শুধু রমজানে নয়, নামাজ ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের জন্য বাধ্যতামূলক

রেজাউল করিম স্বপন | মঙ্গলবার , ১১ এপ্রিল, ২০২৩ at ৬:০৪ পূর্বাহ্ণ

ইসলাম ধর্মে কয়েকটি রাতের এবাদতকে ফজিলতপূর্ণ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এই রাতেগুলোর এবাদত হলো নফল এবাদত। অনেকে ঐসব রাতে সারারাত এবাদত করে কাহিল হয়ে ফজরের নামাজের আগে ঘুমিয়ে পড়েন। ফলে তারা ফজরের নামাজ আদায় করতে পারেন না। এটা মারাত্মক রকমের ভুল। কারণ আপনার শরীর না কুলালে আপনি নফল এবাদত করবেন না কিন্তু ফরজ নামাজ পড়তেই হবে। লক্ষ কোটি নফল এবাদত করলেও একটি ফরজ এবাদতের সমান হবে না। মনে রাখতে হবে, নফল এবাদতের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম হলো তাহাজ্জুদের নামাজ। প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশের এবাদত ঐসব বিশেষ রাতের এবাদতের মতও একই ফজিলত বহন করে।

ইসলাম ধর্মে মূল স্তম্ভ হলো পাঁচটি। ঈমান, নামাজ, রোজা, হজ্জ ও জাকাত। প্রত্যেক আকলমান মুসলিম নর নারীর জন্য শিরিকমুক্ত ঈমান ফরজ। অর্থাৎ আপনি যদি মুসলমান ধর্মের অনুসারী হয়ে থাকেন তবে কোরআন হাদিসের প্রতিটি বিষয় আপনাকে কোনো প্রশ্ন করা ব্যতিরেকে মেনে নিতে হবে। কোনো বিষয় আপনার বুঝে না আসলেও সেটি নির্দ্বিধায় মেনে নিতে হবে। যেমন আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে আমার প্রাণপ্রিয় নবীজি হযরত মুহাম্মদ সা. যখন মেরাজে যান, তখন সেটি কারো বুঝে আসেনি। কারণ অতি অল্প সময়ে পৃথিবী থেকে ক্রমান্বয়ে সপ্তম আসমান পরিভ্রমণ করে বেহস্ত দোজখ ও আল্লাহ তায়ালার সমস্ত নিদর্শন দেখে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসা শুধু অসম্ভব নয় কারো বুঝে আসাও অসম্ভব ছিলো। কিন্তু নবীজির সাহাবীরা সেটি কোনো প্রশ্ন করা ব্যতিরেকে বিশ্বাস করেছিলেন। বর্তমানে বিজ্ঞান বলছে নবীজির সেই মেরাজ সম্ভব, যদি তিনি আলোর গতির সমান গতিতে ঐ মেরাজ করে থাকেন। অর্থাৎ এখন এটি বিজ্ঞান সমর্থন করছে। একইভাবে পুরুষের টাকনুর উপর কাপড় পরতে বলা হয়েছে। বর্তমানে বিজ্ঞান বলছে টাকনুর উপরে কাপড় না পরলে শরীরের ক্ষতিকর হরমোন বের হতে পারে না, এতে করে পুরুষের শরীরে নানা সমস্যা দেখা দেয়। আবার রোজার বিষয়ে বর্তমান বিজ্ঞান বলছে রোজা রাখলে মানুষের ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। যেটিকে বর্তমানে ফাস্টিং বলা হয় এবং এই রোজার উপর গবেষণা করে জাপানের ড. ওসুমি ২০১৬ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। এভাবে ইসলাম ধর্মের প্রতিটি ঘটনা বা কাজই সত্য ও সঠিক, হয়ত বিজ্ঞান প্রমাণ করতে সময় লাগছে এই যা। তাই এসব বিষয়ে কোনো সন্দেহ বা প্রশ্ন করা ব্যতিরেকে আমাদের সবাইকে কোরআনের প্রতিটি শব্দ মেনে নিতে হবে। প্রশ্ন বা সন্দেহ প্রকাশ করলে ঈমান থাকবে না।

সালাত বা নামাজ হলো প্রত্যেক মুসলমান নর নারীর জন্য ফরজ। আপনি যদি অসুস্থ হয়ে শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে থাকেন তবুও আপনাকে নামাজ আদায় করতে হবে। প্রয়োজনে আপনাকে বসে বা শুয়ে ইশারায় হলেও নামাজ আদায় করতে হবে। নামাজের কোনো মাফ নেই। না পড়লে আপনি গুনাহগার হবেন। মনে রাখতে হবে হাশরের ময়দানে সর্বপ্রথম নামাজের হিসাব নেয়া হবে।

সওম বা রোজা শারীরিকভাবে সুস্থ মানুষকে অবশ্যই রাখতে হবে। যদি রোজা রাখার ফলে দীর্ঘ সময় পানাহার বর্জনের জন্য আপনার জীবন অবসানের আশংকা থাকে, তবে আপনার জন্য রোজা মাফ আছে। সেক্ষেত্রে আপনাকে কাফ্‌ফারা দিতে হবে। অর্থাৎ আপনার প্রতিটি রোজার পরিবর্তে একজন ইমানদার লোককে ২ বেলা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে হবে।

জাকাত হলো আপনার নেসাব পরিমাণ সম্পদ অর্থাৎ আপনার কাছে যদি সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা বা সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণের সমপরিমাণ অর্থ সম্পদ থেকে থাকে বা দুইটা আলাদাভাবে ঐ পরিমাণে না থেকে থাকলেও দুইটার যোগ ফল যদি সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার মূল্যের সম পরিমাণ হয় (এর কম হলে জাকাত দিতে হবে না) এবং তা যদি পুরো একবছর আপনার কাছে গচ্ছিত থাকে, তবেই আপনাকে সেই সম্পদের জাকাত হিসাবে ২.% গরীব মানুষকে দিতে হবে। এক্ষেত্রে আপনার স্থায়ী সম্পদ জায়গা, জমি, বাড়ি, গাড়ি, দোকানের মূল্য বিবেচনায় নিতে হবে না। তবে যদি আপনি ঐ জায়গা জমি বাড়ি গাড়ি বা দোকান ব্যবসার উদ্দেশ্যে কিনে রাখেন এবং পরবর্তীতে বিক্রির উদ্দেশ্য থাকে তবে আপনাকে ঐগুলোর মূল্য হিসাব করে জাকাত দিতে হবে। দোকান বা ব্যবসার চলতি মূলধনের উপরও আপনাকে জাকাত দিতে হবে।

হজ্জ হলো আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান লোকের উপর প্রযোজ্য। আপনার যদি নেছাব পরিমাণ সম্পদ থেকে থাকে ও যদি আপনি হজ্জ করার সমস্ত খরচ বহন করে হজ্জের সময় আপনার রেখে যাওয়া পরিবারের সমস্ত খরচ বহন করার সামর্থ্য থাকে তবে আপনার উপর হজ্জ ফরজ। এক্ষেত্রে যদি আপনার ঋণ থাকে তবে তা বাদ দিয়ে যদি আপনার হজ্জ করার সামর্থ্য না থাকে তবে হজ্জ আপনার উপর ফরজ নয়। সবচেয়ে আতংকের বিষয় হলো হজ্জ ফরজ হওয়ার পর যদি আপনি হজ্জ না করে মারা যান, তবে আপনি মুসলমান না ইহুদি বা নসারা হয়ে মারা গেছেন, তা নিয়ে আমাদের নবীজি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

এই পৃথিবীতে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ও নিখুঁত কিতাব হলো পবিত্র আল কোরআন। এটি ১৪০০ বছর যাবৎ অবিকৃত অবস্থায় আছে ও থাকবে। কারণ মহান রাব্বুল আলামিন এটি নিজে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সেজন্য লাখ লাখ হাফেজের কলবে এটি সংরক্ষিত রয়েছে ও কেয়ামত পর্যন্ত সংরক্ষিত থাকবে।

ইসলাম হচ্ছে এমন একটি ধর্ম যাতে নিজের বিচারক খোদ নিজে। আপনি হজ্জের উপযুক্ত কিনা সেটি আপনিই সবচেয়ে ভালো জানবেন। জাকাত দেওয়ার উপযুক্ত কিনা সেটিও আপনিই ভালো জানেন। আপনি রোজা রাখছেন কিনা সেটা আপনার থেকে কেউ ভালো জানবে না। আপনি একিনের সাথে সহি শুদ্ধভাবে নামাজ পড়ছেন কিনা সেটিও আপনার থেকে বেশি কেউ জানবে না। এভাবে ইসলাম ধর্মের প্রতিটি আমলের বিচারক আপনি নিজেই।

আমাদের নবীজি বলেছেন শেষ জামানায় মুসলমানদের মধ্যে ৭৩ ফেরকার লোক হবে, যার মধ্যে শুধু এক ফেরকার লোক জান্নাতে যাবে বাকী ৭২ ফেরকার লোক যাবে জাহান্নামে। সেই এক ফেরকার লোক হলো তারা যারা কোরআন ও হাদিস শক্তভাবে আঁকড়িয়ে ধরবে। এখন আমাদের আশেপাশে প্রচুর মুসলমান আছে যারা বুঝে বা না বুঝে হোক ফেরকা তৈরী করছে। তাদের সতর্ক হওয়া অতীব জরুরি। প্রায়ই দেখা যায় এক মুসলমান আরেক মুসলমানকে মারাত্মকভাবে আক্রমণ করছে। তাদেরকে বিনয়ের সাথে বলতে চাই। আপনি যে আরেকজনকে আক্রমণ করছেন, আপনি কি নিশ্চিত যে আপনি জান্নাতে যাবেন?

হয়ত আপনি যাকে আক্রমণ করছেন তার এমন কোনো আমল আছে যেটি আল্লাহ তায়ালার পছন্দের এবং সেজন্য তিনি জান্নাতে যাবেন। তাই অপরকে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলুন, মনে রাখবেন সুন্দরভাবে কথা বলাও সদকায়ে জারিয়ার পর্যায়ে পড়ে। নিজের আমল নিজে করুন যেন আল্লাহ তায়ালা আপনাকে ক্ষমা করে দিয়ে জান্নাত দান করেন। আর একটি কথা শুধু আমল দিয়ে কেউ কি জান্নাতে যাবে? সেটা আল্লাহ চাইলে হয়ত হতে পারে। তবে আমাদের এমনভাবে চলতে হবে যেন আমাদের মা বাবা ভাই বোন পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজনসহ সবাই আমাদের উপর সন্তুষ্ট হয়। মনে রাখতে হবে আমার প্রতি সবার হক আছে, তা যদি আমি পরিপূর্ণভাবে পালন না করি বা আদায় না করি তবে হাশরের ময়দানে আমার পার পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে। তাই অন্যের দোষ না খুঁজে নিজের চিন্তা নিজে করে আল্লাহ তায়ালার কাছে আমরা সবাই মাফ চাই ও একিনের সাথে এবাদত করি। মহান রাব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকে বুঝার ও আমল করার তৌফিক দান করুন।

লেখক : প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধমুক্তিযুদ্ধ ’৭১ : প্রসঙ্গ শহীদ আবদুল হামিদ
পরবর্তী নিবন্ধভূগোলের গোল