দেশ হতে দেশান্তরে

পথিকৃৎ বাঙালি

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ১২ মার্চ, ২০২৩ at ৬:১০ পূর্বাহ্ণ

এই শোন এবার একটু রেস্ট নিতে হবে আমার’। পাহাড়ের উপ থেকে থকে নিম্নগমনের সিঁড়িপথের মোটামুটি আধাআধি অতিক্রম করে এখন এই ল্যান্ডিং থেকে বাঁয়ে থাকা মোটামুটি সমতল হাঁটাপথ ধরে পরবর্তী ধাপের সিঁড়ির উদ্দেশ্য পা বাড়াতেই পেছন থেকে লাজুর এই কথা কানে যেতেই ঐ একই দিকে এগুতে থাকা দু পুত্রকে থামতে বলে, এই ঢালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাথুরে একটা টুলের উপর বসে পড়লাম নিজে।

অচিরেই পাশের একটা পাথুরে টুলে বসতে বসতে লাজু জানাল

শোন, আজ আর যেখানেই যাও, আমি কিন্তু আর হাঁটাহাঁটি করতে পারবো না। গাড়িতেই বসে থাকবো। তোমরা তোমাদের মতো ঘোরাফেরা করে দেখে নিও’।

আচ্ছা তোমার ব্যাগে কি ব্যথার ঔষধ আছে? যদি থাকে, তাহলে লাঞ্চের পর ওটা খেয়ে নিও। ওর আহত পায়ের ব্যথা বেড়েছে নিশ্চয় ভেবে কথাগুলো বেশ জোর দিয়ে বলতেই

না, না ওটা দরকার নেই। অতো ওষুধ খাওয়ার মতো ব্যথা হচ্ছে না, তবে খুবই টায়ার্ড লাগছে। আর শুধু পায়ের পাতা না, হাঁটুতে সামান্য ব্যথা লাগছে। এতো উপরে হেঁটে হেঁটে উঠেছি নাকি কোনোদিন? কিভাবে যে উঠলাম সেটাই ভাবছি এখন। এতো উপরে উঠতে হবে জানলে, নিচেই থেকে যেতাম আমি। ওহ মাগো ‘বসে বসে নিজের পায়ের শুশ্রূষা করতে গিয়ে নিজে নিজে ব্যথা পেয়ে ও ককিয়ে উঠতেই, তুমুল উদ্বেগে

কী হল? কী হল? জিজ্ঞেস করতে করতে মনে মনে প্রমাদ গুনলাম এই ভেবে যে, হায় এখনও তো বাকি আধাআধি পথ। পারবে তো ও নামতে বাকি সিঁড়িগুলো? বিশেষত এ সময় যদি পায়ের মাংশপেশিতে টান পড়ে, মানে ইংরেজিতে যাকে বলে মাসল পুল করা, তাহলে তো আসলেই পড়বো বিরাট ঝামেলায়!

না, না তেমন কিছু না। এই পা টা সোজা করতেই হাঁটুতে কেমন যেন কচ করে উঠলো। এখন ঠিক আছে’।

আচ্ছা তোমার ব্যাগে ঐ ভলটারেন ইমালজেলটা আছে কি? থাকলে ওটা একটু মেখে নাও এক্ষুনি পায়ে। যদি না থাকে, তবে নেমে দেখি এখানে যে দোকানপাঠ আছে ওখানে চায়নিজদের শত শত বছরের পুরানো ঐতিহ্যবাহী বাম, যা নাকি বিশ্ব না হলেও এশিয়া যে জয় করেছে তা নিশ্চিত, সেই টাইগার বাম পাওয়া গেলে কিনে নেব ওটা। গাড়িতে বসে পায়ে মেখে নিও।

না, না, ঐ বাম আমি মাখতে পারবো না। যা গন্ধ ওটার, সহ্য হয় না আমার। তবে হ্যাঁ, ভালো কথা মনে করেছ। দেশে ফেরার আগে টাইগার বাম কয়েকটা কিনে নিতে হবে। ভাইয়া বলেছিল নিয়ে যেতে। মাথা ব্যথা হলে ওটাতে নাকি ওনার ভাল কাজ হয়। আচ্ছা চলো। আর রেস্ট নেওয়া লাগবে না, ওদের ক্ষিদে পেয়েছ তো ‘বলেই ও উঠে দাঁড়াতে গিয়ে আবারো পায়ের ব্যথায় ককিয়ে উঠতেই ঠিক করলাম, হাঁটবো এবার ওর পাশাপাশি যাতে প্রয়োজনে ভর দিতে পারে আমার কাঁধে

কী দাদা, এখনি আবার আমরা নামতে শুরু করবো নাকি? আমাদের দুজনকে গাত্রোত্থান করতে দেখে অদূরে বসে থাকা হেলেন জিজ্ঞেস করতেই বললাম

কেনো ? আরো কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিবি নাকি তুই? তা নেয়া যেতে পারে, মাত্রই তো পাঁচ ছয় মিনিট হয়েছে।

না না , ঠিক আছে। চল যাই’ বলে ঝটপট হেলেন উঠে দাঁড়াতেই, সামনের দিকের একটা গাছের নিচে জমে থাকা বরফ নিয়ে খেলায় ব্যস্ত দু পুত্রকে দেখিয়ে বললাম, এখন তুই ওদের নিয়ে নামতে শুরু কর। ওর পায়ের ব্যথা তো!

আরে না না। তুমি কি আমাকে কাঁধে করে নামাবে নাকি? ওরকম খারাপ অবস্থা না আমার। যাও তুমিই ওদের কে নিয়ে। যাও যাও ‘আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে লাজু বলে উঠতেই বরাবরের মতোই স্ত্রী আজ্ঞা শিরোধার্য করে ওদের দুজনকে পিছু ফেলে এগিয়ে গেলাম পুত্রদের দিকে।

এদিকে আমাদের এগুতে দেখে মহা উল্লসিত পুত্রদ্বয় নিজেদের বরফ খেলায় হঠাৎ যতি টেনে হৈ হৈ করে এগুতে শুরু করতেই

অ্যাই ! অ্যাই পড়ে যাবে! তোমারা পড়ে যাবে’!

মাতা ও ফুপ্পির যুগপৎ এই সতর্ক বার্তায় ওরা দৌড়ঝাঁপ থামিয়ে, বিশেষত দীপ্র বেশ বিরক্তি নিয়ে পেছন ফিরে তাকাতেই দ্রুত এগিয়ে ওদের বগলদাবা করে সামনের দিকে পা বাড়াতেই দীপ্র জানালো

বাবা আমি কিন্তু দুটো ডাবল উফার বার্গার নেবো’। সাথে সাথেই অভ্রও ‘আমিও তাই নেবো’। বলে একাত্মতা ঘোষণা করতেই পরিষ্কার হলো নিচে নামার ব্যাপারে তাদের এই হুড়োহুড়ি করার কারণ। আহারে! পেটের তুমুল ক্ষিধের কারণে নীচের চত্বরে ফেলে আসা বার্গার কিং ডাকছে ওদের এখন প্রাণপণ।

ঠিক আছে। কোনো অসুবিধা নেই। আরো কিছু যদি নিতে চাও তাও দেয়া হবে। বলে দ্রুত ওদের দাবী পূরণের নিশ্চয়তা দিয়ে এই হাঁটা পথের শেষ মাথায় যেখানে সিঁড়ির আভাস দেখা যাচ্ছে সেদিকে এগুচ্ছি যখন, নিচ থেকে তখন কানে ভেসে এলো উচ্চস্বরের নারী কণ্ঠের হাসি আর সাথে চিং চাং চুং চাং পুরুষকণ্ঠের চায়নিজ বাৎচিত। বোঝা গেল নিচ থেকে মহাপ্রাচির অভিযানে উঠে আসছে নিশ্চিত কোনো একটা স্থানীয় মানে চায়নিজ দল।

অতপর সিঁড়ির মাথায় এসে বাপবেটা তিনজন দাঁড়াতেই দেখতে পেলাম দু জোড়া চায়নিজ নারী ও পুরুষকে। নিজেদের মধ্যে কথা বলাবলি, হাসাহাসি আর ঢলাঢলি করতে করতে অপরিসর এই সিঁড়িটির গোটা প্রস্থ দখল করে যে রকম দুলকি চালে উঠে আসছে ওরা কোনো দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে, তাতে মনে হচ্ছে ওরা না উঠা পর্যন্ত আমাদের আপেক্ষাই করা উচিৎ এখানে। উঠেছে তো ওরা মাত্র এই সিঁড়ির ধাপ গুলোর এক তৃতীয়াংশ মাত্র। তাহলে কি অপেক্ষাই করবো না কি?

সাথে সাথেই মনের দ্বিতীয়জন ঘোষণা করলো, আর না তা করবে কেন ? এইসিঁড়ি তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি নাকি, যে তাদেরকে এভাবে এর দখল ছেড়ে দিতে হবে? ওরা যদি আশেপাশের মানুষদের এরকম দেখেও না দেখার ভান করতে পারে, আমরা কেন তাদের এই অসংগবেদনশীলতাকে পাত্তা দিতে যাবো? বিশেষত আমরা তো এখানে অতিথি ! মনে নেই সেই কথাটা ঐ যে বলে না, আধিকার কেউ কাউকে না দিলে তা আদায় করে নিতে হয়?

মনের দ্বিতীয়জনের এ কথায় প্রথমজনও দেখি একথায় সায় দিল অবলীলায়! অতএব পুত্রদ্বয়কে সিঁড়ির ডানদিকের রেলিং ঘেঁষে নামার নির্দেশনা দিয়ে, একজন আরেকজনের পিছু নামার জন্য সামনের দিকে ঠেলে দিয়ে নিজেও পিছু নিলাম ওদের।

নামতে নামতে ঐ চায়নিজ দলটিকে পাশ কাটাতে গিয়ে বড়ই বিরক্ত লাগলো। কারণ দেখলাম আমরাও যে এই অপরিসর সিঁড়ি দিয়েই নামছি তা নিয়ে মোটেও ভ্রুক্ষেপ নাই ওদের। এ মুহূর্তে নিজে গতি কমিয়ে রেলিংর সাথে জড়সড়ও হয়ে না দাঁড়ালে, একটা জোর ধাক্কাই লেগে যেতো এ দলের সবচেয়ে স্বাস্থ্যবতি মহিলাটির সাথে! নিজের জান বাঁচানোর তাগিদে আগেভাগেই সাবধানতা অবলম্বন করার পরও এক্কেবারে পুরো শেষ রক্ষা না হলেও, জোর ধাক্কাটি জোর ঘষাতেই রূপান্তরিত হওয়ায় হাঁফ ছাড়লাম। সেই ঘষায় শরীরে আগুন না জ্বললেও মনের ভয়ে পেছনের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে উপরের দিকে এক ঝলক চোখ ফেলতেই দেখতে পেলাম এইমাত্র সিঁড়ি গোড়ায় এসে দাঁড়ানো দলের দুই নারী সদস্যকে!

অতপর সিঁড়ি বেয়ে নামার গতি অবিচল রেখে মনে মনে ভাবছি একেই বলে যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যায় হয়, অবস্থা। জানি না, একটু আগে চায়নিজ করিমন নাকি রহিমা বেগমের কাছে খাওয়া জোরঘষাটি চোখে পড়েছে কি না লাজুর! পড়লেই বা কী করার ছিল আমার ? কপালে দুঃখ থাকলে এভাবেই তা নেমে আসে বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের মতোই।

এরা এরকম কেয়ারলেস কেন? একটু সরিও ও বলছে না’! স্বগতকণ্ঠে বেশ উচ্চস্বরেই বিরক্তি জানালো নীচ থেকে এসময় দীপ্র। কারণ ঐ চারজনের একজনের কাঁধে ঝোলানো ব্যাগের ধাক্কা লেগেছে ওর মুখে।

সাবালক মানুষের নাবালকত্বের ব্যাপারে নিতান্তই নাবালকের কাছে আর কিইবা বলি ? অতএব পুত্রের ঐ কথার কোনো জবাব না দিয়ে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামার দিকেই মনোযোগ নিবিষ্ট করলাম। সামনে একমনে নামছে পুত্ররাও, তবে নামছে ওরা নিয়মমেনেই। কোনোরকম হুড়োহুড়ি না করেই, আগের মতোই ডানে রেলিং ঘেষে।

নামতে নামতে, ঐ নারীঘষার সূত্র ধরেই ফের মনে হলো, আসলেই তো এ পর্যন্ত নানান চায়নিজ নারীপুরুষের সাথে নানান কারণে পরিচয় হলেও, দুয়েকজন পুরুষের নাম মনে থাকলেও কোনো নারীর নামই মনে করতে পারছি না। অবশ্য এটাও কথা ঠিক, চায়নিজ নারীদের যাদের সাথে যখনই পরিচয় হয়েছে, তারা কিন্তু তাদের চায়নিজ নামে পরিচয় দেয়নি। রিজেন্ট হোটেলের কন্সিয়ারজ মিস ইনার মতো সকলেই তারা পরিচয় দিয়েছে, পরবর্তীতে নিজে নিজে নেওয়া তাদের ইংরেজি নামেই। সেগুলোর প্রত্যেকটাই না হলেও অনেকগুলোই মনে আছে। আচ্ছা ঐ যে চায়নার পাণ্ডাকূটনীতির প্রচলনকারী চিয়াং কাইশেকের স্ত্রী, তাঁরও কি কোনো ইংরেজি নাম ছিল ?

হয়েছে এই আমার এক জ্বালা! মনের ভেতরে কোনো কিছু একবার ঢুকে বসলে ওটা নিয়ে যতক্ষণ কোনো একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে না পারছি, বা ওটার কোনা না কোনো দফারফা করতে পারছি, ঘুরে ফিরে আসে তা মনে, নানান সময়ে নানান ভাবে , নানান উসিলায়। যেমন হল এখন ফের! ঐ যে তখন পুত্রদের পাণ্ডাবিষয়ক প্রশ্নের লেজ ধরে মনে পড়েছিল পাণ্ডাকূটনীতির কথা এবং ভাবতে শুরু করেছিলাম তা নিয়ে যখন, ঠিক তখনই লাজু জানিয়েছিল তার বিশ্রাম নেবার আবশ্যিকতার কথাটি ! ফলে সে ভাবনায় সেসময় ছেদ পড়লেও ফিরে এসেছে তা এখন ঠিকই।

বাবা , বাবা আমরা কি এখন একটু রেস্ট নেব’? আমাদের নিম্নগমনের এ যাত্রার তৃতীয় ধাপের সিঁড়ি পেরিয়ে সেটির ল্যান্ডিং এ পৌঁছতেই দীপ্র একথা জিজ্ঞেস করতেই, উপরের দিকে তাকিয়ে তখনো সিঁড়ি ভেঙে নেমে আসা হেলেন আর লাজুকে একই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতেই, লাজু জানালো যে ওর বিশ্রাম দরকার নেই। আমাদের কারো যদি বিশ্রাম লাগে তবে থামা যেতে পারে। আর না হয় একটানাই নেমে যাবে। কারণ নিচে নেমে ওদেরকে খাওয়ানোটাই জরুরি ।

লাজুর এ জবাবের সাথে হেলেনও একমত পোষণ করতেই, দু’পুত্র জানালো তাদেরও দরকার নেই বিশ্রামের। অতএব সবাই একাট্টা হয়ে ফের নিম্নগমনের জন্য পরবর্তী সিঁড়ির দিকে এগুচ্ছি যখন তখনই মনে হল, আরে চায়নিজরা তো সবেমাত্র ১৯৪০ সনে পাণ্ডা দিয়ে পশু কূটনীতির সূচনা করেছিল, সে জায়গায় আমরা বাঙালিরা এরকম পশু কূটনীতি তো শুরু করেছিলাম আরো আগে! যার মানে হচ্ছে, আর যতো বিষয়েই চায়না আমাদেরকে পেছনে ফেলে থাকুক না কেন, এই পশু কূটনীতির ব্যাপারে নিশ্চয় তারা হারাতে পারছে না বাঙালিকে! এ ব্যাপারে নিশ্চয় তবে বাঙালিই পথিকৃৎ।

লেখক: ভ্রমণ সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসমপ্রীতিময় হয়ে উঠুক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম
পরবর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ এক ও অবিচ্ছেদ্য