(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
৫) ৬ই মার্চ। ‘ভুট্টো সাহেব শুনুন’ : ‘অনেক রক্ত দেখিলাম, অনেক কান্না শুনিলাম। স্বায়ত্তশাসনের দাবী প্রতিষ্ঠার জন্য পূর্ব বাংলাকে অনেক অনেক কোরবানীও দিতে হইল। গত কয়েক দিনের মধ্যে রক্ত গোলাপের মত যেই প্রাণ গুচ্ছ বিসর্জন দেওয়া হইল তাই যেন বাংলার দাবী প্রতিষ্ঠার জন্য শেষ বলী হিসাবে গণ্য হয়। পূর্ব বাংলা আর রক্ত ঝরাইতে পারিবে না। আর নয়।’
তথাকথিত ক্ষমতা দুর্গের নায়ক ভুট্টো সাহেব অনেক লীলা খেলাই আপনার দেখিলাম। এত বেশী মূল্য দিয়া বাংলাদেশ আর আপনার রাজনৈতিক ভ্যাংচামী দেখিতে চায় না।’
৬) ৭ই মার্চ। ‘ইয়াহিয়ার ভাষণ ও তারপর’ : ‘পূর্ব বাংলা ন্যায্য দাবী প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণ দিতে পারে, প্রাণ দিয়া দাবী প্রতিষ্ঠা করিতে জানে। ভাষা আন্দোলন হইতে আরম্ভ করিয়া ছয় দফা আন্দোলন পর্যন্ত অনেক রক্তাক্ত আন্দোলন তার অম্লান স্বাক্ষর হইয়া রহিয়াছে।’
৭) ১০ই মার্চ। ‘যুক্তিযুক্ত : ‘আগামী ২৫শে মার্চ তারিখে আহুত জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের প্রশ্ন বিবেচনার নিমিত্ত আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান যে চারটি শর্ত আরোপ করিয়াছেন, সেই গুলিকেই শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মর্যাদা যাচাইয়ের ব্যবস্থা বলিয়া গণ্য করিলে ভুল করা হইবে।’
৮) ১২ই মার্চ। ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে করণীয়’ : ‘শ্রেফ উপর হইতে জোর খাটাইয়া কোন শাসন ব্যবস্থা চালু করা যায় না। শাসন ব্যবস্থা প্রকৃত পক্ষে কার্যকরী হওয়ার জন্য জনগণের সম্মতির প্রয়োজন।
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের শাসন চালু হইলেও এই ব্যবস্থা বর্তমান নিরঙ্কুশ নয়। প্রকৃত পক্ষে যাহা চলিতেছে তাহাকে ঠিক দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা বলা যায় না, তবে পুরাতন ব্যবস্থা অকেজো হইয়া পড়িয়াছে সত্য।’
৯) ১৬ই মার্চ। ‘চূড়ান্ত আবেদন’ : ‘বঞ্চনা মুক্তির দাবীতে সারা বাংলাদেশ আজ ঐক্যবদ্ধ, সর্বশ্রেনীর মানুষ এক জমায়েতে সামিল। বাংলাদেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র শুরু হইয়াছিল তার প্রতিবাদে সাড়ে সাত কোটি মানুষের এই জনপদ দুই সপ্তাহ ধরিয়া অবিরাম অহিংস অসহযোগ আন্দোলন চালাইয়া আসিতেছে। এখন আজ সকলেই ঘরের ছাদে কাল পতাকা উড়ায়, কেউ টেঙ দেয় না, নিজেদের নির্বাচিত নেতৃমণ্ডলী ব্যতীত অন্য কারও আদেশ নিষেধ মান্য করে না। … যুগ যুগ ধরিয়া যে নীতি ও বিধি বিধান বাংলাদেশকে শুধু বঞ্চিতই করিয়াছে সেই গুলির বুকে আজ পদাঘাত করারই দিন। … এ কয়েক দিন আগেও স্বাধিকার আন্দোলনের কারণে অনেক অজ্ঞাত সংখ্যক বাঙালি যুবককে গুলি খাইয়া মরিতে হইয়াছে। এবার শেষ সংগ্রাম। এবার কার আন্দোলন চুড়ান্ত বিজয়ের আন্দোলন।’
১০) ১৭ই মার্চ। ‘খাদ্য জাহাজের প্রশ্নটি’: ‘আমেরিকা হইতে খাদ্যশস্য লইয়া খাদ্যশস্য চট্টগ্রাম বন্দর অভিমুখে আগমনরত একখানি জাহাজকে করাচীর দিকে গতি পরিবর্তন করিতে বাধ্য করাচির দিকে গতি পরিবর্তন করিতে বাধ্য করা হইয়াছে বলিয়া এক সংবাদের সভ্যতা চ্যালেঞ্জ করিতে গিয়া সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ যা বলিয়াছেন প্রকৃত তথ্যের সহিত তাহার কোন সম্পর্ক নাই। এর দ্বারা প্রমাণিত হইল যে, এই কর্তৃপক্ষ আসল সত্য চাপা দিতে চাহিয়াছেন অথবা আসল তথ্য তাদেরও জানা নাই।
আওয়ামী লীগের পক্ষ হইতে সামরিক কর্তৃপক্ষের এই প্রতিবাদ জানাইয়া প্রকৃত তথ্য উদ্ধারের জন্য তদন্ত দাবী করা হইয়াছে। এতে আরও বলা হইয়াছে যে, একখানি জাহাজের গতি পরিবর্তন করা হইলেও আরও একখানি খাদ্য শস্য বাহী জাহাজের ৬ই মার্চ তারিখে চট্টগ্রাম আসিবার কথা কিন্তু আসে নাই।
…অবশ্য স্বাধিকারের জন্য আন্দোলন চলিতেছে, কেবল ত্যাগের মধ্য দিয়াই যে তার সাফল্য আসিতে পারে বাংলাদেশের জনগণ সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন।’
১১) ১৮ই মার্চ। ‘সত্যকে আর চাপা দেওয়া যায় না’ : ‘ক্ষমতার প্রতি জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টোর মোহ কোন সময় গোপন বিষয় ছিল না। তবে আজিকার মত একটা ধ্বংসাত্মক রূপ তা কখনো লাভ করিতে পারে নাই। আজ ভুট্টো সাহেবের ক্ষমতা লোলুপতাদেশের উপর কহর নামাইয়া আনিয়াছে। অনেক গুলি প্রাণ অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলিয়া পড়িয়াছে।
…. দেশের অন্যতম প্রবীণ রাজনীতিবিদ জনাব আবুল হাশেম সেই দিন ভুট্টো সাহেবের ঐ জাতীয় কাণ্ড কারখানার উপর মন্তব্য প্রকাশ করিতে গিয়ে বলেন, জেনারেল ইয়াহিয়া যদি ভুট্টোর পরামর্শ মত চলেন তাহলে পাকিস্তানের বিভক্তি অবধারিত। এক কথায় যথার্থ প্রমাণের জন্য আজ গবেষণা শক্তির প্রয়োজন নাই।
বাস্তব অবস্থাকে আর অস্বীকার করা যায় না। জোর করিয়া সত্যকে চাপা দিয়া জোরাতালি অবলম্বন নয়। সত্যকে এবার ভাসিয়া উঠিতে দেওয়া হোক এবং নি:সংশয়চিত্তে বরণ করিয়া ভবিষ্যতের পথকে মধুময় ও পুষ্পমণ্ডিত পূর্ণ সুন্দর করা হোক, ইহাই আমাদের তথা বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের একান্ত কামনা।’
১২) ১৯শে মার্চ। ‘কর্মের প্রতি প্রস্তুত থাকিব’ : ‘অহিংস অসহযোগ আন্দোলন সম্পর্কে আর তিল মাত্র সন্দেহের অবকাশ নাই। পাক ভারত উপমহাদেশে এধরনের আন্দোলন আগেও হইয়াছে। খাজনা বন্ধ করার আন্দোলন অন্যান্য দেশেও হইয়াছে। কিন্তু বাংলাদেশের এই আন্দোলনের সাফল্য নজিরবিহীন।
… বর্তমানে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের মূল লক্ষ্য হইতেছে বাংলাদেশের বাইরে অর্থ ও সম্পদ পাচার বন্ধ করা এবং গণ সরকারের প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করা।’
১৩) ২০শে মার্চ। ‘সাম্প্রতিক ঘটনার তদন্ত’: ‘বঙ্গবন্ধুর চার দফা শর্তের অন্যতম ছিল এ মাসের প্রথম সপ্তাহে হরতাল উপলক্ষে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সেনাবাহিনীর গুলি বর্ষণের ব্যাপারে তদন্ত অনুষ্ঠান। শর্ত মানিয়া লইয়া কার্যকরী করার ব্যবস্থা হইয়াছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সামরিক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক আয়োজিত তদন্ত ব্যবস্থার সম্মতি দিতে পারে নাই। শেখ সাহেব সামরিক কর্তৃপক্ষের গঠিত তদন্ত কমিশন সম্পর্কে মন্তব্য প্রসঙ্গে বলেন, এ ধরনের কমিশন কোন উদ্দেশ্য সার্থক করিয়া তুলিতে পারে না। কার্যতঃ এ ধরনের কোন তদন্তের দ্বারা প্রকৃত সত্য নির্ধারণ করা করা আদৌ সম্ভব নয় বরং উহা জনগণকে বিভ্রান্ত করারই একটা কৌশল মাত্র।
এ প্রসঙ্গে সামরিক কর্তৃপক্ষের প্রতি আমরা আহ্বান জানাই সেন্যদের প্রকৃত অর্থে ব্যারাকে ফিরাইয়া নিতে। নচেৎ তাদের উস্কানীমূলক কার্যকলাপের দরুণ পুনরায় দুঃখজনক পরিস্থিতির উদ্ভব হইতে পারে বলিয়া আমাদের আশংকা।’
১৪) ২১ শে মার্চ। ‘বর্ণচোরা কুচক্রীরা সাবধান’ : ‘গণ আন্দোলনের সাফল্যকে বরবাদ করার জন্য এক শ্রেণীর লোকের তৎপরতা আমরা ১৯৬৯ সালেও দেখিয়াছে। এবারও দেখিতেছি। বলা বাহুল্য এরা আন্দোলনের বিরোধী বলিয়া দেখায় না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বের মধ্য দিয়া সমগ্র বাংলাদেশ যখন ঐক্যবদ্ধভাবে অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নিয়োজিত তখন এরা আন্দোলনে শরিক হওয়ার ভান করিয়া কৌশলে আন্দোলনকে স্রেফ কয়েকদিনের হৈ চৈ এ পর্যবসিত করিতে উদ্যত হইয়াছে। আমরা জানি জনগণের রোষের উপর প্রকাশ্যে কোন উশৃঙ্খল আচরণ করিতে চাহিবে না। পর্দার অন্তরালে থাকিয়া ঢিল ছুঁড়িয়া বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির প্রয়াস পাইবে। … তাদের শয়তানির সহিত বাংলার জনগণ পরিচিত রহিয়াছে। যদি বর্তমানে সন্ধিক্ষণে ও সেই শয়তানীর দ্বারা তাঁরা জনগণের লক্ষ্য হাসিলের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করিতে চায় তবে মস্তবড় ভুল করিবে।
১৫) ২২শে মার্চ। ‘সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই আন্দোলন’: ‘বর্তমান আন্দোলনের সুযোগে কিছু সংখ্যক লোক অপকর্মে লিপ্ত হইয়াছে। কোনো রাজনৈতিক দল অপকর্মে লিপ্ত হইতে পারে না। রাজনৈতিক দল সমূহের মত ও পথ ভিন্ন হইতে পারে কিন্তু চুড়ান্ত লক্ষ্য এক মানুষের কল্যাণ।’
১৬)২৩শে মার্চ। ‘২৩শে মার্চ’ – ‘আজ ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব দিবস পালন করিতে গিয়া আমরা আমাদের সামনে লাহোর প্রস্তাবের শবদেহকে লইয়া শোকার্ত বিস্ময়ে অভিভূত।
১৭) ২৬শে মার্চ। ‘ইহা কি অপরিহার্য ছিল’ – অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে ২৩ তম দিবসে চট্টগ্রামে যে দুঃখজনক ঘটনা ঘটিয়া গেল তাহার জন্য স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে ইহার কি প্রয়োজন ছিল। ইহা কি এড়ান যাইত না।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাংলাদেশের মানুষ সুশৃঙ্খলভাবে আন্দোলন চালাইয়া যাইতেছে। নেতার নির্দেশে জনসাধারণ সামরিক বাহিনীর অস্ত্র–শস্ত্র, গোলা–বারুদ উঠান নামান ইত্যাদিতে সহযোগিতা করা হইতে বিরত থাকিয়া অন্যান্য প্রয়োজনীয় সকল বিভাগে কাজ সুষ্ঠুভাবে চালাইয়া যাইতেছে। ঠিক তখনি সামরিক বাহিনীর লোকজন প্রকাশ্যে দিবালোকে জনসাধারণের সম্মুখে তাহাদের অস্ত্র সম্ভার নামাইয়া লইয়া যাইবার চেষ্টা করিয়া জনসাধারণকে উত্তেজিত করিয়া তোলে।’
১৯৭১’র ২৭শে মার্চ হতে জুনের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত দৈনিক আজাদী বন্ধ ছিল। এ সময়ের মধ্যে এর মালিক, সাংবাদিক ও প্রেস কর্মচারীদের উপর বিভিন্ন ভাবে হানাদার বাহিনীর অত্যাচারের স্টীল রোলার চালানো হয়।
লেখক : জীবন সদস্য, বাংলা একাডেমি; সভাপতি (১৯৭২–৯০)-শেখ মুজিব গণ পাঠাগার (গহিরা, রাউজান, চট্টগ্রাম) ও কলামিস্ট।