দেশের অন্যতম প্রধান নদী শঙ্খ। এই নদীকে উপলক্ষ করে চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, বাঁশখালী, আনোয়ারাসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের হাজার হাজার মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে। শত শত জেলে পল্লীর জেলেদের মাছ শিকার, অসংখ্য মাঝি–মাল্লার জীবন ধারণের এই নদীটি এক সময় জৌলুসপূর্ণ ছিল। বর্তমানে নদীর দুই কূল ভেঙে এবং পাহাড়ি বালি অবিরাম জমা হতে হতে চর তৈরি হয়েছে শঙ্খের বুকে। পলিমাটি ও বালি জমে ভরাট হয়ে আছে নদীর দু’পাশ। মাঝখানে পানির ক্ষীণধারা। কোথাও হাঁটু আবার কোথাও কোমরপানি। নদীর বুকে জেগে উঠা চরে চাষাবাদ করেন স্থানীয় কৃষকরা। পাশাপাশি দখল দূষণেও এ নদী এখন জর্জরিত। নাব্যতা হারিয়ে ফেলায় এই নদীকে উপলক্ষ করে জীবিকা নির্বাহকারী লাখ লাখ জেলে, মাঝি–মাল্লা এখন বেকার হতে বসেছে।
বর্তমানে শঙ্খনদীর দোহাজারীসহ বিভিন্ন পয়েন্টে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে অপরিকল্পিতভাবে বালি উত্তোলনের প্রতিযোগিতা চলছে। ফলে বর্ষা মৌসুমে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানির স্রোতে নদী ভাঙন প্রতিরোধে বসানো প্রতিরক্ষা বাঁধ ধসে গিয়ে ভাঙনের শিকার হয়।
জানা যায়, স্বাধীনতা পরবর্তী এ অঞ্চলের প্রধান যোগাযোগের মাধ্যম ছিল এই শঙ্খনদী। নদীপথে লবণ পরিবহনের সহজলভ্যতার কারণে দোহাজারীতে গড়ে উঠেছিল লবণ শিল্প এলাকা। এখনো বেশ কয়েকটি লবণ মিল এখানে রয়েছে। সেসময় যৌবনা, কুলপল্লবী ছিল নদীটি। নদীর প্রশস্থতা কম হলেও গভীরতা ছিল বেশি। সারাবছর পানি থাকতো নদীতে। বান্দরবান থেকে বঙ্গোপসাগরের মোহনা পর্যন্ত যতগুলো বাণিজ্যিক স্থান ছিল প্রায় সবগুলোতেই অসংখ্য নৌকা, সাম্পান ও ইঞ্জিন চালিত বোটের দাপট ছিল। ভিড়তো ছোট ছোট বাণিজ্যিক জাহাজও। ব্যবসায়ীরা এসব নৌ–যানের সাহায্যে তাদের পণ্য সামগ্রী আনা–নেয়া করতো। নাব্যতা হারিয়ে ফেলায় এখন শঙ্খের অনেক জায়গায় ডিঙি নৌকাও চলতে পারছে না। কালের পরিক্রমায় শঙ্খনদীর প্রশস্থতা বৃদ্ধি পেলেও কমতে থাকে গভীরতা। ফলে শীত মৌসুমে নদীতে পানি কমে যায় এবং হাজার হাজার মাঝি নৌকা চালাতে না পেরে বেকার হয়ে পড়েছেন। নৌ–চলাচল ব্যাহত হওয়ায় নদী কেন্দ্রিক যোগাযোগ মাধ্যমও প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বর্ষাকালে পাহাড়ি ঢল নেমে আসলেই কেবল নদীটি তার পূর্ণ যৌবনা ফিরে পায়।
শঙ্খতীরবর্তী উত্তর কালিয়াইশ গ্রামের আবদুল মজিদ জানান, স্বাধীনতা পরবর্তী আমরা দেখেছি নদীর বুক জুড়ে ছোট ছোট ডিঙি নৌকা নিয়ে হাজার হাজার জেলে মাছ ধরতো। বান্দরবানসহ চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, আনোয়ারা, বাঁশখালী থেকে শঙ্খনদী পথে নৌ–যানের সাহায্যে বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী দোহাজারীতে নিয়ে আসতো। এখান থেকে সড়ক ও রেলপথে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরবরাহ করা হতো। তেমনিভাবে বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন দোহাজারী এসে সড়ক ও রেলপথে গন্তব্য স্থানে যেতেন। তাছাড়া নদী পার হওয়ার জন্য বিভিন্ন পয়েন্টে ছিল কেয়াঘাট। বর্তমানে নদীর নাব্যতা না থাকায় বৃষ্টি হলেই দুইকূল পানিতে ভেসে যায়। ঘরবাড়িতে পানি ওঠে। বিস্তীর্ণ ফসলী জমি নষ্ট হয়ে শত শত কোটি টাকা ক্ষতি সাধন হয়। লোকজন ভোগান্তিতে পড়েন।
কাটগড় জলদাস পাড়ার জেলে বলরাম জলদাস জানান, বিভিন্ন প্রকার সুস্বাদু মাছের জন্য আদর্শ প্রজনন ক্ষেত্র মিঠা পানির এ শঙ্খনদী। এ নদীর মাছ আহরণ করে তার পূর্ব পুরুষসহ হাজার হাজার জেলে পরিবার জীবন নির্বাহ করেছেন। চিংড়ি, চিরিং, বাইলা, বোয়াল, রুই, কাতাল, পাঙ্গাস, আইড় মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ পাওয়া যেতো নদীতে। পূর্বের সেই চিত্র এখন আর দেখা যায়না। বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে এক শ্রেণীর কতিপয় ব্যক্তিরা নদীতে বিষ প্রয়োগে মাছ শিকারের অবৈধ পন্থা অবলম্বন করায় এবং নদীর দু’তীরে উৎপাদিত বিভিন্ন সবজি ক্ষেতে ব্যবহৃত কীটনাশকের বিষক্রিয়ায় ধীরে ধীরে মাছের পোনা ধ্বংস হয়ে যেতে থাকে।
চট্টগ্রাম– ১৪ আসনের সংসদ সদস্য মো. নজরুল ইসলাম চৌধুরী আজাদীকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শঙ্খনদীর ভাঙন প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং প্রায় ৩’শ কোটি টাকা ব্যয়ে শঙ্খনদীর চন্দনাইশ ও সাতকানিয়া অংশে কয়েক কিলোমিটার জুড়ে টেকসই প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হয়। পরিকল্পিতভাবে নদী ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নাব্যতা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার কথাও জানান তিনি।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পটিয়া, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া ও লোহাগাড়ার) দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ–বিভাগীয় প্রকৌশলী অপু দেব জানান, প্রায় ১ যুগেরও বেশি সময় ধরে বান্দরবান, চন্দনাইশের ধোপাছড়িসহ বিভিন্ন পাহাড়ে অতিরিক্ত গাছ কাটার ফলে পাহাড়ের শক্ত মাটি বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে নদীতে চলে আসে। এতে নদীর কিছুটা গভীরতা কমেছে। নদী শাসনের ব্যাপারে তিনি বলেন, ডলু ও সাঙ্গু নদীর তীর সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় শঙ্খনদীর বিভিন্ন স্থানে ড্রেজিং চলমান আছে। তবে কিছু কিছু স্থানে স্থানীয়দের দাবির প্রেক্ষিতে ড্রেজিংয়ের বদলে প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।