গতকাল ১৪ মার্চ সারা বিশ্বে পালিত হয়েছে আন্তর্জাতিক গণিত দিবস বা ‘পাই ডে’। এবারের গণিত দিবসের থিম বা বিষয়বস্তু ছিল ‘সবার জন্য গণিত’। প্রতিবছর মার্চের ১৪ তারিখ, সারাবিশ্বে এ দিবসটি উদযাপিত হচ্ছে ২০২০ সাল থেকে। ২০১৯ সালে ইউনেস্কো সারা বিশ্বের গণিতবিদদের জন্য ১৪ই মার্চ তারিখকে আন্তর্জাতিক গণিত দিবস বা পাই দিবস হিসেবে উদযাপন করার সিদ্ধান্ত নেয়। তখন থেকেই প্রতিবছর নিত্যনতুন থিম নিয়ে সারা বিশ্বে একযোগে এ দিবসটি উদযাপন করা হয়। আন্তর্জাতিক গণিত সংস্থা প্রথম ২০২০ সালে যে থিমটি কাজ করেছিল সেটি হচ্ছে ‘ গণিত সর্বত্র ‘। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে গণিতের যে সব ক্ষেত্রেই প্রয়োগ দেখা যায় তা থেকেই মূলত এটি নির্ধারণ করা হয়েছিল। আবার ২০২১ সালে, পুরো বিশ্ব ছিল মহামারি করোনা আক্রান্ত। খুব সাদামাটা কবে পালিত হয়েছিল বিশ্বব্যাপী এ দিবসটি। ঐ বছর থিম ছিল ‘একটি উন্নত বিশ্বের জন্য গণিত’। করোনা ভাইরাসের বিস্তার, তথা টিকা আবিষ্কারে গাণিতিক মডেল, অ্যালগরিদম এবং জেনেটিক কোডিং করার সময় গণিত ব্যবহারের অপরিহার্যতা নিয়েই বিষয়টি ঠিক করা হয়েছিল। আর ২০২২ সালে, বিষয় ছিল ‘গণিত একত্রিত করে‘। গণিত হলো এমন একটি সাধারণ ভাষা যা আমাদের সবার দরকার। প্রত্যেককে এটির ব্যবহারের মাধ্যমে প্রাত্যহিক জীবনের কাজকর্মগুলো সারতে হয়। আমরা একে অপরের সাথে যোগাযোগের জন্য যে মোবাইল ব্যবহার করি তা কতগুলো অংকের সমন্বয়ে একটি বড় সংখ্যা। কোন একটি আয়োজনে যখন আমরা একত্রিত হই তখনো হিসাব কষা প্রয়োজন হয় সঠিকভাবে সফল করার জন্য। আসলে করোনা পরবর্তী রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের দামামায় বিশ্বব্যাপী দ্রব্যমূল্যের যে লাগামহীন উর্ধ্বগতি বিরাজ করছিল তাতে বিশ্বের মানুষকে রক্ষায় নিজেদের একত্রিত করার কোন বিকল্প ছিল না।
এবছর ২০২৩ সালের জন্য থিম ঠিক করা হয় ‘সবার জন্য গণিত‘। আর এটি প্রস্তাব করেন ফিলিপাইনের একজন স্কুল ছাত্র মার্কো জার্কো রোটাইরো। এই বিষয়টি নির্ধারণের ব্যাপারে তাঁর যুক্তি ছিল, সে বিশ্বাস করে যে গণিত সবার জন্য হওয়া উচিত কারণ আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই স্বাভাবিক কিছু বিভিন্ন মাত্রার গাণিতিক ক্ষমতা রয়েছে। এই ক্ষমতা ব্যক্তি ভেদে তা এক একজনের একেক রকম। তারপরও আমাদের অবশ্যই সবাইকে গণিতের বিস্ময় উপভোগ করতে হবে। গণিত বিষয়টি শুধুমাত্র যে প্রতিভাধর এবং প্রতিভাবানদের জন্য বলে আমরা মনে করি, এ ধারণাটির পরিবর্তন হওয়া উচিত। প্রায় একই ধরনের বিষয়বস্তু নিয়ে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আরো অনেকেই আন্তর্জাতিক গণিত সংস্থায় তাদের মতামত পাঠিয়েছিলেন। যেমন কেবট লার্নিং ফেডারেশন, ব্রিস্টল থেকে ফিন ম্যাক্লোলিন এর মতে, অনেকে নিজেকে তিনি গণিতবিদ নন বা গণিত তাদের জন্য নয়, এরকম বলতে শোনা যায়। বরং গণিত সবার জন্য এবং প্রত্যেকেই গাণিতিকভাবে চিন্তা করতে সক্ষম। এসব কিছু মিলিয়ে আসলে এবারের থিমটি ঠিক করা হয়েছে।
বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সাথে যুক্ত থাকার সুবাদে প্রান্তিক পর্যায়ে এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গণিত নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, ঐতিহ্যগতভাবে আমাদের দেশে গণিতকে একটি ভয়ঙ্কর বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এটি বিশ্বাস করা হয় যে, যাদের শুধুমাত্র কিছু নির্দিষ্ট ধরনের গাণিতিক সমস্যা সমাধানের দক্ষতা আছে, এবং গণিত নিয়ে গবেষণা করছে গণিতের রাজ্যটি শুধু তাদেরই জন্য। আসলে ব্যাপারটা কিন্তু তা নয়। সকালে উঠেই আমরা জানতে চাই কয়টায় ঘুম থেকে উঠেছি শুরু তাও হয় আমাদের যাত্রা গণিত দিয়ে। তারপর সারাদিন যে বিভিন্ন কাজ আমাদের করতে হয় তার সাথেও কোনো না কোনোভাবে গণিত জড়িত থাকে। দিনশেষে একজন মানুষ কখন ঘরে ফিরবেন এবং কখন ঘুমাতে যাবেন তাও একটা গাণিতিক হিসাব অনুযায়ী হয়ে থাকে যেটা সময় নির্ভর।
এবার আসি পাই ডে নিয়ে কিছু কথাবার্তায়। এই দিবসটি প্রথম উদযাপন করা হয় ১৯৮৮ সালে। মজার ব্যাপার হলো এই দিবসটি কোন বিশ্ববিদ্যালয় বা কোন গণিত বিভাগে কোন বিজ্ঞানী বা শিক্ষকের উদ্যোগে উদযাপিত হয়নি। বরং হয়েছিল সানফ্রান্সিসকোর একটি সায়েন্স মিউজিয়ামের একজন কর্মকর্তার মাধ্যমে। উনার নাম হচ্ছে ল্যারি শ এবং উক্ত কাজের জন্য উনাকে পাই এর রাজপুত্র উপাধি দেওয়া হয়েছে। আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে, বিশ্বের সবচেয়ে স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় এমআইটি তাদের নতুন শিক্ষার্থীদের আবেদনের এক্সেপটেন্স লেটার পাই ডে –তে তাদের কাছে ডাকযোগে বা ইমেইলে প্রেরণ করে থাকেন। কাকতালীয়ভাবে এদিনে মহাবিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং আরেক প্রথিতযশা বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং মৃত্যুবরণ করেছিলেন। পাই এর মান মোটামুটিভাবে ৩.১৪১৫৯২৬ পর্যন্ত নিলে আমরা দেখি উক্ত বছরের ৩য় মাস ১৪ তারিখ দুপুর ১টা ৫৯ মিনিট ২৬ সেকেন্ড হিসেবে পাই দিবস, পাই মিনিট ও পাই সেকেন্ড হিসেব করতে পারি। গণিতে পাই–এর মান দশমিকের পর অসীম পর্যন্ত কোনো পৌনঃপুনিক ক্রম ছাড়াই চলতে থাকে । বৃত্তের পরিধির ব্যাসের অনুপাত নিয়ে পাই এর মান গণনা করা হয়। ২০১৯ সালে, গুগলের কর্মচারী এমা হারুকা ইওয়াও, পাই এর মান ৩১ ট্রিলিয়ন অঙ্কে গণনা করে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড ভেঙেছেন। গণনা করা অঙ্কের সুনির্দিষ্ট সংখ্যা ছিল ৩১,৪১৫,৯২৬,৫৩৫,৮৯৭। ২৫ টি ভার্চুয়াল মেশিন ব্যবহার করে গণনা করতে প্রায় ১২১ দিন সময় লেগেছে। আর গণিতের যে সবচেয়ে সুন্দর সমীকরণ অয়লার সমীকরণেও পাই–এর উপস্থিতি আমাদের আনন্দিত করে। এদিন প্রায়শই মানুষ কেক কেটে বা পাই (পিঠা) খেয়ে দিনটি উদযাপন করে।
এখন প্রশ্ন হল আন্তর্জাতিক গণিত সংস্থার এই দিনটিকে আলাদা করে পালন করার উদ্দেশ্যটা কি? যতদূর জানা যায় উক্ত সংস্থা মোটামুটি এগারোটি উদ্দেশ্য নিয়ে বিশ্বব্যাপী গণিতকে জনপ্রিয় করার কাজে এগিয়ে যাচ্ছে। যার মধ্যে কয়েকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে। যেমন: গণিতভীতি দূরীকরণ; শিক্ষায় গণিতের গুরুত্ব সম্পর্কে সাধারণ জনগণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের অবহিতকরণ; বিজ্ঞানভিত্তিক একটি জাতি গঠনে গাণিতিক সক্ষমতা বৃদ্ধি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভূমিকা রাখা; লিঙ্গ বৈষম্য দূর করার জন্য মেয়েদেরও গাণিতিক সক্ষমতা বাড়ানো; একটি দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন ব্যবস্থা, টেলিযোগাযোগ এবং সর্বোপরি মানুষের মঙ্গলের জন্য একটি আধুনিক সমাজ গঠনে গণিতের যে ভূমিকা আছে তা মানুষকে অবহিত করা। আমরা দেখতে পাই এর অনেকগুলোই উদ্দেশ্য একটি উন্নত দেশ গঠনে যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, সেগুলোর সাথে মিল আছে। বাংলাদেশ যে ২০৪১ সালে একটি উন্নত দেশে পরিবর্তন হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এগুচ্ছে, তা সফল করতে হলে আমাদেরকেও আন্তর্জাতিক গণিত সংস্থার উদ্দেশ্যগুলোর সাথে সমানতালে কাজ করতে হবে। আমরা যাঁর যাঁর জায়গা থেকে যেটুকু সম্ভব সহযোগিতা করে গেলেই মূল লক্ষ্যে পৌঁছানো সহজ হবে। আমাদের সবার জীবন পাই–এর মতো সুন্দর হোক। সুখ স্বাচ্ছন্দ্যগুলো পর্যাবৃত্ত হোক দশমিকের পরের পাই– এর অংকগুলোর মতো।
লেখক : অধ্যাপক, গণিত বিভাগ,
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)।