আমরা জানি, দেশের জনগণ ব্যবসা করতে গিয়ে সবসময় প্রতিকূল অবস্থার মুখোমুখি হয়। কাঙ্ক্ষিত কর্মসংস্থান না পেয়ে অনেকে বাধ্য হয়ে পেশা হিসাবে ব্যবসাকে বেছে নেন। ব্যবসায় এসে শুরুতে নানা প্রতিকূলতা বিশেষ করে ব্যাংক একাউন্ট ও সলভেন্সি সাটিফিকেটসহ অভিজ্ঞতা অর্জন করা খুবই কষ্টকর। প্রশ্ন হলো কাজ না করলে অভিজ্ঞতা হবে কিভাবে? তাই নতুনদের জন্য ব্যবসায় আসাটা খুব দুরূহ একটি কাজ। নতুন ব্যবসা শুরু করতে গেলে পুঁজির অভাবে অনেককেই পিছিয়ে পড়তে হয়। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন কাউকে ঋণ দিতে চায় না। এসব প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে যদি কেউ ব্যবসায় আসতে চান তবে সেক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা দুর্নীতি। এর সঙ্গে বড় দুশ্চিন্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে অপর্যাপ্ত অব কাঠামো, ঋণপ্রাপ্তির অপর্যাপ্ততা ও অদক্ষ প্রশাসন। এসব সমস্যার সঙ্গে সামপ্রতিককালের উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট ও অস্থায়ী নীতি ব্যবসার পরিবেশকে আরও জটিল করে তুলেছে। মনে রাখতে হবে, সরকার মোট শ্রম বাজারের মাত্র ৩.৫ শতাংশের নিয়োগ দাতা। বাকি ৯৬.৫ শতাংশের নিয়োগ দাতা হলো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।
দেশে বর্তমানে ৬০ লাখ উচ্চ শিক্ষিত বেকার আছে, সাথে আছে স্বল্প শিক্ষিত ও অশিক্ষিত বেকার যারা অদক্ষ। তাই এই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে নৈতিক সমর্থন ও উৎসাহ দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশে রয়েছে এর ভিন্নতা। এটি আমার কথা নয়, বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বাংলাদেশ ব্যবসায় পরিবেশ ২০২২: উদ্যোক্তা জরিপে উঠে এসেছে এমন তথ্য। এতে ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে ব্যবসার পরিবেশের অবনতি হয়েছে বলে জানানো হয়। ঢাকা চট্টগ্রাম নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের কৃষি উৎপাদন ও সেবা খাতে বিভিন্ন প্রতিস্ঠানের ৭৪ জন উদ্যোক্তা ও উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত সময়ে এই জরিপে অংশ নেন।জরিপের তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে ব্যবসায় দুর্নীতি ছাড়াও ১৫ টি দীর্ঘ মেয়াদি সমস্যা রয়েছে।সেগুলো হলো দুর্বল অবকাঠামো,ব্যাংক ঋনের অপর্যাপ্ততা,অদক্ষ প্রশাসন, মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, নীতি ধারাবাহিকতার অভাব, জটিল কর ব্যবস্থা, উচ্চ করহার, কর্মীদের মধ্যে দুর্বল নীতি নৈতিকতা, শিক্ষিত ও দক্ষ কর্মীর অভাব, সরকারের অস্থিতিশীলতা, অপরাধ ও চুরি, দুর্বল স্বাস্থ্যসেবা, উদ্ভাবনে অপর্যাপ্ত সক্ষমতা এবং শ্রম সংক্রান্ত নিয়ম নীতিতে সীমাবদ্ধতা।
জরিপে অংশ নেওয়া ব্যবসায়ীদের কাছে প্রশ্ন ছিল, করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে কত সময় লাগবে? জবাবে ৪৫ শতাংশ ব্যবসায়ী বলেছেন, তিন বছরের বেশি সময় লাগবে। তাঁদের হিসাবে, ২০২৫ সালে গিয়ে দেশের অর্থনীতি ক্ষতি কাটিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে। আর ৭ শতাংশ ব্যবসায়ী বলেছেন, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে এক বছরেরও কম সময় লাগবে।
ব্যবসায়ীদের মতামতভিত্তিক এই জরিপটি করা হয়েছিল করোনাকালে। তাই স্বাভাবিকভাবে ব্যবসায়ীদের কাছে করোনার প্রভাব ও ক্ষতি পোষাতে নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। জবাবে ২৮ শতাংশ ব্যবসায়ী বলেছেন, করোনার প্রভাবে বাধ্য হয়ে তাঁদের খরচ কমাতে হচ্ছে। সে কারণে কমাতে হচ্ছে শ্রমিক। করোনার ক্ষতি পোষাতে সরকার যে প্রণোদনা ঘোষণা করেছে, জরিপে সে বিষয়ে ব্যবসায়ীদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল। জবাবে ৬৩ শতাংশ ব্যবসায়ী বলেছেন, সরকারের প্রণোদনা বাস্তবায়নে নজরদারি ব্যবস্থা ছিল খুবই দুর্বল। করোনার কারণে স্বাস্থ্য খাতকে অন্যতম সমস্যাগ্রস্ত খাত হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া কর হার, কর ব্যবস্থাপনা এবং অদক্ষ শ্রমিককে ব্যবসার পথে নতুন বাধা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
আগামী ১০ বছরে দেশে নতুন বেশ কিছু ব্যবসার খাত তৈরি হবে বলে জরিপে উঠে এসেছে। ৬৭ শতাংশ ব্যবসায়ী বলেছেন, ডিজিটাল আর্থিক সেবা আরও বিকশিত হবে। দক্ষ মানবসম্পদ খাতকে সম্ভাবনার দ্বিতীয় অবস্থানে রেখেছেন ব্যবসায়ীরা। তৃতীয় অবস্থানে আছে তথ্য–উপাত্ত (ডেটা) ব্যবস্থাপনা।
অন্যদিকে গত বছরের ২৭ জুন থেকে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮ বিভাগের ১৯৪ জন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা বলে আরেকটি জরিপ করেছে সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস)। এতে দেখা গেছে, ৭৪ শতাংশ এসএমই উদ্যোক্তাই ব্যবসা করতে গিয়ে সরাসরি দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। করোনা পরবর্তী সময়ে এটি আরও ভয়াবহভাবে বেড়েছে। লাইসেন্স গ্রহণ ও কর পরিশোধে সবেচেয়ে বেশি দুর্নীতি হচ্ছে। ব্যবসা শুরুর লাইসেন্স পেতেও নবায়ন করতে ১৪–১৫টি ঘাটে ঘুষ দিতে হয়। অর্থাৎ দুর্নীতি এখন বাংলাদেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। ৪৪ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন, টাকা পাচার ঠেকানো এখন সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। ৬০ শতাংশ ব্যবসায়ীর মতে, অপ্রয়োজনীয় বড় প্রকল্প পরিহার করা দরকার।
সিপিডির জরিপে অংশ নেওয়া ৬৮ শতাংশ ব্যবসায়ী ব্যবসার ক্ষেত্রে দুর্নীতিকে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁরা বলেন ব্যবসার জন্য বিভিন্ন পরিষেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে তাঁদেরকে অবৈধ লেনদেন করতে হয়েছে। দুর্নীতির পর অদক্ষ আমলাতন্ত্রকে দ্বিতীয় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ৬৭ শতাংশ ব্যবসায়ী। আর ব্যবসার ক্ষেত্রে পুঁজির জোগানের সংকটের কথা বলেছেন ৫৫ শতাংশ ব্যবসায়ী। ৪২ শতাংশ ব্যবসায়ী বলেছেন, দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি পরিস্থিতি এখন বেশ চাপে আছে। এ ছাড়া ব্যবসায়ীরা ২০২৩ সালে টাকা পাচার বেড়ে যাওয়া, অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি তৈরির হওয়ার আশঙ্কা করেছেন। অন্যদিকে জরিপের অংশ নেওয়া ৪৭ দশমিক ৮ শতাংশ কর্মকর্তাও দুর্নীতিকে ব্যবসার বড় বাধা হিসেবে উল্লেখ করেন। কোনো কোনো জায়গায় দুর্নীতি হচ্ছে, সেটিও জরিপে উঠে এসেছে। ৬৪ শতাংশ কর্মকর্তা কর প্রদানে, ৫৪ শতাংশ ব্যবসায়িক লাইসেন্স নিতে, ৪৯ শতাংশ গ্যাস–বিদ্যুৎ–পানির সংযোগ নিতে এবং ৭৫ শতাংশ কর্মকর্তা আমদানি–রপ্তানিতে বিশেষ করে কাস্টমস ও বন্দরে দুর্নীতির কথা বলেছেন । তারা বলেন কাস্টমস ও বন্দরে ঘুষ না দিলে কোনো কাজ হয় না। শতভাগ সঠিক ভাবে মালামাল আমদানি করলেও আইনের নানা ফাঁকফোকরে হয়রানি নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। অভিযোগ করলে হয়রানি আরো বেড়ে যায় বলে টাকা খরচ করাই উত্তম বলে মনে করেন তারা। এ ছাড়া ৪৪ দশমিক ৬ শতাংশ দুর্নীতির পাশাপাশি ব্যবসার জন্য দুর্বল অবকাঠামো, ৪৩ দশমিক ১ শতাংশ ব্যাংক ঋণের অপর্যাপ্ততা ও অদক্ষ প্রশাসন, ৩৮ দশমিক ৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতি ও বৈদেশিক মুদ্রার অস্থিরতা, ৩৫ দশমিক ৪ শতাংশ নীতি ধারাবাহিকতার অভাব, ২৬ দশমিক ২ শতাংশ জটিল করব্যবস্থা ও উচ্চ করহার, ১৬ দশমিক ৯ শতাংশ দুর্বল নীতি নৈতিকতা ও সরকারে স্থিতিশীলতার অভাব, ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ অপরাধ ও উদ্ভাবনে অপর্যাপ্ত সক্ষমতা এবং ১০ দশমিক ৮ শতাংশ কর্মকর্তা শ্রমসংক্রান্ত নিয়মনীতির সীমাবদ্ধতাকে সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করেন।
এর আগে সর্বশেষ জরিপটি করা হয়েছিল ২০২০ সালে। সেসময় ব্যবসার পরিবেশ জরিপে অংশ নেওয়া ব্যবসায়ীদের সিংহভাগই ব্যবসা করার ক্ষেত্রে অদক্ষ প্রশাসনকে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। ওই জরিপে অংশ নেওয়া ব্যবসায়ীরা দুর্নীতিকে দ্বিতীয় ও পুঁজি বা অর্থায়নের সমস্যাকে তৃতীয় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে চিহ্নিত করেন। আর এবারের জরিপে ব্যবসার প্রধান অন্তরায় হিসেবে শীর্ষে উঠে এসেছে দুর্নীতি।
সিপিডি বলছে, দুর্নীতির কারণে বড় ব্যবসায়ীদের তুলনায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা। জরিপে অংশ নেওয়া ৫২ শতাংশ বড় ব্যবসায়ী বলেছেন, দুর্নীতির কারণে তাঁদের ব্যবসা ব্যাহত হয়েছে। আর ১০০ ভাগ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বলেছেন, দুর্নীতির কারণে তাঁদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জরিপের ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, দুর্নীতি, অদক্ষ আমলাতন্ত্র ও পুঁজির জোগানের সীমিত সুযোগ এ তিন চ্যালেঞ্জ ব্যক্তি খাতের জন্য সুখকর নয়। অথচ দেশের অর্থনীতির ৮০ শতাংশই আসে ব্যক্তি খাত থেকে। উল্লেখিত প্রতিবন্ধকতার কারণে ব্যক্তি খাত সামনে এগোতে পারছে না। তাই আমরা আশা করব, সরকারের নীতি নির্ধারকেরা বিষয়টির দিকে নজর দেবেন।
লেখক: কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক