জনপ্রিয় নেতা শেরে বাংলা এ. কে ফজলুল হক সরকার দলের হয়ে বাংলা নববর্ষে ছুটি ঘোষণা করেন। দেশবাসীর শুভকামনা করে শুভেচ্ছা জানান। সেই দিনটি ছিল বাংলার জন্য ও বাঙালির এক তাৎপর্যপূর্ণ বিজয়ের দিন। পরবর্তীতে যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে গেলে সামরিক শাসন চালু হয়। এবং পাকিস্তানি আমল চলাকালে নববর্ষের বিলুপ্ত হলেও তৎকালীন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানট (১৯৬১) গঠিত হয় এবং ১৯৬৭ সালে রমনার পাকুড়মূলে ছায়ানট সংগঠনটি নববর্ষের উৎসব পুনরায় শুরু করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ছাত্রছাত্রী বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা, মুখোশ, কার্টুনসহ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীকধর্মী চিত্র বহন করে। যেখানে সমাজের সমালোচনার পরিচয় দেয় কখনো।
বাংলা নববর্ষের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে সঠিক নিখুঁত নাও হতে পারে। অধিকাংশ ঐতিহাসিক পণ্ডিত মনে করেন মুঘল সম্রাট আকবর চন্দ্র হিজরি সনের সাথে ভারতবর্ষের সৌর সনের সমন্বয় করে ১৫৫৬ সাল বা ৯৯২ হিজরিতে বাংলা সন চালু করেন। বাংলায় আকবরের কোনো প্রতিনিধি বা মুসলমান সুলতান বা নবাব বাংলা সন প্রবর্তন করেন বলেই একে সন বা সাল বলা হয়ে থাকে। যদিও সন কথাটি আরবি আর সাল ফরাসি শব্দ তবুও সন বা সালই এখনো ব্যাপকভাবে চালু। হালখাতা পহেলা বৈশাখের মহা উৎসবের অংশ। যা ব্যবসায়ীরা পরিচালনা করতেন। এখন বাকিতে তেমন কিছুই হয় না। নগদের দিন আসাতে হালখাতার প্রচলনও বিলুপ্ত প্রায়।
বৈশাখী মেলা বৈশাখ মাসের দারুণ আকর্ষণীয় প্রথা। দেশের নানা জায়গায় এ মেলার আয়োজন চলে। স্থানবিশেষে মেলা, পুতুল নাচ, জারি গান, গম্ভীরা গান, কীর্তন, নাগরদোলাসহ নানা আনন্দ আয়োজন চলে। চট্টগ্রামের লালদিঘির ময়দানে বিশাল আয়োজনে চলে বলীখেলা। যা জব্বইজ্জের (জব্বারের) বলীখেলা নামে খ্যাত। দুইদিন ব্যাপী চলে এই মেলা। শিরীষতলায়ও বিভিন্ন আয়োজনেও চলে এ মেলা। পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িরা বৈসুব, সাংগ্রাই ও বিজু এ তিনটিকে একত্রে বৈসাবী উৎসব নামকরণ করে। তাদের জন্য এ উৎসব বিশাল উৎসব। পাকিস্তানি শাসন আমলে বাঙালির প্রাণের এ উৎসব উদযাপনে বাধা দেয়া হয় এবং এর প্রতিবাদে বাঙালিরা রুখে প্রতিবাদ জানায়। আজও কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু ধর্মীয় অনুভূতির মানুষ এ পহেলা বৈশাখকে হারাম, ধর্মীয় বিরোধী উৎসব বলে মনে করে। ধর্মীয় স্বার্থান্বেষী দল রমনার বটমূলে বোমা পুঁতে রেখে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এরপরেও বাঙালিকে এ প্রাণপ্রিয় উৎসব থেকে ফেরাতে পারেনি। তার পরের বৎসর আরো বড়ো আয়োজনে বীর দর্পে মঙ্গল শোভাযাত্রা চালু অব্যাহত রাখে। কিন্তু তারপরও খারাপের প্রভাব কিছুটা থাকেই। সন্ধ্যা নামার আগেই শেষ করতে হয় বিভিন্ন স্থানের এ আয়োজন। বাঙালির মেলামেশা, শাড়ি পরা এবং টিপ নিয়ে চলে বিভিন্ন উসকানিমূলক সমালোচনা।
আমরা বাঙালি বাংলাকেই বরণ করব সানন্দে। তাইতো হওয়া উচিত। তবে নিউ ইয়ার পালনেও আপত্তি থাকা উচিত নয়। কেননা, এটি বিশ্ব / আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। আমরা আমাদের ঐতিহ্য যেমন ধরে রাখবো, তেমনি বিশ্বের সাথেও তাল মিলিয়ে চলতে বাধ্য হব। নববর্ষে আমরা প্রাণের সাথে প্রাণ মিলাবো, হাসবো, গাইবো, নাচবো, রঙিন হব, রঙিন করব। চারদিক মুখরিত রাখবো। আমরা ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক হবো। নিজ ঐতিহ্য অক্ষুণ্ন রেখে সর্বজনীন হবো। অসামপ্রদায়িক বাঙালি হবো। সামপ্রদায়িকতা মুক্ত হবো। সকলের মঙ্গল কামনায় ব্রত হবো।
আসুন শ্লোগান তুলি…. ‘বৈশাখে বৈশাখী হাওয়া / আপন মহিমায় উদ্ভাসিত হোক / উল্লোসিত হোক।’