সাইকেলের সওয়ারি-ভোমরা হতে তামাবিল

বাবর আলী | সোমবার , ১০ এপ্রিল, ২০২৩ at ৬:০২ পূর্বাহ্ণ

পর্ব

শিল্পীর নিপুণ তুলির টান দেওয়া পথে চলে প্রবেশ করলাম মৌলভীবাজার জেলায়। স্বাগত জানাল চা কন্যা ভাষ্কর্যটি। লছনার কাছে এসে দারুণ একটা জিনিস খেয়াল করলাম। রাস্তার বাম পাশে এক সারি একাশিয়া গাছে অসংখ্য চড়ুই। প্রথম দেখায় মনে হয় গাছে পুষ্পমঞ্জরির বদলে থোকা থোকা চড়ুই ঝুলছে। এদের কিচিরমিচিরে কান পাতা দায়। সাইকেল থামিয়ে বেশ কিছুক্ষণ মুগ্ধ নয়নে তাই শুনলাম আর দেখলাম। সাইকেল রাইডের মজাটা আরেকবার ভালোভাবে উপলব্ধি করলাম। দ্রুতগতির কোন যানবাহনে চড়ে এই রাস্তা পার হলে এই ব্যাপারটা খেয়ালই করা হতো না। খানিক এগিয়ে ভূনবীরেও একই জিনিস দেখলাম। চড়ুইয়ে ভর্তি গাছ। তবে এবারে গাছ ভিন্ন। পাশাপাশি দুইটা বট আর কৃষ্ণচূড়া গাছে ঝুলছে থোকা থোকা চড়ুই। কৃষ্ণচূড়া গাছের লাল শীর্ষ আর চড়ুইয়ের বাদামি দেহ মিলেমিশে একাকার। এবার টানা চালিয়ে সোজা শ্রীমঙ্গলে। সন্ধ্যার অল্প পরে হালকা চড়াইউতরাই পেরিয়ে চলে এলাম দহলিজএ। প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া ছোটো বোন খাতুন ঘাঁটি গেড়েছে এখানেই।

দহলিজ নামক ব্যাকপ্যাকারস লজের ভোর সবসময়ই সুন্দর। সামনের চিলতে জায়গাটুকু এই ভোরেই শিশিরে একদম ভেজা চপচপে। ওদের গ্যারেজ থেকে সাইকেল বের করে এক টানে গ্র্যান্ড সুলতানের সামনে। ইহলৌকিক স্বাস্থ্য আর পারলৌকিক স্বাস্থ্য নিয়ে আগ্রহীদের পদচারণায় মুখর ভোরের পথ। রাধানগর থেকে ভানুগাছের এই রাস্তায় বেশ কয়েকটা চা বাগান পড়ে। সবুজ হিমবাহের মতো দেখতে এসব চা বাগান। রাস্তাটাও সবসময় মন ভালো করে দেয়। শ্রীমঙ্গল উপজেলা শহর হলেও কলেবরে আর সুযোগসুবিধায় জেলা শহরের চেয়েও বেশ এগিয়ে। আবহমান কাল থেকে চলে আসা চা শিল্পই সম্ভবত মূল কারণ। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে মৌলভীবাজারের রাস্তার প্রথমদিকের জায়গাগুলোর নাম সেতু তথা পুলের নামে। ১নং পুল, ২নং পুল, ৩নং পুলজায়গার নামগুলো এমন। দেশের অনেকাংশে অবশ্য এক জায়গা থেকে অন্য জায়গার দূরত্বের মাইল কিংবা কিলোমিটারের হিসাবেও নামের প্রচলন আছে। ঠাকুরগাঁওদিনাজপুর মহাসড়ক অংশে মাইলের নামে অনেক বাজার আছে। আবার আলীকদমথানচি সড়কের বেশিরভাগ জায়গায় নাম কিলোমিটারের নামে। কালাপুর ছাড়িয়ে কিছুদূর পরে পেলাম মাজদিহি বাজার। পাশেই একই নামে চা বাগানও আছে। নিতেশ্বরের কাছে বিলাসবহুল দুসাই রিসোর্ট পেরিয়ে জগন্নাথপুর। এখানেই পেলাম ‘হোটেল টানাটানি’র সাক্ষাৎ। যদিও ক্রেতা টানাটানি করতে হোটেলের কাউকে দেখা গেল না। সবেমাত্র দুলকি চালে দোকান ঝাঁট দেওয়া চলছে। সিলেট অঞ্চলের লোকজন কিছুটা আরামপ্রিয়। দোকানপাট খুলতে দেশের অন্যান্য স্থানের চেয়ে কিছুটা দেরি হয় এ অঞ্চলে। ওয়াপদা থেকে ডানের রাস্তা ধরলাম। মূল শহর এড়িয়ে এই রাস্তা দিয়েই কুলাউড়ার রাস্তায় উঠা যাবে।

ফগাদের মূল শহরে আর ঢুকলাম না। প্রসঙ্গত, সিলেট বিভাগের অন্যান্য জেলার লোকেদের তুলনায় মৌলভীবাজারের লোকেরা খানিকটা সহজসরল আর বোকাসোকা হওয়ায় অন্যরা এই জেলার লোকেদের ডাকে ‘ফগা’ নামে! ডানের রাস্তাটার কিছু অংশ আমার চেনা। গত বছর মৌলভীবাজার হাফ ম্যারাথনএ এই রাস্তার কিছু অংশে দৌড়েছিলাম। বনবীথি আর বনশ্রী নামক আবাসিক এলাকা দুটো ভারি গোছানো। ছোট ছোট টিলার মাঝে সুন্দর সব বাড়ি। কোর্ট রোড হয়ে কাশীনাথ আলাউদ্দীন স্কুল এন্ড কলেজ এর প্রাঙ্গণে থামলাম। এই স্কুলের সামনেই সিলেটি নাগরি লিপির অক্ষর সংবলিত একটা বোর্ড আছে। সিলেট অঞ্চল তথা বৃহত্তর বরাক উপত্যকার ভাষার যে আলাদা লিপি আছে, তা অনেকের অজানা। একাডেমিক সূত্রে পরিচয় হওয়া এক সিলেটির সাথেই আমার এটা নিয়ে বেশ লেগে গিয়েছিল। খানিক এগিয়েই মনু নদী। সেতুর নিচে বয়ে যাওয়া পানির রং ছানি পড়া বৃদ্ধের চোখের ন্যায় ঘোলা। নিচের দিকে অনেক পলিমাটি বয়ে নিয়ে যাচ্ছে এই জল। সেতুলাগোয়া এলাকার নাম চাঁদনীঘাট। মেঘের গর্জনের ন্যায় শব্দ তুলে দোকানের শাটার উঠতে শুরু করেছে। ইসলামপুরের পরে একাশিয়া বীথি চিরে চলে গেছে পথ। হলদে মঞ্জরি অল্প অল্প করে গুঁড়া আকারে নিচে পড়ছে। এখান থেকেই সাইকেলের আগাগোড়া নানান প্লাস্টিকের পণ্যে মুড়িয়ে সওদা করতে বেরোনো কয়েকজন ভাইয়ের দেখা পেলাম। এদের মূল খদ্দের চা বাগানের বাসিন্দারা। দুইজনের সাথে কথা বলে জানলাম, দুইজনই উত্তরবঙ্গের বাসিন্দা। জীবিকার তাগিদে এ অঞ্চলে এসেছেন। আমি সাইকেল চালাই মনের আনন্দে। আর তাদের দায়টা পেটের। একই রাজপথে চলা মানুষের মাঝেই কী বৈপরীত্য!

কদমহাটা থেকে রাজনগর উপজেলায় প্রবেশ করলাম। মহলাল বাজার হয়ে উপজেলা সদরের দিকে না এগিয়ে ফেঞ্চুগঞ্জ অভিমুখী রাস্তা ধরলাম। কর্ণিগ্রামের পরে এক জায়গায় বটের নিচে মোমবাতি জ্বালিয়ে পুজা হচ্ছে। চা বাগানের বাসিন্দাদের কাছে বটপাকুড়অশ্বত্থের তলা বেশ পবিত্র। ব্যাপারটা আগেও দেখেছি। এর মাঝেই এক ছেলে পথের পাশে সংকেত দিয়ে থামাল। যা বলল তার সারমর্ম হলো, ওই ছেলের অতি পুরনো হিরো রেঞ্জার ম্যাক্স সাইকেলের সাথে আমার সাইকেল বদল করতে চায়! আমি আর কিছু বললাম না। এরাই কিডনি বেচে আইফোন কেনার স্কিমের লোক। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। মুন্সিবাজার এসে ফোন দিলাম শারাফত ভাইকে। কাছের টি এস্টেটের এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার সকালে বাগানের প্রাত্যহিক কাজে ব্যস্ত। এ যাত্রা দেখা হলো না। অবশ্য গত সপ্তাহেই তার বাগানের বাংলোতে দুটো দিন কাটিয়ে এসেছি। রাজনগর থেকে ফেঞ্চুগঞ্জ হয়ে সিলেট অবধি রাস্তাটুকু চেনা। ৬৪ জেলা হাঁটার সময় এই পথ ধরে হেঁটেছি। রাস্তার ডানে বেশকিছু চা বাগান আছে। বাগানের রোমশ সবুজ ঢালে কোমর ডুবিয়ে এক কুঁড়ি দুই পাতা তুলছে নারীরা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ – এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধভয় দেখিয়ে মুরগি হত্যা, চীনে এক ব্যক্তিকে ৬ মাসের জেল