ইদানীং পত্র–পত্রিকার গরম খবর হচ্ছে উচ্চপদস্থ সরকারি কিছু কর্মকর্তা জনপ্রতিনিধি শিক্ষাবিদসহ সাধারণ নাগরিককে হাত–তোলা, অশ্লীল গালাগালি করছেন–এটা যে এখানে হচ্ছে তা নয়, পুরো উপমহাদেশেরই জনপ্রশাসন এখন রাজনীতিবিদদের তোয়াক্কা না করে ‘আমরাই রাজা’ বনে গেছেন। জনগণতো হিসাবের বাইরে।
রবীন্দ্রনাথের পূর্ব পুরুষরা সবাই স্ব স্ব ক্ষেত্রে বিখ্যাত। অনেকে বিতর্কিতও। কিন্তু রবীন্দ্র প্রতিভার ব্যাপ্তি বড় এক প্লাবন সম। আমরা রবীন্দ্রনাথের গান, প্রবন্ধ ও কাব্য নিয়ে যত পরিচিত তার নাট্য ও গীতিনাট্য নিয়ে তেমন পরিচিত নই। রাজ–রাজরাদের কান্ডও তাদের সহযোগীদের চাটুকারিতা সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের একটি লাইন সবিশেষ পরিচিত রাজা যত বলে পরিষদ দলে বলে তার শতগুণ। বাংলাদেশে মধ্যবিত্তের বিস্ময়কর উত্থানে কয়জন স্মরণ করে এই দুটো লাইন? কয়জনই বা জানে রবীন্দ্রনাথের হৃদয়মথিত কবিতা দুই বিঘা জমি? এটা দুই বিঘা জমি কবিতার দুটো লাইন। রবীন্দ্রনাথ প্রায় দেড়শ বছর আগে শাসক ও প্রজার অবিবেচক সম্পর্কের মুখোশ উন্মোচন করেছিলেন।
এমনি এক রবীন্দ্র গীতিনাট্য বাল্মীকী প্রতিভা। বাল্মীকী হিন্দু মহাগ্রন্থ রামায়ন রচনা করেছিলেন। কাব্য–প্রতিভা জাগার আগে তিনি দস্যু সরদার ছিলেন ও নাম ছিল রত্নাকর দস্যু। তার মধ্যে সত্যের অনুভব হলে–তার চেলা চামুন্তরা তাকে পরিত্যাগ করে এই বলে যে সর্দার পাগল হয়ে গেছে। অর্থাৎ অন্যায় আদেশ এ অভ্যস্ত অধঃস্তনরা ন্যায়ই ভুলে যায়। বাল্মীকি প্রতিভা গীতিনাট্যে রবীন্দ্রনাথ বলেন–
কৃপাণ খর্পর ফেলে দে দে,
বাঁধন কর ছিন্ন, মুক্ত কর
এখনিরে
বাল্মীকির এই আদেশের পর তার অধঃস্তনরা আনুগত্য সরিয়ে নেয় এই বলে–
রাজা খেপেছেরে, তার কথা
আর মানব না।
রাজা মহারাজা কে জানে,
আমিই রাজাধিরাজ, তুমিই
উজির, কোতোয়াল তুমি,
ওই ছোড়াগুলো বরকন্দজ
রবীন্দ্রনাথ দিয়ে যখন শুরু তখন বড় দেশ ভারত দিয়েই শুরু করি। ভারতের লীডার অন্্ ওয়েটিং হচ্ছে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। জনগণকে আন্দোলন বিক্ষোভের শাস্তি হিসেবে ‘বুলডোজার’ চালিয়ে দেবার পরামর্শ দেয় তার পরিষদ, কর্মকর্তাবৃন্দ। বুলডোজার মোজাম্মেল, ওয়াকিলর (সাহানপুর), জাফর হাশমি (কানপুর) এ চলতে চলতে নিরপরাধ প্রমীলা দীক্ষিত ও মেয়ে নীহার (কানপুর) এর ঘর ও গুড়িয়ে দেয়। আদিত্যনাথ ‘বুলডোজার বাবা’ নামে খ্যাত হয়েছেন। প্রমীলার ছোলে শিবম আক্ষেপ করে বলে–ঘরে যখন আগুন লাগিয়ে দেয়া হল তখন জেলা প্রশাসক ও কিছু করল না–দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন। তার দেখাদেখি মধ্য প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ চৌহান ও বুলডোজার দিয়ে অশান্তি দমন করছেন। তাকে নাম দেয়া হয়েছে ‘বুলডোজার মামা’ আমাদের দেশে জনগণ তো দূরের কথা এখন রাজনীতিবিদদের ও বসতে হয় পিছনের সারিতে। আজকে যাদের বয়স ২০–২২ বছর ওরা প্রয়াত বঙ্গবন্ধু, জিয়া–এরশাদ কাউকেই দেখেনি। আবার যাদের বয়স ৪০ ঊর্ধ্ব তারা বঙ্গবন্ধুকেও দেখেনি। বঙ্গবন্ধুর অসংখ্য বক্তৃতার টেপ বর্ষব্যাপী মোড়ে মোড়ে শুনানো হয়। বর্তমানে ৭ই মার্চ এর ভাষণের সমাপ্তি লাইনগুলো মোবাইলের রিং টোন হিসেবে সেট করে দেয়া হয়েছে। এই ভাষণ স্বাধীনতার পূর্বে এক সন্ধিক্ষণে। স্বাধীনতা পরবর্তী রাষ্ট্র প্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ ও নীতি নির্ধারণী ভাষণ দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী উনার মন–মনীষার এক মূল্যবান দলিল। এগুলো সম্বন্ধে বেশি আলোচনা না রাজনীতিবিদদের না কর্মকর্তাদের বলতে শোনা যায় কম। স্বাধীনতা পরবর্তী বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মধ্যে ‘সবচেয়ে Vibrant বক্তৃতা হচ্ছে উনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস এর ১০ই জানুয়ারির ভাষণ। এই ভাষণে তিনি রাষ্ট্রের কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে বলেন–আপনারা উপনিবেশিক কর্মচারী নন। আপনাদের বেতন চলে গরিব দুঃখী শ্রমিক এর ট্যাক্সের টাকায়। বঙ্গবন্ধু তাদেরকে “জনগণের সেবক” ভাবার কথা উপদেশ দেন। সেই ভাষণের অংশটুকু সমস্ত প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের মোবাইলে রিং টোন হিসেবে সেট করে দেয়া উচিৎ।
রাজনীতিবিদ, প্রশাসনিক কর্মচারী জনগণ এই তিন উপাদান এর মধ্যে সমন্বয় না থাকলে রাষ্ট্র সভ্য ও উন্নত স্ট্যটাস বজায় রাখতে পারে না। বর্তমানে এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের উপর যে জমিদারী ও রাজা–প্রজার আচরণ করছে তা বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল Spirit বা বঙ্গবন্ধুর ও অগণিত শহীদদের প্রত্যাশিত প্রজাতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষার সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। আমরা অনেক সময় কোন বিশেষ গ্রুপের ওপর অন্যায় আচরণ হলে খুশী হই যদি তার বিরোধীমতের হই। কিন্তু ভাবিনা যে এটা কয়দিন পর আমার সাথেও হতে পারে। হিটলারের জার্মানীতে ঠিক এরকম ঘটেছিল। প্রথমে অত্যাচার নেমে আসে কমিউনিস্টদের উপর। তখন অন্যরা ভাবল–যাক আমার তো কিছু হচ্ছে না। তারপর যখন আম নাগরিকের উপর বিপদ আসে তখন সব শেষ।
এই প্রবন্ধ লেখার সূত্র হচ্ছে এক প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী দৃঢ়ভাবে বলে– কোন সাংবাদিককে আমি নেগেটিভ কিছু জানার জন্য এখানে ঢুকতে দিইনা। আমার সব পজিটিভ। এটা অত্যন্ত বিপজ্জনক ধারণা। নিজের কাজ কর্ম অন্যকে মূল্যায়ন করতে দিতে অনীহা প্রশাসনের স্থবিরতা, জবাবদিহীহীনতা ও উন্নয়ন গতি শ্লথ করতে বাধ্য। একটা গল্প দিয়ে শেষ করব। ১৯৬২ সালের কথা। তখন কোর্ট বিল্ডিং এ মহকুমা প্রধান বা এসডিও বসতেন। তারা ও সিএসপি অফিসার ছিলেন। প্রত্যেকের দরজায় আজকাল করে মত সাক্ষাতের সময় থাকত। ঐ সময়ে হাটহাজারীর একজন সম্মানি লোক এসডিওর অফিসে ঢুকতে গেলে এসডিও সাহেব তাকে ‘গেট আউট’ বলেছিলেন। ভদ্রলোক উনাকে ইংরেজিতে বললেন– সাক্ষাতের সময়ে ঢুকেছি। তুমি পাবলিক সার্ভেন্ট। আমাকে বের হতে বললেও ‘প্লীজ’ বলা তোমার দায়িত্ব। ভদ্রলোক হাটহাজারীর সম্মানিত ব্যক্তি। আর তখন কোর্ট বিল্ডিং এর কেরানী পিয়ন অধিকাংশ কাটিরহাট সরকারহাটের। উনার চিল্লাচিল্লীতে হাটহাজারীর কেরানী পিয়ন সব এসডিওর অফিসে ঢুকে গেলেন। এসডিও মুরব্বীর কাছে মাফ চাইল।
সময় পরিবর্তন হয়েছে। মানুষের প্রত্যাশা বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের ভাষণেরই প্রতিধ্বনি। স্বাধীনতা শুধু পতাকা, জাতীয় সংগীত নয়। প্রজাতন্ত্রের আম জনতার সম্মান, অহংরক্ষার জন্যই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। কোন বিশেষ শ্রেণিকে জমিদার বানানোর জন্য নয়। ফরাসী বিপ্লবের পর স্লোগান ছিল ভিভা রিপাবলিকা–প্রজাতন্ত্রের জয় হোক!
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, চিকিৎসক