(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
‘নিষিদ্ধ শহরে’ ঘুরঘুর করছিলাম। ফরবিডেন সিটি নামের এই উন্মুক্ত শহরের পরতে পরতে সাতরাজ্যের বিস্ময়! যেদিকে চোখ যাচ্ছিল সেদিকেই অবাক করা দৃষ্টিতে দেখছিলাম। বিস্ময় শুধু আমার একার নয়, আরো অনেক মানুষের চোখেই বিস্ময়ের মাখামাখি দেখতে পাচ্ছিলাম। কয়েকশ’ মানুষ সিটিতে চক্কর মারছেন, ছবি তুলছেন। নারী পুরুষ অনেক। তাদের কারোরই চোখেমুখে মুগ্ধতার অভাব নেই। অবশ্য একটি জিনিস বেশ লক্ষণীয় যে, ঐতিহ্যে মোড়ানো চীনের বেইজিং শহরের ফরবিডেন সিটি নিয়ে শিশু কিশোরদের মাঝেও তুমুল আগ্রহ। প্রচুর শিশু কিশোর ঘুরছিলো। তারা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল তাদের অতীত, তাদের ঐতিহ্য। সম্রাট নামের বিশেষ একটি শ্রেণীর দাপুটে মানুষের কাছে তাদের পূর্বপুরুষেরা কিভাবে নির্যাতিত হতো তা যেনো নতুন করে দেখছে তারা। ঘোরলাগা চোখে তাকাচ্ছিলো এদিক ওদিক। আমিও ঘুরছিলাম। পুতুল পুতুল চেহারার শিশু কিশোরদের সাথে ঘুরতে বেশ ভালোই লাগছিল।
চীনের ফরবিডেন সিটির সম্রাটদের প্রতি আমার বিশেষ কোন বৈরিতা নেই, কোন রাগ অনুরাগও নেই। কারণ এই সম্রাটদের সাথে আমার বা আমাদের কোন সম্পর্ক ছিলো না। তারা আমার পূর্ব পুরুষদের অত্যাচার বা নির্যাতন করারও কোনো সুযোগ পেয়েছে বলে মনে হয়না। এই সিটির ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়েও আমি যতটুকু না আগ্রহী তার থেকে ঢের বেশি আগ্রহ আমার সৃষ্টিতে। ঘোর লাগা চোখে আমি দেখছিলাম এক অনন্য সৃষ্টি। কী করে এভাবে এত সুন্দর স্থাপনা গড়ে তোলা সম্ভব! কী করে নিশ্চিত করা যায় এত আয়োজন! আজ থেকে ছয়শ’ বছর আগেকার নানা সীমাবদ্ধতার মাঝে কী করে সম্ভব ছিল এতকিছু! এত নিখুঁত নিরাপত্তা বলয়ও বা কী করে তৈরি করা হয়েছিল! ছয়শ’ বছরেরও বেশী আগের পৃথিবীর যে দৈন্যতা তার কোন আঁচড় এখানে লাগতে দেয়া হয়নি। রাখা হয়নি কোন কিছুর অভাব! একটি স্থাপনাকে অপরূপ করতে যতটুকু করা দরকার তার সবই করা হয়েছে। চোখ ধাধানো জৌলুশের ছড়াছড়ি ফরবিডেন সিটির আনাচে কানাচে! যতটুকু জানা গেলো, ১৪০৬ সাল থেকে ১৪২০ সালের মধ্যে ফরবিডেন সিটিতে জৌলুশ তৈরি হয়। ওই সময় এই সিটির অধিকাংশ মূল স্থাপনা গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে নানা প্রয়োজনে আরো কিছু স্থাপনা তৈরি হয়েছে। ফরবিডেন সিটিতে বিভিন্ন সময় অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। আগুনে পুড়ে টুড়ে যায় বিভিন্ন ভবন, ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে আগুনে পুড়লেও ফরবিডেন সিটির সৌন্দর্যে আঁচড় লাগতে দেয়া হয়নি। দক্ষ ইঞ্জিনিয়র না থাকলেও সুদক্ষ সব কারিগরেরা পরম মমতায় এবং যত্নে ফরবিডেন সিটিকে আগের মতো করে গড়ে তোলে।
আমাদের গাইড মিজ পিনং হাত উঁচিয়ে সবাইকে একস্থানে জড়ো করলেন। বললেন, চারদিকে ছোটাছুটি করলে সমস্যা হবে। ভালো করে সবকিছু দেখতে পারবেন না। এখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার রয়েছে। রয়েছে বহু ইতিহাস, ঐতিহ্য। আপনারা ধৈর্ষ ধরে আমার পাশে থাকলে কোন কিছু বাদ পড়ার আশংকা থাকবে না। আপনাদের সফর সফল হবে, কষ্ট সার্থক হবে। তিনি তাকে অনুসরণ করার আহ্বান জানিয়ে বললেন, আমরা ক্রমান্বয়ে একটি একটি করে সব দেখবো। এখন আমরা একটি জাদুঘরে যাবো।
জাদুঘর? ফরবিডেন সিটিতে মিউজিয়াম? মিজ পিনং মাথা নাড়লেন। বললেন, সুন্দর একটি জাদুঘর আছে। ভালো লাগবে। আমরা পা বাড়ালাম। ফরবিডেন সিটির কোন রাজা বাদশার ব্যবহৃত একটি ভবনে গড়ে তোলা হয়েছে সমৃদ্ধ এক জাদুঘর। চীনের কিং সাম্রাজ্যের সময়কালের বেশ গুরুত্বপূর্ণ কিছু জিনিসপত্র জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। আমরা দেখলাম যে, জাদুঘরের গ্যালরিতে থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে নানা ব্যবহার্য জিনিস। এরমধ্যে বেশ কিছু চিত্রশিল্প, সিরামিকের জিনিসপত্র, কয়েকটি ভাস্কর্য সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এছাড়া থালা বাসন থেকে শুরু করে আরো বেশ কিছু জিনিসপত্র রয়েছে, সুরাপাত্রও। চা খাওয়ার সরঞ্জামের মতোও কিছু জিনিসপত্র দেখা গেল। ছবি এবং জিনিসপত্রের নিচে কাগজে ক্যাপশন বা পরিচিতি লিখে দেয়া হয়েছে। জাদুঘরে প্রদর্শিত জিনিসপত্রের কোন কোনটিতে দস্তাসহ নানা ধাতুর ব্যবহারও দেখা গেলো। চিত্রশিল্পে নানা রঙের ব্যবহার হয়েছে। তবে ছবিগুলোতে ঠিক কী বুঝানো হয়েছে তা উদ্ধার করা আমার জন্য কঠিন ছিল। অবশ্য কয়েকটি নারী মুখের ছবিও দেখা গেলো। অচিন নারী!
জাদুঘর সবসময় আমাকে টানে। ভালো লাগে। পুরানো দিনের জিনিসপত্র দেখতে দেখতে ওই সময়টাকে কল্পনা করা যায়। তাদের থেকে আমরা কত এগিয়ে আছি, কতটুকু জটিল হয়েছি তাও কড়া নাড়ে ভাবনার দুয়ারে। পৃথিবীর এগিয়ে যাওয়া বা পৃথিবীর নষ্ট হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটিও বেশ টের পাওয়া যায় জাদুঘরে। জাদুঘরে বন্দি অতীত অনেক কিছু শিখানোর চেষ্টা করে, নিরন্তর চেষ্টা।
মিজ পিনং যা যা বলছিলেন তার সবটুকু বুঝে নেয়ার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি চীনা রমনীর কথা শতভাগ বুঝা আর চীনা ভাষার ক্লাসে বসা একই কথা। ভালো ছাত্রদের জন্য এমন ক্লাস আনন্দদায়ক বা উপভোগ্য হলেও আমার মতো গাধা টাইপের মানুষের পক্ষে বিষয়টি একটু বেশি কঠিন। তবুও কান খাড়া করে উনার ইংরেজী শব্দগুলো উদ্ধারে সচেষ্ট ছিলাম। যতটুকু পাওয়া যায় তার সবটুকুই লাভ–এমন একটি ভাব ছিল আমার ভিতরে। অবশ্য অনেককেই দেখলাম, কোন লাইভ গাইডের ধার ধারেন নি। একটি গাইড বই হাতে নিয়ে নিজেদের মতো করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবকিছু দেখছেন। খেয়াল করে দেখলাম যে, গাইড বইগুলো ম্যান্ডারিন ভাষায়, চীনের এই ভাষা বুঝার সাধ্যি আমার নেই। অতএব বই–টই কেনার চিন্তা বাদ দিয়ে মিজ পিনং এর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
জাদুঘর থেকে বের হয়ে আরো কয়েকটি ভবনে আমরা ঘুরলাম। কতকিছু যে দেখলাম তার ইয়ত্তা নেই। মিজ পিনং এবার আমাদেরকে একটি বাগান দেখানোর কথা বলে অন্যদিকে পথ নির্দেশ করলেন। ইম্পেরিয়াল গার্ডেন। রাজকীয় বাগান। এই বাগানে রাজা রাণী এবং উপপত্নীদের নিয়ে ঘোরাঘুরি করতেন। হাওয়া খেতেন। রাজার রাজকীয় জীবনাচারের সাথে ইম্পেরিয়াল গার্ডেনের যোগাযোগ খুবই ঘনিষ্ঠ। রাজা আয়েশ করতেন, রাণী আয়েশ করতেন। আয়েশ করতেন উপপত্নীরা। চারদিকে আয়েশের এত ছড়াছড়ি এই বাগানজুড়ে চলতো যে আজো যেন তার আমেজ পাওয়া যায়। সত্যিই কী এই বাগানে সবাই আয়েশ করতেন? উপপত্নী হিসেবে থাকা রমনীদের জীবনে কি আয়েশ ছিল! তাদের জীবনে কী সুখ ছিল! তাদের বুক কী একটুও ভারী হতো না! নিঃশ্বাস নিতে কী তাদের একটুও কষ্ট হতো না। কে জানে! তবে বাগানটি যে রাজার বাগান বা বাগানের রাজা তার প্রমাণ মিলছে পরতে পরতে। অবশ্য সম্রাটদের সময়কালে বাগানের আদল ঠিক এরূপ ছিল কিনা সেটা জানা যায়নি। কারন বাগানজুড়ে থাকা গাছগুলোর কোনটিই ছয়শ’ বছরের পুরানো নয়। এই বাগাণ বছর বছর ধরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। প্রতিবছরই এখানে গাছ লাগানো হয়, ফুল ফুটানো হয়। সবকিছু মিলে মুগ্ধতার ছড়াছড়ি বাগানটিতে। শুনলাম যে, ফরবিডেন সিটিতে শুধু এই একটি বাগানই নয়, আরো তিনটি বাগান রয়েছে।
ফরবিডেন সিটিতে আমাদের ঘোরাঘুরি শেষ করা হলো। মিজ পিনং ঘোষণা করলেন যে, এবার আমাদের যেতে হবে। কেউ শেষবারের মতো চোখ বুলিয়ে নিলে নিতে পারেন, কেউবা ছবি তুললে ক্লিক করতে পারেন। তিনি আমাদেরকে ফরবিডেন সিটির সামনের গেট দিয়ে বের করলেন। এই গেটকে বলা হয় মেরিডিয়ান গেট। এটিকে এই নামে কেন ডাকা হয় তা আমার জানা হয়নি। গেটের কাছে আমরা আরো একটি বাগানের দিকে গেলাম। জিংশান পার্ক। এটি যেন আরেক বিস্ময়। বাগানে বেশ নান্দনিক কয়েকটি স্থাপনাও রয়েছে। গাছগাছালীতে ঘেরা চমৎকার স্থানটিকে ছবির মতো সুন্দর লাগছিল। প্রায় ৫৭ একর এলাকা নিয়ে চমৎকার সব গাছগাছালীতে ভরা এত বড় একটি বাগান কী করে যে বেইজিং এর মতো ব্যস্ততম শহরে অক্ষত অবস্থায় টিকে আছে কে জানে! মেগাসিটি বেইজিং–এর প্রায় সর্বত্রই ভূমির দাম আকাশ ছোঁয়া, শহরে ভূমির হাহাকারও রয়েছে। সেখানে শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে এত বড় বাগান! ভূমি দস্যু বা ভূমি খেকোদের কেউ বুঝি বেইজিং এ নেই। ফুটপাত বা রাস্তা দখল করে দোকান করে দেয়ার মতো বিশেষজ্ঞ মানুষগুলোরও মনে হয় এখানে অভাব রয়েছে। বেইজিং এর মতো বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত শহরটিতে সবুজে সবুজে একাকার এমন নান্দনিক একটি বাগান বছরের পর বছর ধরে আস্ত থাকা আমাকে আশ্চর্য করলো। ফরবিডেন সিটি দেখে বিস্মিত হয়েছি ঠিক, তবে জিংশান পার্কও অনেক বড় বিস্ময়ের সৃষ্টি করলো আমার মনে! এত গাছ, এত ছায়া, এত পাখি! আহা, কী যে শান্তি!
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।