আল্লামা শাহ্‌ সফিরুর রহমান হাশেমী নক্‌শবন্দী মুজাদ্দেদী (রহ.)

আমানউদ্দীন আবদুল্লাহ | শনিবার , ১১ মার্চ, ২০২৩ at ৫:০০ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশে নক্‌শবন্দীয়া মুজাদ্দেদীয়া তরীকার প্রচার ও প্রসারে যে সমস্ত সূফী সাধক অনন্য সাধারণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে শায়খুল হাদীস, আল্লামা শাহ্‌ সফিরুর রহমান হাশেমী নক্‌শবন্দীমুজাদ্দেদী (রহ.) এর নাম বিশেষ প্রণিধানযোগ্য।

তিনি মাতার দিক দিয়ে আমিরুল মুমিনিন হজরত আবু বকর ছিদ্দিক (রাঃ) এবং পিতার দিক দিয়ে হজরত গাউছুল আজম দস্তগীর মহিউদ্দিন আবদুল কাদের জিলানী ()এর সুযোগ্য বংশধর ছিলেন। তিনি চট্টগ্রামের ফৌজদারহাটস্থ ছলিমপুর গ্রামে হজরত মাওলানা ওবাইদ উল্লাহ হাশেমী () এর ঔরসে ১৮৮৭ সনে জন্মলাভ করেন। তদীয় পূর্ব পুরুষ মুহাম্মদ ছলিম কাজীর নামানুসারে ছলিমপুর গ্রামের নামকরণ করা হয়েছে।

মাত্র সাত বৎসর বয়সে মাতৃহারা হলে পিতার তত্ত্বাবধানে তিনি পবিত্র কুরআন শিক্ষায় মনোনিবেশ করেন। স্থানীয় মাদ্রাসায় আরবী, উর্দু, ফার্সীতে তিনি বিভিন্ন ধর্মীয় কিতাব অধ্যয়ন করেন। মাত্র ১৫ বছর বয়সে পিতাকে হারিয়ে তিনি অনেকটা মুষড়ে পড়েছিলেন। বার্মা প্রবাসী তদীয় জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা মাওলানা খায়রুল বশরের অনুপস্থিতিতে প্রায় দু’বছর পর্যন্ত পারিবারিক কাজকর্ম এমনকী খেতখামারের কাজও তিনি নিজ হাতেই সমাধা করতেন। তথাপি উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের প্রতি তাঁর অদম্য স্পৃহা এবং তদানিন্তন স্বনামধন্য আলেমদের মত পাণ্ডিত্য অর্জনের মনোবাসনা তাঁকে ভারত গমনের জন্য প্রেরণা যুগিয়েছে।

ইত্যবসরে তিনি নিজ মহল্লার ছোট্ট বাচ্চাদের লেখাপড়ার ভার গ্রহণ করেন। তথাকার জনৈক ভদ্র মহিলার বদান্যতার কারণেই বিদেশ গমনের প্রাথমিক খরচাদি সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন।

তথাকার মহল্লার মসজিদের ইমাম ছিলেন ভারতের জৌনপুর নিবাসী একজন হাফেজ। ভারতে গিয়ে লেখাপড়ার জন্যে তিনিই সর্বপ্রথম হজরতকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। হজরতের বিদেশ যাত্রার ব্যাপারে তাঁর বড় মামা মাওলানা এরশাদউল্লাহ এবং মেঝ খালার অনুপ্রেরণা উল্লেখযোগ্য। একদিন হজরত, জৌনপুরের বর্ণিত হাফেজ সাহেবের সাথে ভারত গমনের উদ্দেশ্যে ভাটিয়ারি স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু করে চাঁদপুর ও গোয়ালন্দ হয়ে কোলকাতা পৌঁছলেন। এখানে এসে শুনলেন তালতলায় তাঁর পূর্ব পুরুষ হাসান শরীফ ফৌজদার এর যে সমস্ত জমিজিরাত ছিল তা ইতোমধ্যে বেহাত হয়ে গেছে। হজরত সেখান থেকে জৌনপুরে এসে প্রখ্যাত আলেম মাওলানা হেদায়েত উল্লাহ খান এর কাছে আরবী ব্যাকরণের প্রাথমিক পাঠ গ্রহণ করেন। অত:পর মাওলানা সাহেবের নির্দেশে হজরত বেনারস চলে আসেন। বেনারসের প্রখ্যাত আলেম মাওলানা আব্দুল আলীর সান্নিধ্যে তিনি ইসলামী জ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করেন।

বেনারস অবস্থানকালে হজরত খন্ডকালীন দুঃখ দুর্দশায় কালাতিপাত করেছেন। এমনকি দীর্ঘ তিন বছর বালিশ ছাড়া রাত যাপন, মাত্র দেড়খানা রুটির সাথে এক চামচ ডাল দিয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তি করেছেন। কয়েক বছর যাবত হজরত মাত্র একটি লুঙ্গিতেই দিন কাটিয়েছেন। বিদেশ বিভূঁইয়ে এভাবে অর্ধহারেঅনাহারে থেকে হজরত আল্লাহপাকের মর্জির কাছে নিজেকে সমর্পণ করে দিয়েছিলেন। ছাত্র জীবনের দিনগুলোতে দিন দিন পুষ্টিহীনতায় ভুগে তাঁর শারীরিক ক্ষমতা লোপ পেতে থাকলে তিনি ভেষজ গাছের পাতা চিবিয়ে তার রস পান করতেন। এত কষ্টের মধ্যেও তিনি জ্ঞান সাধনার এ মহান পরীক্ষায় বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি।

মাওলানা আব্দুল আলী ছাহেবের সান্নিধ্যে প্রায় ১১ বছর কাটিয়ে তাঁরই উৎসাহে হজরত উত্তর প্রদেশের রামপুর এসে মাওলানা ফজলে হক রামপুরীর তত্ত্বাবধানে মাদ্রাসা আলীয়াতে ভর্তি হন। এখানে লেখাপড়ায় সফলতা প্রদর্শনের ফল স্বরূপ কর্তৃপক্ষ হজরতের জন্যে ১৫টাকা মাসোহারা নির্ধারণ করেন। ইসলামী জ্ঞানে হজরতের বিশাল পাণ্ডিত্য দেখে হায়দারাবাদের প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁর জন্যে আরো পাঁচ টাকা মাসোহারা নির্ধারিত হয়। ভোগ বিলাস ও আনন্দ বিমুখতা তাঁর সঙ্গী ছিলো। আরাম, আয়েশ, খাওয়া দাওয়ার প্রতি অনীহা তাঁকে মাহাত্ম্য দান করেছে। আলীয়া মদ্রাসায় অধ্যয়নকালে তিনি মাওলানা মুফ্‌তি এবং মোহাদ্দেস উপাধিতে ভূষিত হন। এরপরও তিনি হাদীস শাস্ত্রের উপর দীর্ঘ চার বৎসর গবেষণা করেন। হাদীসের হাফেজ ছিলেন বিধায় প্রায় কয়েক হাজার ছহিহ্‌ হাদীস কণ্ঠস্থ করে তিনি শায়খুল হাদীস রূপে বিরল সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন। পরিশেষে তিনি হেকিম শাস্ত্রেও বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেন।

কথিত আছে যে, হজরতের দরবারের রূহানী মাহফিলে মারিফাত অন্বেষুদের আধ্যাত্মিক অবস্থা এতই নাজুক হতো যে নিজেকে স্থির রাখা অনেক সময় কঠিন হয়ে যেত। হযরতের রূহানী ফয়েজে অভিষিক্ত হয়ে যে সমস্ত মনীষী চট্টলার মারিফাত জগতে অত্যন্ত মর্যাদা পূর্ণভাবে অধিষ্ঠিত হয়েছেন তাঁদের মধ্যে সর্বোপরি হজরত জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারি (), শেরে বাংলা হজরত আল্লামা আজিজুল হক আলকাদেরী (.), চুনতির শাহ ছাহেব () এবং কুতুবদিয়ার মালেক শাহ্‌ () এর নাম অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে হয়। শরীয়তের বিধিবিধান এবং সরকারে দোজাহান, নূরে মুজাচ্ছাম হজরত মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর সুন্নতের পায়রবীতে তিনি ছিলেন আপসহীন। তিনি পবিত্র রমজানের শেষ দশ দিন এতেকাফের মাধ্যমে নীরবতা পালন করতেন। প্রায় সময় তিনি উপমহাদেশের প্রখ্যাত অলীয়ে কামেল হজরত শাহ্‌ সূফী আমানত খান () এর রওজা শরীফে বসে বিনয়াবনত চিত্তে ধ্যানের সাগরে ডুবে যেতেন।

মাদ্রাসায় শিক্ষকতা, আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদে ইমামতি, দাওয়াখানাতে দুস্থ রোগীদের হেকিমী পরামর্শ এবং তরীকত পন্থীদের মারিফাতে দীক্ষা দান এই চতুর্বিধ ক্ষেত্রে অত্যন্ত সফলতার পরিচয় দিয়ে এল্‌ম তাসাওফের এই দেদীপ্যমান নক্ষত্র হজরত মাওলানা ছফিরুর রহমান হাশেমী () ৬৭ বৎসর বয়স অতিক্রমকালে ১৯৫৪ সনে হিজরী ১৩৭৪ সনের ১৮ শাবান মঙ্গলবার মহা মিলনের পথে যাত্রা করে স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভ করেন।

লেখক : প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধসকল কর্মে নারীরা বিজয়ী
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে