রমজান মাসে মুসলমানের জন্য ফরজ হচ্ছে রোজা রাখা। রোজা ফারসি শব্দ। আরবিতে রোজাকে সাওম বলা হয়। পাক ভারত উপ–মহাদেশে যখন মোগল সাম্রাজ্য শাসন করতো তখন এ দেশের রাষ্ট্রভাষা ছিল ফারসি। তাই অনেক ফারসি শব্দ বাংলা ভাষায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। যেমন ইংরেজ আমলের কারণে আমরা যখন তখন ইংরেজি শব্দ “সরি” “গুড মর্নিং” “বাই–বাই, “হাই” ’স্কুল’ ‘কলেজ’ প্রভৃতি শব্দ ব্যবহার করি। বাংলা ভাষা অত্যন্ত সমৃদ্ধ ভাষা এ ভাষায় ইংরেজি, ফারসি, আরবি, পতুর্গীজ প্রভৃতি ভাষার শব্দ মিশ্রিত হয়েছে যা বাংলা ভাষার সমৃদ্ধি ও সৌন্দর্য বর্ধনে সহায়তা করেছে। যেমন কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কবি ফররুখ আহমদের কবিতায় অজস্র আরবি, ফারসি, শব্দের ব্যবহার কবিতা গুলোকে অনন্য সাধারণ করে তুলেছে।
পরম করুণাময় আল্লাহ তাআলা মানব জাতিকে তাঁর ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। নামাজ, হজ্ব, রোজা, যাকাত প্রভৃতি আল্লাহর নিয়ামতকে উপলব্ধি করে শুকরিয়া আদায় করার সর্বোত্তম পন্থা। যাকাত আদায় করার মাধ্যমে যেমন সমস্ত সম্পদ পবিত্র হয়, তেমনি রমজান মাসে রোজা পালন করলে সমস্ত শরীর শুদ্ধ হয়। হযরত মুহাম্মদ (দ🙂 বলেছেন, “প্রত্যেক বস্তুরই একটি যাকাত রয়েছে, মানুষের দেহের যাকাত হচ্ছে রোজা।” হযরত মুহাম্মদ ( সা🙂 আরও বলেছেন, “রমজান মাসের রোজাকে আল্লাহ তাআলা ফরজ করেছেন এর রাতগুলোকে আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোকে নফল ইবাদত হিসাবে নির্দিষ্ট করেছেন। যে ব্যক্তি রমজানের রাতে ফরজ ইবাদত ছাড়া সুন্নাত বা নফল ইবাদত করবে, তাকে এর বিনিময়ে অন্যান্য সময়ের ফরজ ইবাদতের সমান পুণ্য প্রদান করা হবে। আর যে ব্যক্তি এ মাসে ফরজ আদায় করবে সে অন্যান্য সময়ে ৭০টি ফরজ ইবাদতের সমান সওয়াব লাভ করবে।”
প্রাচীন কাল থেকে রোজা রাখার প্রচলন ছিল। আরবের প্রাক ইসলামী যুগে স্রষ্টার সন্তুষ্টি অথবা শোকের কারণে রোজা রাখার নিয়ম ছিল। ইহুদি ও খ্রীস্টানদের মধ্যে রোজা রাখার প্রচলন ছিল। দুঃখ ও শোকের চিহ্ন হিসাবে ইহুদিরা রোজা রাখতো। হযরত মূসা (আ🙂 বছরে চল্লিশ দিন রোজা রাখতেন। হযরত ঈসা (আ🙂 চল্লিল দিন রোজা রাখতেন এবং তাঁর অনুসারীদেরও রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
হিজরি দ্বিতীয় বছরে অর্থাৎ ৬২৩ খ্রীস্টাব্দে রমজান মাসে রোজা রাখার স্বর্গীয় নির্দেশ নাজিল হয়। পবিত্র কোরান শরীফে আছে, “(সুরা বাকারা ১৮৫ আয়াত)” রমজান মাসে মানুষের হেদায়েত ও সৎপথের নির্দেশ এবং ন্যায় অন্যায়ের পার্থক্যকারীরূপে কোরান নাজিল হয়েছে। অতএব তোমাদের মধ্যে যারা এই মাস পাবে তারা যেন রোজা রাখে।”
‘রমজ’ শব্দ থেকে “রমজান” শব্দের উৎপত্তি। “রমজ” শব্দের অর্থ পুরানো, অর্থাৎ পুরানো সব মন্দ অভ্যাস ত্যাগ করে রমজান মাসে সম্পূর্ণ পবিত্র অন্তরে রোজা ও নফল এবং ফরজ ইবাদত করতে হবে। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। কিন্তু কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ প্রভৃতি বিভিন্ন রিপু মানুষের পুণ্যলাভের পথে বাধা সৃষ্টি করে। মানুষের কুপ্রবৃত্তি দমন করার জন্য রোজা ফরজ করা হয়েছে। অর্থাৎ কুপ্রবৃত্তি দমন করে ধৈর্যের সাথে আল্লাহর ইবাদত করতে হবে। রমজান মাস ধৈর্য, সহনশীলতা ও তাকওয়া অর্জনের মাস। রমজান মাসে রোজা রাখার অর্থ আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে সৎ চরিত্রের অধিকারী হওয়া। রোজার দীর্ঘ ত্রিশ দিন ধৈর্য ও সহনশীলতার মাধ্যমে সারাজীবনের জন্য কুপ্রবৃত্তি দমন করে খিদে তৃষ্ণার ওপর নিয়ন্ত্রণ শক্তি আরোপ করে হিংসা, লোভ, লালসা, মোহ, পরনিন্দা, মিথ্যাচার থেকে মুক্তি লাভের প্রচেষ্টা করাই হলো রোজা রাখার উদ্দেশ্য। হযরত মুহাম্মদ (স🙂 বলেছেন “ধৈর্য জান্নাতের ভান্ডার সমূহের একটি ভান্ডার।” তাই রোজা রাখার ধৈর্য হলো আত্নশুদ্ধির উপায়।
বর্তমান যুগে বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষের মধ্যে ধৈর্য ও সহনশীলতার অভাব এবং লোভ, মিথ্যাচার ও অসৎ কাজের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইফতারির বিপুল আয়োজন, মার্কেটে দামী মহামূল্যবান পোশাক ও অন্যান্য দুব্যের প্রচুর ক্রয়–বিক্রয় করা অন্যায় এ কারণে ইসলাম ধর্মে বিলাসিতার স্থান নেই। তাছাড়া এদেশের দরিদ্র মানুষের সংখ্যা অনেক। এমনকি “ফেসবুকে” দেখে আমি লজ্জিত হই যেখানে একজন দরিদ্র বালক দু’মুঠো ভাত খেতে পারছে না সেখানে শিক্ষিত বড় লোকরা প্রচুর খাবার দ্রব্যের প্রদর্শন করে ও ইফতার খাচ্ছে তার ছবি দেখিয়ে গর্ব অনুভব করছে। গরিব মানুষের খিদে তেষ্টার উপলব্ধি হচ্ছে। রোজার রাখার সহনশীলতা। ঈদের সময় অর্থনৈতিক বাজারের উন্নতি ঘটে এটা দেশের জন্য সৌভাগ্য, কিন্তু অসৎ উপায়ে উপার্জন এবং ব্যবসা করা হারাম। মুসলিম দেশগুলোতে রমজানের সময় জিনিসপত্রের মূল্য হ্রাস করা হয় যেন ক্রয়–বিক্রয় সহজ হয়। এমনকি প্রায় উন্নত দেশে ২৫ডিসেম্বর উপলক্ষে জিনিসপত্র এবং উপহার সামগ্রীর মূল্য হ্রাস করা হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় এদেশে রমজানের মাসে প্রায় সময় খাবারের সামগ্রী ও পোশাকের মূল্য অত্যন্ত চড়া দামে বিক্রয় করার রেওয়াজ চালু রয়েছে।
চৌদ্দশত বছর আগেই ইসলাম ধর্মে নারীকে পুরুষের সমান মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। পবিত্র কোরান শরীফে বলা হয়েছে যে ব্যক্তি পাপ করবে সে নারী বা পুরুষ হোক দোজখ লাভ করবে এবং নারী বা পুরুষ যে পুন্য করবেন সে বেহেশতো লাভ করবেন। এছাড়া “মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেস্ত”। এ কথার মাধ্যমে একজন মা তথা নারীকে সর্বাধিক মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। তাই রমজান মাসে নারীর কিছু কর্তব্য রয়েছে। এ পৃথিবীতে সব চেয়ে যে সম্পর্কটি অন্যন্য সুন্দর তা হলো মা এবং সন্তানের সম্পর্ক। প্রতিটি শিশু উদারতা, ভালবাসা, দানশীলতা, ন্যায় এবং অন্যায়ের পার্থক্য শেখে মায়ের কাছ থেকে। কারণ শিশুর প্রথম শিক্ষক হচ্ছেন একজন মা। তাই আমরা দেখতে পাই পৃথিবীর বিখ্যাত ব্যক্তিদের অনেকেই বলেছেন তাঁদের কৃতিত্বের জন্য সবচেয়ে বেশি অবদান রয়েছে মায়ের। জন্মের পর থেকে শিশু তার চারপাশের মানুষ ও রীতিনীতি উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় মায়ের মাধ্যমে। শিশুকে ভবিষ্যৎ জীবনে মিথ্যাচারণ, উচ্ছৃংখলতা, অমানবিকতা, সাম্প্রদায়িতা, নিষ্ঠুরতা, সন্ত্রাসী এবং মাদকাসক্তি থেকে রক্ষা করতে পারেন একজন সৎ, আন্তরিক, অসাম্প্রদায়িক, দানশীল, মিতব্যয়ী, জননী। সে সাথে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরও সৎ গুণের অধিকারী হওয়া প্রয়োজন। তবেই রমজান মাসের প্রকৃত শিক্ষা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে প্রতিফলিত হবে।
পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশে সমাজতন্ত্রের মাধ্যমে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য দূর করার জন্য প্রচেষ্টা চলছে। কিন্তু ইসলাম ধর্মের বিধান অনুযায়ী সৎ উপায়ে উপার্জিত ধনী ব্যক্তিদের সম্পদের সঠিক পরিমাণ যাকাতের অর্থ গরীব ও দুস্থ ব্যক্তিদের দেওয়া ফরজ করা হয়েছে। এর ফলে সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর হয়ে মানুষের মধ্যে শান্তি বিরাজ করবে। তাই ইসলাম ধর্মের নির্দেশ হচ্ছে একজন মানুষের পরিপূর্ণ ও সার্থক জীবনের পথ প্রদর্শক।
টীকা: রমজান মাসে প্রচুর ইফতার গ্রহণ এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত অনর্থক অর্থ ব্যয়ের সাথে সাথে মনে রাখতে হবে, যাকাত প্রদান করা ফরজ।
লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট, অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক।